স্মরণীয় এক কথাকার

>২৫ ডিসেম্বর ছিল কথাসাহিত্যিক আবু রুশদের জন্মশতবর্ষ
আবু রুশদ  (২৫ ডিসেম্বর ১৯১৯—২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১০)। ছবি: সংগৃহীত
আবু রুশদ (২৫ ডিসেম্বর ১৯১৯—২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১০)। ছবি: সংগৃহীত

আবু রুশদ নামে সাহিত্যজগতে পরিচিত হলেও তাঁর পুরো নামটি ছিল আবু রুশদ মতিনউদ্দিন। বাংলা একাডেমি ও একুশে পদকপ্রাপ্ত এই সাহিত্যিকের জন্মশতবার্ষিকী ছিল ২৫ ডিসেম্বর। আজকের প্রজন্মের কাছে, এমনকি তরুণ সাহিত্যকর্মীদের অনেকের কাছে আবু রুশদ প্রায় বিস্মৃত একটি নাম। তিনি ছিলেন স্বভাবজাত নিভৃতচারী। ৯১ বছরের দীর্ঘ জীবন পেয়েছিলেন বটে, কিন্তু শেষ ১০ বছর বলা চলে কিছুই লেখেননি। স্ত্রী আজিজা ইসমাইলের কথায়, এ সময়ে তিনি এড়িয়ে গেছেন সভা-সেমিনার, এমনকি বন্ধুবান্ধবের আড্ডাও।

ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক। পড়াশোনা করেছেন কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ডে। সর্বশেষ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক হিসেবে অবসর নেন। তবে আবু রুশদ সাহিত্যসাধনা করেছেন বাংলায়।

তাঁর সমসাময়িক কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে রয়েছেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, আবু জাফর শামসুদ্‌দীন, শামসুদ্দীন আবুল কালাম, আবুল হোসেন, আবুল ফজল, শওকত ওসমান, সৈয়দ আলী আহসান প্রমুখ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং পঞ্চাশের দুর্ভিক্ষ এ অঞ্চলের গ্রামীণ সমাজের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল। আর তখনকার সাহিত্যিকদের অনেকেই এই ভাঙনধরা গ্রামীণ সমাজচিত্র নিয়ে সাহিত্য রচনায় প্রয়াসী হন।

এদিক থেকে আবু রুশদের সাহিত্যের বিষয় ছিল কিছুটা ভিন্ন। নাগরিক চরিত্র ও চিত্র সৃষ্টির দিকেই তাঁর আগ্রহ ছিল বেশি। তিনি প্রকৃতই ছিলেন শহরের মানুষ। দেশভাগ, মুসলিম শিক্ষিত সমাজের উত্থান, মধ্যবিত্ত মুসলিম সমাজের জীবনকাহিনির সুনিপুণ উপস্থাপক ছিলেন আবু রুশদ। জন্মেছিলেন কলকাতার এক উচ্চমধ্যবিত্ত মুসলমান পরিবারে, যে পরিবারের ভাষা ছিল উর্দু। তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ রাজধানীতে ঝড় বেরোয় ১৯৩৮ সালে। ৬টি উপন্যাস, ৫০টি ছোটগল্প এবং তিন খণ্ডের আত্মজীবনী রচনা করেছেন আবু রুশদ। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনার মধ্যে রয়েছে এলোমেলো (১৯৪৬), সামনে নতুন দিন (১৯৫১), ডোবা হলো দিঘি (১৯৬০), নোঙ্গর (১৯৬৭), অনিশ্চিত রাগিণী (১৯৬৯), স্থগিত দ্বীপ (১৯৭৪)। এর বাইরে বাংলায় যেমন উইলিয়াম শেক্‌সপিয়ারের কবিতা অনুবাদ করেছেন, তেমনি ফকির লালন শাহের গান অনুবাদ করেছেন ইংরেজিতে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার আগে বিভিন্ন সময়ে তিনি কলকাতার ইসলামিয়া কলেজ, ঢাকা কলেজ, চট্টগ্রাম কলেজ, রাজশাহী কলেজে অধ্যাপনা করেন। অধ্যাপনার পাশাপাশি বিভিন্ন সরকারি পদেও নিযুক্ত ছিলেন। ষাটের দশকের গোড়ার দিকে তিনি পাকিস্তান থেকে সিনিয়র ফেলো হিসেবে জাতিসংঘে মনোনীত হন এবং পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করেন। কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে আবু রুশদ ছাত্র হিসেবে পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।

তিনি ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালের ৪ আগস্ট ওয়াশিংটন ডিসিতে পাকিস্তান দূতাবাসে কাউন্সেলর (শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক) হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় তিনি দ্বিতীয় সচিব আতাউর রহমান চৌধুরী, তৃতীয় সচিব সৈয়দ মুয়াজ্জেম আলী, সহকারী প্রশাসনিক অ্যাটাচি এম এ এম শরফুল আলম, সহকারী প্রেস সচিব শেখ রুস্তম আলীসহ অন্যান্য মিশন-কর্মীদের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। পরবর্তীকালে তাঁরা ‘বাংলাদেশ মিশন ওয়াশিংটন’ নামে একটি সংহতি সংগঠন গঠন করেন। এ সংগঠনের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরি করে অবদান রাখেন। মুজিবনগর সরকারের পক্ষে তিনি বাংলাদেশ নিউজলেটার নামে একটি পাক্ষিক প্রকাশের দায়িত্বে ছিলেন।

আবু রুশদ বিয়ে করেছিলেন পাকিস্তান সরকারের পুলিশের প্রথম দিকের আইজি ও সাহিত্যে স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত আবুল হাসনাতের মেয়ে আজিজা ইসমাইলকে। তাঁর বড় ভাই এ জেড আবু তৈয়ব পশ্চিমবঙ্গ পাবলিক সার্ভিস কমিশন এবং পে কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন। ঔপন্যাসিক রশীদ করীম ও সাংবাদিক ফজলে রশিদ তাঁর ছোট ভাই।

ষাটের দশকে সাহিত্যকর্মের জন্য স্বীকৃতি পেতে শুরু করেন আবু রুশদ। তাগমা-ই-ইমতিয়াজ তাঁর প্রথম সাহিত্য পুরস্কার। ১৯৬৩ সালে তিনি আদমজী সাহিত্য পুরস্কার এবং ১৯৬৪ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হন। স্বাধীন বাংলাদেশে তাঁর প্রথম স্বীকৃতি ১৯৮১ সালে, একুশে পদক। যদিও জীবদ্দশায় কখনো কোনো মোহ পেয়ে বসেনি আবু রুশদকে। আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন, ‘প্রচণ্ড কোনো আকাঙ্ক্ষার বশবর্তী হয়ে আমি কখনো এমন কিছু করিনি, যাতে আমার মানসিক শান্তি বিঘ্নিত হতে পারে।’

আবু রুশদ এ দেশের উল্লেখযোগ্য কথাসাহিত্যিকদের একজন। তিনি খুব অল্পসংখ্যক লেখকের মধ্যে অন্যতম, যাঁরা অবিভক্ত ভারতের মুসলিম সমাজের আর্থসামাজিক অবস্থার সফল চিত্র এঁকেছেন। তাঁর লেখায় আজকের পাঠকেরা সাহিত্যরস ও সামাজিক ইতিহাসের উপাদান একই সঙ্গে পাবেন। তাঁর বইগুলো পুনঃপ্রকাশ করে নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়া এখন এ সময়ের জোরালো দাবি।