প্যারিসে পাবলো পিকাসোর স্টুডিওতে

ফ্রাসোয়া জিলো এবং পাবলো পিকাসো
ফ্রাসোয়া জিলো এবং পাবলো পিকাসো

ফ্রঁসোয়াজ জিলোর স্মৃতিতে শিল্পী পিকাসোর সঙ্গে তাঁর জীবন। লাইফ উইথ পিকাসো বই থেকে

[ফ্রঁসোয়াজ জিলো একজন ফরাসি চিত্রশিল্পী, সমালোচক ও লেখক। জিলোর সঙ্গে পাবলো পিকাসোর দেখা হয় ১৯৪৩ সালে এবং খুব দ্রুতই তাঁদের মধ্যে একটা অন্তরঙ্গ সম্পর্ক তৈরি হয়, যার স্থায়িত্ব ছিল দশ বছরের বেশি। তাঁদের বিচ্ছেদের এগারো বছর পর জিলো তাঁর সর্বাধিক বিক্রীত ‘লাইফ উইথ পিকাসো’ প্রকাশ করেন। ১৯৭০ সালে তিনি জোনাস সল্ককে বিয়ে করেন। জোনাস পোলিও ভ্যাকসিন আবিষ্কারের পথিকৃৎ ছিলেন। জিলো প্যারিস ও নিউইয়র্ক দুই জায়গাতেই বসবাস করছেন।]

জুনভিয়েভের সঙ্গে ছুটি কাটাতে মন্টপলিয়ের কাছে ফোন্তেস নামের ছোট্ট একটা গ্রামে গিয়েছিলাম। তখনো মুক্তাঞ্চল ছিল ওটা; জার্মানদের দখলে যায়নি। ওখানে থাকার সময়ে আমি—বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় কম বয়সীদের যেসব সংকটের মধ্য দিয়ে যেতে হয়—ওই জাতীয় কিছু সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম। এর কারণ অবশ্য পিকাসো ছিলেন না। তাঁর সঙ্গে দেখা হওয়ার বেশ কিছুকাল আগ থেকেই ওসবের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম আমি। তখন পর্যন্ত যে জীবনটা পার করে এসেছি এবং যে জীবনটা আসলেই যাপন করা উচিত বলে আমি মনে করি, এই দুটি বোঝাপড়ার মধ্যে একধরনের মানসিক হিশাব-কিতাব মিলিয়ে নেওয়ার মতোই বিষয়টা।

বেশ ছোটকাল থেকে ইনসমনিয়ায় ভুগেছি আমি, রাতগুলোকে ঘুমানোর চেয়ে পড়ার কাজে লাগিয়েছি বেশি। বেশ দ্রুত পড়তে পারতাম বলে, বেশ ভালোসংখ্যক বই পড়ে ফেলেছিলাম। এ অভ্যাসটা হয়েছিল বাবার উৎসাহে। সে ছিল কৃষিবিদ, বেশ কিছু রাসায়নিক সামগ্রী তৈরির ব্যবসাও গড়ে তুলেছিল। ভীষণ সাহিত্যানুরাগীও ছিল। তার বিশাল লাইব্রেরি ছিল আমার জন্য উন্মুক্ত। আমার বারো বছর হতে হতেই র‍্যাবো, পো, বোদলেয়র, আর চৌদ্দ হতে হতে সব ধরনের বই–ই পড়া হয়ে গিয়েছিল। সতেরো হতে হতে এই অর্জনে আমার গর্ব হতে শুরু করল, এ–ও ভাবতে পছন্দ করতাম যে আমি জানি জীবন আসলে কী বস্তু! যদিও সবটাই ছিল বই পড়া জ্ঞান।

আমার শারীরিক গঠন কখনো আহামরি কিছু মনে হয়নি আমার; এটাকে যে কোনো খুঁত ভাবতাম, তা–ও না। কোনো কিছুকেই ভয় পেতাম না; নির্মোহ ছিলাম, যেকোনো কিছু বিচার করে ফেলার প্রবণতা এড়িয়ে চলতাম। কম বয়সের ভ্রান্ত, অনভিজ্ঞ মোহগুলো থেকে চুপচাপ দূরে থাকতাম। এককথায় আমি নিজেকে দেখতাম কম বয়সী মেয়ের ছদ্মবেশে থাকা একজন পাকা দার্শনিক হিসেবে।

