ছিন্ন খঞ্জনা

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

১.

‘সাক্ষী সাক্ষী মিলে গেল, যে বাকি সে হয় চোর!’ অনেকগুলো মেয়েশিশু ঝংকার দিয়ে উঠল আর হাত ওল্টালো। সাথে সাথে ঘুম ভেঙে গেল আমার। সকালের আলো-ভরা ঘর। খাটের পাশে খাটো টেবিলে অ্যালার্ম ঘড়িটা ওত পেতে আছে আর মাত্র পনেরো মিনিট পরেই আমাকে জাগাবে বলে। আমার ঘাড়-গলা-বুক ঘামে ভিজে টসটস করছে, এই এক অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে আজকাল, রাতের কোনো এক প্রহরে শব্দহীন হুইসেলের মতো কী যেন বেজে ওঠে, আর আমার শরীর ঘামে ভিজে যায়, মনসুরকে বললেই ও ফাজলামি করবে, বলবে, এর নাম ‘মেন-ওহ-পজ’ নাজলি ম্যাডাম, এইবার পজ নেওয়ার সময় এসে গেল। কিসের পজ? কিসের বিরতি? যদি বিরতিই হয়, আমি তো বহুদিন যাবৎ বিরত। বিরতিহীন অবিশ্রান্ত যা বয়ে চলেছে, তা আমার জীবন, মনসুর আর আমাকে নিয়ে, আমার গান আর মনসুরের কাজ নিয়ে, মনসুর আর আমার চারটি জীবিত ও মৃত সন্তানকে নিয়ে, ঝরঝর বেগে যা বয়ে চলেছে, যে বহমানতা সাংঘাতিক বেগে আমাকে বয়ে এনেছে এই আলোয় ভরা সকালটাতে, পরিপূর্ণ সেই স্রোত, একটি উচ্ছল যাত্রা। আমার বড় মেয়ে রুবাঈ টিউটরের কাছে যখন জিওগ্রাফি পড়ে, তখন কান খাড়া করে শুনি, ওর বইয়ে লেখা আছে—কেমন করে মরুভূমিতে বয়ে যায় সহসা কাদার বন্যা, কেমন করে হিমবাহ তার তলানিতে সবকিছু নিপিষ্ট করে সমান করে বয়ে যায়...তেমন একটা কিছুই যেন আমার এই জীবনটি। যেটুকু ক্ষয় আছে, সেটা অন্তরালে আছে, সেটা সবকিছুকে সমতল করছে, বয়ে যেতে দিচ্ছে।

সকালে উঠে আমি আদরের হাতে বিছানা-বালিশ সমান করি, নিভাঁজ করি। প্রাণায়ম করি। একটি সার্থক জীবন দেওয়ার জন্য যাঁদেরকে প্রণতি জানাতে হয়, তাঁদেরকে তাই জানাই, তারপর চপ্পলে পা গলানোর মতো করেই জীবনে প্রবেশ করি। আমার মেয়ে রুবাঈ আর ছেলে সনেট সেকেন্ডারি স্কুলে পড়ে, ওদের জীবন এখনই একটা আকার পেয়ে গেছে। নিজেরাই স্কুলে চলে যায়। স্কুলেই ওরা লাঞ্চ করে। ফিরে এসেও ওরা যার যার ঘরে ঢুকে পড়ে। আমার ছোট মেয়ের নাম শোলক, সে পরিকল্পনায় ছিল না, এমনি এসেছে, আমরা তাকে ভেসে যেতে দিইনি। সে এখনো প্রাইমারিতে যায়, মনসুর মাঝেমাঝে বলে, ‘এবার একটা হাইকু হবে নাকি?’ 

২.
আজকেও কারা হৈ হৈ করে উঠল ‘রাজার খবর এসেছে-এ-এ’, আর আমার ঘুম ভেঙে গেল ঘামতে ঘামতে। এই যে আজ সকালের আলোয় ভেসে যাওয়া ডাইনিং স্পেসের দেয়ালের আয়না, আয়নাতে যে গরবিণী মুখ, সেটা আমার। আমি নাজলি। রূপবতী, গুণবতী বলে আমার খুব সুনাম ছিল কয়েক দশক আগে, সে সময় বাপ–মায়ের আদরিণী অবরোধবাসিনী কন্যা বলে দুর্নামও ছিল, খুব শাসনের কড়াকড়ি ছিল বাড়িতে। আমি কোনো কিছু নিয়ে দুঃখ করি না, অন্তরের পরিতাপ নাকি গায়ের রং ময়লা করে দেয়। মনেরও। আয়নায় যাকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, সে অমলিন। আয়নাটাও ধোয়ামোছা, এতটুকু মালিন্য নেই। মনসুরের যা যেমন থাকা চাই, তা তেমনই থাকা চাই, ঘরদোর ফিটফাট, বউ সুন্দরী, সন্তানরা স্বাস্থ্যবান, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট স্ফীত। আমিও তেমনটাই হয়ে গেছি, মানে যেমন হওয়া চাই, তেমন তেমন।
বন্ধুরা আমাকে ডাকে ‘কফিহাউসের সুজাতা’। আমার বাড়িটা একটা কাচের স্ফটিকের মতো চকচকে। সোফাগুলো ব্রাউন। জুনিপাড়–রঙা দেয়াল। কার্পেট বেইজ। মেঝের টালি ধূসর ঘুঘুপাখির মতো রং। রান্নাঘর আইভরি হোয়াইট। যেমনটা যা হওয়া উচিত। মনসুর পছন্দ করেছে সব রং, এগুলোকে বলে ‘নিউট্রাল কালার’, পটভূমি এমন হওয়া চাই যেন আমাদের পোশাক বাঙ্‌ময় হয়ে ওঠে সেখানে, ফোকাস আমরাই, এই সবই বলতো আর্কিটেক্টের কাছে শুনে শুনে।
আমার গলা-সাধার ঘরটা কাচের, ছাদটাও স্বচ্ছ। আকাশের আলো আভা হয়ে ঢোকে সেখানে। ঘরটায় ঢুকবার আগে বাইরের দেয়ালে আমার সংসারের মানুষদের ঝলমলে ছবি। জন্মদিন, বিয়ে, অ্যানিভার্সারি। কিন্তু ঘরটার ভেতরে একটা চওড়া ফ্রেমে গুরুজির ছবি শুধু, পণ্ডিত মানসকমল দত্ত। তাঁর মুখে যে জ্যোতি, রূপে যে মহিমা, তা শুধু শুদ্ধ অন্তরের মানুষেরই থাকে। ওই ছবির পাশে কি আর কিছু মানায়? এই ঘরে ঢুকলেই গার্ডেনের গাছগাছালিতে আড়াল হয়ে থাকা পাখির কাকলি শোনা যায়। যেদিন বৃষ্টি হয়, সেদিন এই ঘরের ছাদে বহুদূরবর্তী অনেক মানুষের হাততালির মতো শব্দ শোনা যায়। এই যে প্রকৃতির সাথে একটা স্বচ্ছ আড়াল, আধখোলা ঘোমটার মতো, এ জন্যই ঘরটা সকালে আমার এত প্রিয়। কতসব ভাবালুতায় ভরে যাচ্ছে আমার সকাল, রেওয়াজ করব কখন?
৩.
আজ আবার অনেকগুলো মেয়েশিশু ঝংকার দিয়ে উঠল, ‘নোনতা বলো রে, চার হলো রে’, সূর্য ওঠার আগেই জাগিয়ে দিল আমাকে। দেখলাম, ভোররাতে অজানা নম্বর থেকে ফোন দিয়েছে কেউ। বাংলাদেশের নম্বর। মনসুরকে বিদায় করলাম, বাচ্চারাও বের হলো। এক ঘণ্টা পর ছাত্রীরা আসা শুরু করবে।