বাবা আমার হুঁশ ফেরানোর চেষ্টা থেকে বলত, ‘তুমি তো হাওয়ায় ভাসছ। বরং তুমি কোন সিসা বাঁধানো শুকতলা আছে এমন জুতো পরে মাটিতে নেমে এসো। নয়তো তোমার হুঁশে ফেরাটা সুখকর হবে না।’ সেই হুঁশটা এল, যখন আমি আঁকিয়ে হব বলে মনস্থির করলাম। প্রথমবারের মতো নিজের সীমাবদ্ধতার উপলব্ধি হলো আমার। পড়াশোনায়, এমনকি যে বিষয়গুলোতে আগ্রহ পেতাম না, যেমন গণিত, আইন, সেগুলোতেও যেকোনো সমস্যা সমাধান করে ফেলতে পারতাম। যখন পেইন্টিং করতে গেলাম, যত একাগ্রচিত্তেই মনোনিবেশ করি না কেন, ধীরে ধীরে অনুধাবন করতে থাকলাম, কিছু জিনিস আমি অর্জন করতে পারছি না। সব ধরনের সমস্যা আমার ছিল; ধারণাগত দিক থেকেও, দক্ষতার দিক থেকেও। দীর্ঘ সময় ধরে আমার মনে হতো, একটা দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে আছি আমি। তারপর হঠাৎই একদিন বুঝতে পারলাম, মূলত আমার সমস্যার একটা বড় অংশ আসছে যাপনের অনভিজ্ঞতা থেকে। বহু কিছুর বুদ্ধিবৃত্তিক উপলব্ধি আমার ছিল, কিন্তু সম্যক অভিজ্ঞতার দিক থেকে, আমি ছিলাম প্রায় সম্পূর্ণ অজ্ঞ।

সতেরো বছর বয়সে আমি ছবি আঁকা শুরু করি। আগের দুই বছর রোসদা নামের একজন হাঙ্গেরীয় পেইন্টারের তত্ত্বাবধানে কাজ করেছি। একই সঙ্গে সরবোনে সাহিত্যে সনদপ্রাপ্তির জন্য পড়ছিলাম (মোটাদাগে এটা যেকোনো মার্কিন বা বিলেতি বিশ্ববিদ্যালয়ের কলায় স্নাতকের সমতুল্য)। তা ছাড়া আইন বিষয়ে সনদপ্রাপ্তির জন্যও পড়ছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ে পুরো সময়টা ছবি আঁকায় নিয়োজিত করে ফেলার বিষয়টায় বাবা কখনোই মেনে নিতেন না। কিন্তু আমি সকালের ক্লাসগুলো বাদ দিয়ে রোসদার স্টুডিওতে ছবি আঁকতে চলে যেতাম। রোসদা বুদাপেস্ট থেকে পাঁরি এসেছিল ১৯৩৮ সালের দিকে। মায়ের দিক থেকে সে ইহুদি ছিল। আইন মোতাবেক, ওকে পেশাজীবী হিসেবে ডেভিডের একটা হলুদ তারকা চিহ্ন পরতে হতো। না পরলে চলাফেরায় ও তুলনামূলক বেশি স্বাধীনতা পেত ঠিকই, কিন্তু একটা ভালো রকমের ঝুঁকি থেকেই যেত। তার চেয়ে বড় ব্যাপার হলো, হাঙ্গেরি যেহেতু জার্মানির অধীন ছিল, সেহেতু নাৎসিদের জন্য সামরিক কাজে আত্মনিয়োগ করার বাধ্যবাধকতা রোসদার ওপর বর্তে ছিল। তাই সে শুধু অঘোষিত ইহুদিই ছিল না; ওদের চোখে রোসদা পলাতকও ছিল। রোসদাকে দ্রুত গ্যাস চেম্বারে পাঠানোর জন্য ওদের কাছে কারণের কোনো কমতি ছিল না। প্রতিটা দিনই তাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। আমার বাবা রেগে গেলে লোহার মতো শক্ত মানুষ। কিন্তু যখন চাইত, তখন ভীষণ রকম মহানুভবতার পরিচয়ও দিত। বাবাকে যখন রোসদার পরিস্থিতি বললাম, তখন সে তাকে নিরাপদে বুদাপেস্ট ফিরে যাওয়ার জন্য কাগজপত্র জোগাড়ে সাহায্য করেছিল।

১৯৪৩ সালে যখন ও চলে যাচ্ছিল, আমি গ্যার দ্যু লেস্তে ওকে বিদায় জানিয়েছিলাম। ও চলে যাচ্ছিল বলে আমার খুব মন খারাপ ছিল। ও বেশ ভালো বন্ধু ছিল আমার। এটা ভেবেও খারাপ লাগছিল যে আমার ছবি আঁকার অগ্রগতিও থমকে যাবে। আমি ওকে বললাম, আমি কী করব জানি না, কার সঙ্গে কাজ করব সেও জানি না। ট্রেন ছেড়ে দিল। ও দৌড়ে উঠে যেতে যেতে চেঁচিয়ে বলল, ‘এ নিয়ে ভেবো না। তিন মাসের ভেতর, তুমি হয়তো পিকাসোকে পেতে যাচ্ছ।’ তার কথা প্রায় অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেল।
ছবি আঁকা–সংক্রান্ত ঝামেলাগুলোই আমার একমাত্র হতাশার কারণ ছিল না।

পিকাসোর সঙ্গে দেখা হওয়ার দু–তিন বছর আগ থেকে আমার পুরুষ বন্ধুরা ছিল আমার চেয়ে প্রায় দশ বছরের বড়। তাদের অনেকেই কোনো না কোনোভাবে প্রতিরোধ যুদ্ধে সক্রিয় ছিল। আর আমার মনে হতো ওরা আমাকে শিশু বিবেচনা করছে। সে জন্যই বোধ হয় তারা আমাকে একা ফেলে গিয়েছিল। যদিও ধর্মীয় রূপকথাগুলো আমি কখনো বিশ্বাস করিনি, তবু আমার বোর্ডিং স্কুলের দিনগুলোতে ডমিনিক সিস্টাররা সেগুলোকে আমার কাছে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার যথেষ্ট চেষ্টা করেছে। তা ছাড়া পরিবেশটাই হয়তো এমন ছিল যে নিজের ভেতরে আত্মসচেতনতার চাপে আমি একটা প্রকাশরুদ্ধ অবস্থায় ছিলাম। তাদের এসব লম্বা লম্বা গল্প যে বিশ্বাস করা উচিত, ব্যাপারটা আমি নিজেকে মানাতে পারছিলাম না। তবে এটা ঠিক যে অবিশ্বাস করার ব্যাপারেও আমি শতভাগ নিশ্চিত ছিলাম না।

ফ্রাসোয়া জিলো এবং পেছনে বসা পিকাসো
ফ্রাসোয়া জিলো এবং পেছনে বসা পিকাসো

সতেরো থেকে কুড়ির মধ্যকার বয়সটাতে আমার বয়সী একটা ছেলের সঙ্গে ভীষণ প্রেম ছিল আমার। সেও আমার মতো একই বয়ঃসন্ধিকালীন যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল। প্রতিবার যখন আমি ভাবতাম, আমার উচিত নিজেকে ওর কাছে সমর্পণ করা, ওর সংকোচ হতো। আর যখন ও সাহসী হতো, আমার দ্বিধা হতো। তারপর ও অসুস্থ হয়ে পড়ল। ওর প্লুরিসি হলো। এই সময়টায় আমার মা–বাবা আমাদের বন্ধুত্বটা ভেঙে দিতে চাইলেন। ও যখন সুস্থ হয়ে উঠছিল, আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আমার সতীত্ব নামক বাধাটা উতরাতে হবে। যখন ও ফিরল, আমি বোধ হয় এতটাই উন্মত্ত ছিলাম যে ও ভয় পেয়ে গেল। আমাকে বলল, সে আমাকে সত্যিকার ভালোবাসেনি, আমারও তাকে আমার চিন্তাভাবনা থেকে বাদ দেওয়া উচিত।

আমার সামনে যে পুরো জীবন পড়ে আছে, এই উপলব্ধি না এনে, আমার মনে হচ্ছিল তখন সময় দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে। প্রথম প্রত্যাখ্যানটাকে এতই নাটকীয়তার সঙ্গে নিলাম যে আমার মনে হতে থাকল, সবকিছু বৃথা। রোসদা, আমার শিক্ষক, চলে গেছে। যে ছেলেটাকে আমি চাইতাম, আমাকে সে ছুড়ে ফেলে দিল। আমার আর কিছু হারানোর নেই। ঠিক সেই সময়টাতে আমার পিকাসোর সঙ্গে দেখা হলো। মে আর জুনে আমাদের সংক্ষিপ্ত ঝামেলার পর যখন মিডির উদ্দেশে রওনা করলাম জুনভিয়েভের সঙ্গে গ্রীষ্মের সময়টা কাটানোর জন্য, তখনো আমার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো নিয়ে আমি তাড়িত ছিলাম। আমার চোখে আমার মা–বাবাই ছিল খলচরিত্র। আর আমার বোঝাপড়াটা ছিল, এখন পর্যন্ত ওরা আমার জীবনটা ধ্বংস করে দিয়েছে। এখন থেকে আমার জীবনের দায়িত্ব আমি নিজেই নেব।

প্রথম ধাপ, আমার মনে হলো, বাবার মুখোমুখি হয়ে বলা যে আমি আঁকিয়ে হতে চাই। সেটায় পুরোপুরিভাবে মনোনিবেশ করার জন্য আমার অন্য পড়াশোনা বন্ধ করা দরকার। তিনি কতখানি বদ্ধপরিকর, সেটা আমি জানতাম, অনুভব করতে পারছিলাম এই ঘোষণা দেওয়ার পর খুব সম্ভবত আমাদের মধ্যে একটা বিচ্ছেদ ঘটবে। কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম, বলার পরবর্তী প্রতিক্রিয়াগুলো কাটিয়ে উঠতে পারলে, আমার চাওয়া আর আমার মাঝখানে যে দেয়াল, নিজেকে সেটার ওপারে আবিষ্কার করব।