রেওয়াজে বসলেই আমার চোখের সামনে থেকে সময়ের ঘেরাটোপ তুলে নেয় কেউ, আমি দেখতে পাই হারমোনিয়াম বাজিয়ে ছোট্ট নাজলি গাইছে—‘বিনতি মানো পিয়া মোরি, সওতন ঘর না যাও।’ অত মিনতি, প্রিয়বিচ্ছেদের অত যাতনা কি আর বোঝে সে? গুরুজি সমানে হাঁক পাড়ছেন, ‘নাজলি, গলার মুরকি নয়, দর্দ আনতে হবে, গলায় না বুকে। নির্জলা বেদনা। উঁহু পানি মেশাবে না। পানি আসবে শ্রোতার দিক থেকে, অশ্রুর বান!’ নাজলি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে, গুরুজি বলেন কী! বেদনা কোথায় পাবে সে? তার বড় ভাই মাসুদ করিম। গুরুজি চলে গেলে সে বলত, ‘নাজলি, সুরটারে গামছা দিয়া বাইন্ধা দিবি মোচড়, ভিজা গামছা বাইয়া টপটপ কইরা পানি পড়বো! এইই কইতে চায় মানস স্যারে।’ গুরুর নাম শুনেই তো নাজলি নিজের কানের লতি পাকড়াচ্ছে, আর হেসে গড়িয়ে পড়ছে বড় ভাই, কী যে বোনপাগল ভাই তার। তাদের বাড়িতে কেউ কাব্য বোঝে না, কেউ সুরেলা নয়, সব জমা আর খরচা। বড় ভাই আদর করে নাজলিকে ডাকে ‘সরস্বতী’।
কিন্তু কেন আমি খেলার শব্দ শুনতে পাই বারবার? কারা খেলছে? তাদের সাথে আমার কী যোগ? আমি তো কখনো এই সব মেয়ের সাথে মিশে খেলতাম না। তেমন খেলাধুলার সুযোগ না পাওয়া একটি হারানো শৈশবের কথা মনে করে আমার হঠাৎ খুব কান্না পেল। আমার এই লাক্স সাবানমাখা নায়িকাদের দাঁড়িয়ে থাকবার মতো সফেদ রান্নাঘরে অত কান্নার সংস্থান হবে কি? আমাদের পেছনের বারান্দার কাঠের উঁচু বেড়া কাঁপিয়ে রেলপথ দিয়ে রেলগাড়ি চলে গেল। আঙিনায় শোলকের পরিত্যক্ত খেলনার ভেতরে একটা কাঠবিড়ালি ঢুকেছিল, সে সেই শব্দে পালিয়ে গেল।
ছাত্রীরা এসেছে, গাইছে ‘চান্দ সোয়ে সোয়ে রে, নিঁদ গয়ি গয়ি রে, পিয়া গয়া নহি আয়ে রে, পাপিহা রোঁয়ে রুলায়ে রে’ লাইনগুলো স্বপ্নে শোনা মেয়েদের ‘নোনতা বলো রে’ খেলার আওয়াজের মতো শোনাচ্ছে।
৪.
আজ আমি একেবারে হাতেনাতে ধরে ফেলব দুঃস্বপ্নকে, এমন ভেবে ভোররাতে জেগে গেছি, বাংলাদেশ থেকে সেই ফোনটা এলো তখনই। আমি কোনোমতে কাটিয়ে দিলাম এই বলে যে পরে ফোন করছি। মনসুরের ঘুম খুব পাতলা। পরে মনসুর যাওয়ার পরে আমি নিজেই ফোন দিলাম।
অনেক দিন পরে সুরেফা বেগমের গলার আওয়াজ পেলাম, চিনলাম কী করে? কী করে কুশল বিনিময় করলাম? কী করে একে একে বদরু জাহান, হুরায়রা জাহান, ছায়মা জাহান—এই তিন মেয়ের খবর নিলাম, কী করে জানতে চাইলাম—আমি ওর জন্য কিছু করতে পারি কি না? আয়না-ধাঁধানো আলো এসেছে জানালা দিয়ে। বদরু-হুরায়রা-ছায়মা সবাই মিলে এখন একই বাড়িতে থাকে। সুরেফা বেগম ফোন রাখার আগে কেঁদে ফেললেন, বললেন, ‘মাগো, তোমারে আমি মাঝে মাঝে ফোন করতে পারি?’ আমি একটা সদয় জবাবই দিচ্ছিলাম, কিন্তু উনি জবাবের অপেক্ষা না করেই বললেন, ‘তোমার কি আমার কায়েসের কথা মনে পড়ে?’
আমার মনে আছে, কায়েস জাপান থেকে নিভিয়া ক্রিম পাঠালো, সেটাতে অ্যালকহল থাকতে পারে জেনে সুরেফা বেগম নীল চাকতির মতো কৌটোটা ফেলে দিলেন। এই আলোয় ভিজিয়ে দেওয়া সহসা নীল আকাশ জানে নাইটিঙ্গেলের বুকে আমূল বিঁধে থাকা গোলাপকাঁটার কথা, কিন্তু ব্যথা হলো না তো আমার। একটা রাগ। যেন হারমোনিয়মে ‘নি’ টিপে রেখেছে কেউ, আর আঙুল সরাচ্ছে না।
৫.