তখন পর্যন্ত আমার চারপাশে যে পরিবেশ তৈরি করা ছিল, তার ভেতর আমি রেশমগুটি মধ্যে থাকা রেশমপোকার মতো সুরক্ষিত ছিলাম। আমার মনে হতো জীবনের কোলাহল আমাকে স্পর্শ করছে, সে জন্য বাস্তবতার সঙ্গে সব যোগাযোগ বন্ধ করে নিজেকে আলাদা করে ফেলেছিলাম। তবে আমি জানতাম শিল্পীর জীবনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে যে দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয় সেটাকেই তার কাজে ফুটিয়ে তোলে, আর আমাকে রেশমের গুটি ভেঙে বের হয়ে আসতে হবে। আমার মনে হয় এটা বুদ্ধিবৃত্তিক সংকটের চেয়েও বেশি কিছু ছিল। আরেকবার জন্ম নেওয়ার মতো। যেদিন সিদ্ধান্তটা আমি নিয়েই নিলাম, সেদিন নিজেকে জন্মানোর দিনটার মতো দিগম্বর লেগেছিল।

অক্টোবরে আমি বাবাকে একটা চিঠি লিখে এসব কিছু ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি। তার উত্তরে সে আমার মাকে পাঠায় তৎক্ষণাৎ প্যারিস থেকে আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আমার মা, যে কিনা আমারই মতো, সব সময়, সর্বোতভাবে বাবার কর্তৃত্বের ভেতরে থাকা মানুষ। আমরা যখন বাড়ি পৌঁছালাম, বাবা রাগে কাঁপতে কাঁপতে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। বলল আমার আচরণ লজ্জাজনক, আমার নিশ্চয়ই মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আমি যদি একই জেদ ধরে থাকি, তাহলে সে নিশ্চিত হয়ে যাবে যে আমি আসলেই অসুস্থ। আমাকে মানসিক নিরাময় কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেওয়ার হুমকিও দিল। মত পাল্টাটানোর জন্য আধা ঘণ্ট সময় দিয়ে কী একটা করতে বাইরে গেল। আমি জানতাম, আমাকে যা করার দ্রুত করতে হবে। মাকে কিছু না বলে দ্রুত পালিয়ে গেলাম। গেলাম কাছেই, নানীর বাড়িতে। নানী বাড়ি ছিলেন না। তাঁর ফেরার জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার মা আর বাবা এসে উপস্থিত হলো। এর মধ্যে আমার মাও নিশ্চয়ই প্রভাবিত হয়ে নিশ্চিত হয়েছে যে আমি পাগল হয়ে গেছি। এ পর্যন্ত সব সময় আমি বাধ্য মেয়ে ছিলাম, কষ্টকর হলেও ছিলাম। হঠাৎ একুশ বছর বয়সে আমি আমার বাবার মতো অনমনীয় হয়ে গেলাম।

ওদের আসতে দেখে আমি দৌড়ে ওপরতলায় উঠে গেলাম। বাবা যে মেজাজে রয়েছে, নিশ্চিত ছিলাম আমাকে এ বাড়ি থেকে টেনে বের করে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে। দরজা থেকে যত দূরে থাকতে পারি, আমাকে টেনে নিয়ে যাওয়া তত কঠিন হবে ভাবলাম। ওপরতলাতেই উঠে এল বাবা। এত ক্রোধান্বিত আমি তাকে কখনো দেখিনি। সে সব সময়ই উগ্র মেজাজি, বাসায়, পরিবারের অন্য সব সদস্যের মধ্যে, ফ্যাক্টরিতে এমনকি বাইরের জগতেও সবাইকে সব সময় বাধ্যানুগত পেয়ে তার অভ্যাস। জিজ্ঞেস করল আমি বাড়ি ফিরছি কি না। আমি বললাম, না। বললাম আমি ঠিক করেছি যদি সে আমার সঙ্গে একমত না হয়, আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাব। আরও বললাম, আমি তার কাছ থেকে আর কখনো কিছু চাইব না। এখন থেকে আমি আমার জীবন যেভাবে চাই, সেভাবেই কাটাব। আমার কাছে এটাই সিঠক মনে হচ্ছে। বলে দিলাম।

আমাকে মারতে শুরু করল বাবা—মাথায়, কাঁধে, মুখে, পিঠে। সে আমার চেয়ে এত বড় আর শক্তিশালী যে আমি জানতাম এ রকম চলতে থাকলে আমি টিকতে পারব না তার সামনে। সিঁড়িতে বসে পড়লাম, এভাবে থাকায় বাবা আমার মুখে আর আঘাত করতে পারছিল না। আমার মুখ থেকে বিশ্রীভাবে রক্ত পড়ছিল। বুঝতে পারছিলাম, একটা চোখ ফুলে গেছে। সে আমাকে টেনে দূরে সরাতে চাচ্ছিল, আমি শক্ত করে ধরে আছি।

ঠিক এই সময় আমি নিচতলায় সদর দরজা খোলার শব্দ হলো আর আমার নানি ভেতরে ঢুকলেন। যত দ্রুত সম্ভব ওপরে উঠে এলেন। বাবাকে জিজ্ঞেস করলেন কী হচ্ছে এখানে। সে নানিকে জানাল আমি নাকি নিজে নিজেই এ অবস্থা করেছি। আমি ওনাকে বললাম এটা মিথ্যা। আমাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ডাক্তার ডাকলেন নানি। আর বললেন, ‘বাকিটা আমরা কাল দেখব।’

নানির বয়স তখন পঁচাত্তর। আমার দাদার মৃত্যুর চার বছর পর, ওনার একটা নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়। তিন বছর রেস্ট হোমে থেকে তিনি নিজের বাড়িতে ফিরেছেন এক বছর হলো। তিনি নিজেই সচ্ছল, আমার বাবার ওপর নির্ভরশীল নন। তাঁর টাকাপয়সা একজন আইনজীবী দেখভাল করতেন। তিনি আবার আমার বাবার বন্ধু এবং কিছুটা তাঁর কবজায় থাকায় বাবা এ পরিস্থিতিতে নানিকেও হুমকি দিল, ‘দুজনকেই পাগলা গারদে ঢোকানোর ব্যবস্থা করব আমি, তোমরা দুজনই পাগল হয়ে গেছ! এখন থেকে সহজে টাকাটাও পাবে না। তোমরা পছন্দ করো আর না–ই করো!’

নানি সরাসরি তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘তুমি যা পারো করো, যাও। আর আমাদের থেকে দূরে থেকো। আমি দেখতে চাই তুমি কতদূর যেতে পারো। এখন থেকে ফ্রঁসোয়া আমার সঙ্গে থাকবে যদি সে চায়। তা ছাড়া তোমার উপকারেই ও নিজেই মানসিক চিকিৎসা নেবে।’

লাইফ উইথ পিকাসো
লাইফ উইথ পিকাসো

ফরাসি আইন অনুযায়ী কাউকে কোনো মানসিক চিকিৎসালয়ে পাঠানোর আগে দুজন আলাদা মনরোগ বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে মানসিক ভারসাম্যহীনতার রায় নিতে হয়। প্রথম যে ভদ্রলোকের কাছে বাবা আমাকে পরীক্ষা করালেন, তিনি আমার বিপাক ক্রিয়া স্বাভাবিকের চেয়ে ৩০ শতাংশ কম, এর বাইরে আর কিছুই পেলেন না। উপসংহার দাঁড়াল যে আমি খুবই ক্লান্ত, অবসন্ন। এই ব্যর্থতার পর বাবা একজন নারী মনোরোগ বিশেষজ্ঞ খুঁজে বের করলেন। জানি না, আমি যে পাগল, বাবার এই গল্পে প্রভাবিত হয়ে, নাকি নির্দেশনাই এমন ছিল যে, দুই ঘণ্টা ধরে তিনি আমাকে প্রশ্ন করে গেলেন, বক্তৃতা দিলেন, হুমকি দিলেন। তাতেও কোনো কাজ হলো না। আরও কতগুলো পর্ব পার করতে হলো, এর ভেতর বাবার চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গেও বৈঠক ছিল। প্রতিটা বৈঠকে আমি অধিকতর শান্ত থাকলাম এবং আমার মাটি আরও শক্ত হতে থাকল। অবশেষে এই কঠোর পরীক্ষার সমাপ্তি ঘটল।

আমি নানির সঙ্গে থাকতে গিয়ে অর্থসংকটে পড়ে গেলাম। আগে বাবাই সব সময় আমার অর্থের জোগানদাতা ছিল। একটিমাত্র পোশাক পরে আমি নানির বাড়ি পালিয়ে এসেছিলাম। আর কিছুই নিয়ে আসা সম্ভব হয়নি।

আমি অনেক ঘোড়া চালিয়েছি। আমি আমার পুরোনো বুড়ো ঘোড়সওয়ার মাস্টারের কাছে গেলাম দেখা করতে, বললাম যে আমার একটা কাজ দরকার। তিনি আমাকে নতুনদের ঘোড়া চালনা শেখানোর একটা কাজ দিলেন। মাঝেমধ্যে আমাকে প্যারিস থেকে বারো মাইল দূরে মেঁজো-লাফিত নামে একটা রেসিং রাইডিং সেন্টারে যেতে হতো। আমি বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।

নভেম্বরের আগে পিকাসোর সঙ্গে দেখা হওয়ার একটা সুযোগ এল। একটা জিনিস খুব পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম, পিকাসোর সঙ্গে আমি স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগাযোগ করতে পারি। ওদিকে বাবার সঙ্গে অনেক বছর কোনো যোগাযোগ নেই। এমনকি আমার বয়সী যে ছেলেটাকে আমি ভাবতাম আমি ভালোবাসি, তার ব্যাপারটাও ঝামেলাপূর্ণ আর জটিল হয়ে গেছে। পিকাসোর ক্ষেত্রে, আমার তিন গুণ বয়সী হওয়ার পরও তাঁর সঙ্গে আমার বোঝাপড়ার একটা আরাম ছিল, তাঁর সঙ্গে আমি যেকোনো কিছু নিয়ে কথা বলতে পারতাম। এটা ছিল বিস্ময়কর।

চার পাঁচ মাসের বিরতির পর আমার গ্রীষ্মের অভিজ্ঞতার পর মনে হচ্ছিল আমার এমন এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হচ্ছে, যার স্বভাব আমার থেকে খুব বেশি আলাদা নয়। বয়ঃসন্ধির সময়টায় প্রায়ই আমার মনে হতো, একজন নিঃসঙ্গ অভিযাত্রী মরুভূমি পার হচ্ছে। বুদ্ধিবৃত্তিক গর্ব থাকা সত্ত্বেও সামাজিকভাবে আমি ছিলাম ভিতু, বন্ধুদের মাঝেও প্রায়ই চুপ করে থাকতাম। তত্ত্বগতভাবে দেখলে পিকাসো আর আমার মধ্যে কোনো মিল ছিল না, কিন্তু বাস্তবে আমাদের বেশ ভালো কিছু মিলই ছিল। একদিন সকালে আমি ঈষৎ রক্তিম চেহারায় তাঁকে সোজাসুজি বললাম, তাঁর সঙ্গে আমি কতটা স্বচ্ছন্দ, এটা শুনে তিনি আমার দুই বাহু উত্তেজনায় আঁকড়ে ধরে বললেন, ‘আমারও একদম এ রকম লাগে। যখন আমার বয়স কম ছিল। তোমার চেয়েও কম, কিংবা তারও আগে। আমি এমন কাউকে পাইনি, যাকে আমার মতো মনে হতো। আমার মনে হয়েছে আমি সম্পূর্ণ একাকী জীবন কাটাচ্ছি, আমি কী ভাবছি, তা নিয়েও কখনো কারও সঙ্গে কথা বলিনি। সম্পূর্ণভাবে আমার আঁকাআঁকি নিয়ে ছিলাম। তারপর চলতে চলতে কিছু মানুষের সঙ্গে পরিচয় হলো, যাদের সঙ্গে অল্প কিছু কথাবার্তা ভাব বিনিময় হতে লাগল। কিন্তু তোমার সঙ্গে আমার একদম এ রকম একটা অনুভূতি হলো, একই ভাষায় কথা বলার মতো এই অনুভূতি। একদম প্রথম থেকে আমি জানতাম যে তোমার সঙ্গে আমি যোগাযোগ করতে পারব।’

আমি তাকে বললাম, ছুটির আগে এত ঘন ঘন তাকে দেখতে আসায় আমার অপরাধবোধ হচ্ছিল। তাই এত ঘন ঘন এসে তাঁকে বিরক্ত করতে চাই না।

তিনি বললেন, ‘এসো, এই ব্যাপারটায় একে অন্যকে এখনই বুঝে নিই। যেকোনোভাবেই, তুমি আসো আর না–ই আসো, আমি বিরক্ত হই কাউকে না কাউকে দিয়ে। যখন আমার বয়স কম ছিল, আমাকে কেউ চিনত না, বিরক্তও করত না। আমি সারা দিন কাজ করতে পারতাম। হয়তো তখন যদি তুমি আসতে, একটা কথা না বললেও হয়তো আমি বিরক্ত হতাম। এখন কিন্তু অনেক মানুষ আছে, যারা আমাকে বিরক্তও করে, কাজেই তুমি না হও, তাহলে অন্য কেউ করবে। আর খোলাখুলিভাবে বলতে গেলে’—এ পর্যায়ে তার গম্ভীর মুখে হাসির রেখা দেখা গেল, ‘অন্য লোকেরা আমাকে তোমার চেয়ে বেশি বিরক্ত করে।’

সুতরাং যে সকালগুলোতে আমার কোনো রাইডিংয়ের প্রশিক্ষণ থাকত না—সপ্তাহে দুই বা তিন দিন—আমি রু দে গ্রাদ-অগিস্তাতে কাটাতাম। প্রচুর তারপর মধ্যাহ্নভোজের সময়ে হলে যার যার পথে চলে যেত। বুঝতাম এই লোকগগুলো কোনো না কোনোভাবে পিকাসোর জীবনের সঙ্গে যুক্ত। যেমন, কাইয়ে’দার প্রকাশক ক্রিস্টিয়ান জেরভোস পিকাসোর কাজ নিয়ে একটি ক্যাটালগ করছিলেন এবং প্রায়ই তাঁর ফটোগ্রাফারকে নিয়ে নতুন করা ড্রয়িং, পেইন্টিংগুলোর ছবি তুলতে আসতেন।

জঁ পল সার্ত্র, সিমোন দ্য বুভোয়া এবং কবি পিয়েরে র‍্যভিয়েদি প্রায়ই আসতেন। সার্ত্র এবং সিমোন দ্য বুভোয়া নিজেদের মধ্যেই কথাবার্তা বলতেন বেশির ভাগ সময়। সাত্রে যখন পিকাসোর সঙ্গে কথা বলতেন, একটা কোণে গিয়ে কথা বলতেন। তাঁকে এতটা রহস্যময় দেখাত আর গোপনীয় মনে হতো যে আমি অনুভব করতাম, তিনি অবশ্যই প্রতিরোধ যুদ্ধ নিয়ে আর এর গোপনীয় কিছু প্রকাশনা নিয়ে কথা বলছেন।

সেবার শীতেই, এক সকালে, আমি রু দে গ্রাদ-অগিস্তাতে গিয়েছিলাম আমার সদ্য শেষ করা বেশ কয়েকটি পেইন্টিং নিয়ে, পিকাসোকে দেখাতে চাচ্ছিলাম। আমাকে একজনকে দিয়ে খবর পাঠালেন, ‘উনি বলেছেন, আপনাকে ওপরে নিয়ে আসতে। উনি কিন্তু আজ অন্য কারও সঙ্গে দেখা করছেন না। এবং তুমি এমন কাউকে দেখতে যাচ্ছ যে চমকে যাবে।’

যখন আমরা পেইন্টিং স্টুডিওতে ঢুকলাম, দেখতে পেলাম পিকাসো একটি ক্ষীণকায়, কৃষ্ণবর্ণের, তীব্র চেহারার ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলছেন। আমাকে স্বীকার করতেই হবে যে তাঁকে দেখে আমি ধাক্কা খেয়েছি। এটা ছিল অদ্রে মালরো। সেই সময়ের অন্য যে কারও চেয়ে, মালরো ছিলেন আমাদের প্রজন্মের আদর্শ। আমরা তাঁর বইগুলো গোগ্রাসে গিলতাম—‘দ্য কনকোয়ারার্স’, ‘ম্যান’স ফেট’, ‘ম্যান’স হোপ’।

পিকাসো আমাকে মালরোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন এবং আমার ছবিগুলো দেখাতে বললেন। খুব ভয়ে ভয়ে ছবি দেখালাম। একটা ছবি দেখিয়ে বললাম, এটা গত গ্রীষ্মে লো বো সফরের স্মৃতি থেকে করেছি। আমার এ কথা পিকাসোকে মনে করিয়ে দিল যে প্রায় পাঁচ বছর আগে ক্রিসমাসের দিনে মালরো আর তাঁর দেখা হয়েছিল। পিকাসো বলেছিলেন, ‘সেখানে ভ্যাল দোফের নিচের দিকে তাকালে এমন একটা অপার্থিব পরিবেশ অনুভব করা যায়, যা আমাকে দান্তের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল।’

‘সেটাই হওয়া উচিত’, মালরো জবাব দিলেন। ফ্লোরেন্স থেকে নির্বাসনের সময় দান্তে ফ্রান্সের ভেতর দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে সেখানে গিয়েছিলেন এবং সেই পরিবেশটার কথাই লিখেছিলেন ‘লি’ইনফ্যাগনো’–তে।

মালরো চলে যাওয়ার পর পিকাসো বললেন, ‘আশা করছি, এইমাত্র যে উপহারটা তুমি পেলে, সেটা তোমার পছন্দ হয়েছে।’ আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম কোন উপহার? ‘তোমাকে মালরোর সঙ্গে কথা বলতে দেওয়াটা।’ সে বলল। বড় ব্যাপার হলো, এখানে তাঁকে কারও দেখাটা উচিত হয়নি। এটা খুব বিপজ্জনক। তিনি সবেমাত্র মাকি থেকে পালিয়েছেন। আমি বললাম, আমি জানি না আমি এর জন্য কৃতজ্ঞ কি না। ততক্ষণ পর্যন্ত আমি রোমান্টিক কিংবদন্তিতে খুশি ছিলাম। কিন্তু এই প্রথম তাকে দেখে, তার ঘাবড়ানো মুষড়ে পড়া মুখ দেখে, আমার আশাভঙ্গ হয়েছে।

‘সকালে কেউ যদি আমার সঙ্গে দেখা করতে না আসত, তাহলে বিকেলে কাজ শুরু করার জন্য আমার কিছু থাকত না।’ পরে আমাকে বলেছিল পিকাসো। ‘এমনকি যা ঘটছে, সেগুলোর সঙ্গে প্রত্যক্ষ কোনো যোগাযোগ যদি নাও থেকে থাকে আমার কাজের, তবু এই যোগাযোগগুলো আমার ব্যাটারি রিচার্জ করার উপায়। এটা দেশলাইয়ের স্ফুলিঙ্গের মতো। আমার পুরো দিনকে আলোকিত করে রাখে।

কিন্তু অবশ্যই পিকাসোর সব দর্শনার্থীরই প্রবেশাধিকার ছিল না। জার্মানরা যে কাউকে তার চিত্রকর্ম প্রদর্শন করতে বারণ করেছিল। তাদের চোখে সে ছিল একজন ‘অধঃপতিত’ শিল্পী আর ফ্রাঙ্কো সরকারের শত্রু। আরও ঝামেলা করার জন্য তারা সব সময় ছুতো খুঁজছিল। প্রতি এক–দুই সপ্তাহে একদল পোশাকধারী জার্মান আসত আর একটা বাজে পরিবেশ তৈরি করে জিজ্ঞেস করত, ‘এখানেই তো মসিয়ঁ লিপশিৎজ থাকে তাই না?’

‘না’ পিকাসোর সেক্রেটারি সেবাখতি বলত ‘ইনি মসিয়ঁ পিকাসো!’
‘ওহ আচ্ছা, আমরা জানি যে এটা মসিয়ঁ লিপশিৎজের অ্যাপার্টমেন্ট।’
‘কিন্তু না,’ সেবাখতি বোঝানোর চেষ্টা করত, ‘ইনি মসিয়ঁ পিকাসো।’
‘মসিয়ঁ পিকাসো কোনোভাবেই ইহুদি না তো, তাই না?’

‘অবশ্যই না’, সেবাখতি বলল। কিন্তু ওরা আসতেই থাকল, আর বলতেই থাকল তারা ভাস্কর লিপশিৎজকে খুঁজছে। তারা খুব ভালো করেই জানত যে ভাস্কর লিপশিৎজ তখন আমেরিকায় আর তার চেয়েও বড় কথা হলো, সে এখানে কখনোই থাকেনি। কিন্তু তারা ভাব করত এমন যে তাদের নিশ্চিত হতে হবে সে এখানে নেই। বলত, ‘আমরা নিশ্চিত হতে চাই। আমরা ভেতরে আসছি কাগজপত্রের খোঁজে।’ তাদের তিন–চারজন ভেতরে ঢুকত ফরাসিভাষী একজন অত্যধিক বিনয়ী অফিসারসহ। এলোমেলো সবকিছু যেন তাদের জন্য আমন্ত্রণ ছিল, তারা সবকিছুর চারপাশে, পেছনে খুঁজে দেখত।

যুদ্ধের সময় এখানে থাকাটা তাঁর জন্য বিরাট সাহসের ব্যাপার ছিল, যেহেতু হিটলার তাঁর চিত্রকর্মগুলোর সমালোচনা করেছিল এবং কর্তৃপক্ষ বুদ্ধিজীবীদের ব্যাপারে এ রকম একটা আবছা মনোভাব পোষণ করছিল। অনেক শিল্পী আর লেখক জার্মানরা আসার আগেই আমেরিকায় চলে গিয়েছিল। একদিন আমি পিকাসোকে জিজ্ঞাসা করলাম, কেন তিনি যাননি।

‘আমি ঝুঁকি খুঁজে বেড়াচ্ছি, ব্যাপারটা এমন না,’ তিনি বলেছিলেন, ‘আবার পরোক্ষভাবে জোর করা বা ভয় দেখানোকেও যে আমি আমলে নিই, তা না। আমি এখানে থাকতে চাই কারণ আমি এখন এখানে আছি। একমাত্র যা আমাকে এখান থেকে নিয়ে যেতে পারে, তা হলো এই জায়গাটা ছেড়ে যাওয়ার ইচ্ছা। থাকাটা সাহস দেখানোর জন্য না; এটা একধরনের নির্লিপ্ততা। এটা একেবারেই এ রকম যে আমি এখানে থাকতে পছন্দ করি, তাই আমি এখানে থাকব, যেকোনো মূল্যেই থাকব।’