রোগা, কালো, সরু গোঁফ। লম্বাও নয় তেমন। এত শীর্ণ মুখ, তাতে বসানো চোখের মণিটাও যেন রোগা রোগা। মাথায় চুলগুলো চকচকে কেন, ও কি তেল মাথায় দিয়ে দেখা করতে এসেছে? চুলগুলো কেমন খাড়া খাড়া, শজারু যেন। প্রথম দেখায় চমকে উঠেছিল নাজলি। ফোনের কণ্ঠটায় যে কল্পিত রূপ যে পৌরুষ সে বসিয়েছিল, এ তো সে নয়। মোক্ষম সময়ে পূর্ণেন্দু পত্রীর ‘ভিখিরিদের কি ডাকাত হতে ইচ্ছে করবে না কোনো দিনও’ শুনিয়েছিল যে এ যেন সে নয়। আনন্দশংকরের ‘মিসিং ইউ’ শুনিয়ে কাঁদিয়েছিল যে সে যেন এ নয়। টেলিফোনের তারবাহিত হয়ে যেন আর কোনো বিদ্যুচ্চুম্বকীয় মানুষের কাছে পৌঁছাত সে। এ নয়। উহু।
দুই বছর ধরে তারা শুধুই কথা বলেছে ফোনে, কেমন করে সে নাজলির নম্বর পেয়েছে কখনো বলেনি। লোকটা টেলিফোনে বরাবর তার নাম বলেছে ‘আকাশ’। অথচ তার নাম কায়েস। বিবির বাগিচায় তাদের বাড়ির নাম মাতৃকুটীর, পাইকারি মাছবাজারের গন্ধ-ভরা আর সেলাইকলের শব্দ-ভরা ঘর, উঠানে রান্নাঘর, শেয়ারের টয়লেট। পলওয়েল মার্কেটে বাপের লেসফিতার দোকান। তিন বিবাহযোগ্যা বোন। দুটি বেকার ভাই হাফেজুল্লা আর রফিকুল্লা। প্রথম দেখায় সে নাজলির হাতটা নিজের হাতে তুলে নিয়ে বলে, ‘এই হাত ধরলাম, আর কিন্তু কখনো ছাড়ব না। চিরকাল ধরে রাখব।’ ‘চিরকাল’ শব্দটা শুনে নাজলির মন কেমন না-না করে ওঠে, লোকটার উচ্চারণেও কেমন ভাত-ভাত গন্ধ। লাজুক নয়, হীনম্মন্য। কিন্তু কায়েসের এত দিনের পরিচিত গলার আওয়াজ কানে ঢোকে তার, সেই গলার আওয়াজে পরিচিত হাসির আমেজ মাখা। আস্তে আস্তে এই রোগা কালো বিমর্ষ চেহারায় সামান্য বসন্তের গর্তসহই একটা জ্যামিতি ফুটে ওঠে, চৌকো চোয়ালে, চতুষ্কোণ কপালে। সে কায়েসকে বাধা দেয় না তো।
ওই বাড়িটায় সে যেতে থাকে, নিয়মিত। সমাজের দুই মেরুতে তাদের বাস, যেন দুই গোলার্ধের মতো আলাদা। একটি হাসিখুশি, সম্ভাবনায় ঠাসা; আরেকটি কালো বিমর্ষ রোগা। কিন্তু ষোলো বছর বয়স মাছবাজার-সুতিখাল-সেলাইকল-কাঁচা পায়খানা—এসবের দিকে কবেই বা তাকায়। হাফেজুল্লা নাজলির খাতায় বসে বসে মলাট দেয়, রফিকুল্লা চটপটে চতুর—সে বায়না করে। বদরুরা তাকে ‘ভাবি’ই ডাকে। তাদের ভাইজান ডাকে ‘বউ’। কায়েসের বন্ধু মোফাজ্জলের দোকান থেকে সে ফোন করত, সেই দোকান নাজলিকে দেখিয়ে দেয় সে, নাজলি অবাক হয়ে ভাবে, কই, সে তো টের পায়নি কখনো যে এই লোকটা নিজের বাসা থেকে ফোন দিত না।
ষোলোতে তো বয়স থামে না, বয়স বাড়ে। কায়েসের ম্রিয়মাণ মুখে স্থায়ী বিষাদের ছায়া আরও বাড়ে। দুজনে মিলে সলা করে কী করে তারা একহতে পারে। কায়েস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়েছে দুবছর হয়, চাকরির দেখা নেই। জাপানি শিখছে সে, জাপান যাবে। একটা গতি হবে ভেবে নাজলিও রাজি হয়ে যায়। কিন্তু কায়েস শর্ত দেয়, সে এমনি যাবে না, বিয়ে হোক তাদের। কাগজের বিয়ে করে কায়েস সত্যি একদিন জাপান চলে যায়। বলে, ‘তোমার হাতে আমার ভাইবোনদের দিয়ে গেলাম।’ দায়িত্ব নেওয়ার বয়েস নয় বলেই যেন নাজলি মনে ভাবে দায়িত্বটা তার। রফিকুল্লাকে বাড়ি গিয়ে পড়ায়, হাতখরচের টাকা থেকে বদরু জাহানদের জামা কিনে দেয়। এরপর একদিন হঠাৎ করে কাউকে কিছু না বলে ফিরে আসে কায়েস, সে বাইরে থাকবে না। কালো গোলার্ধ আর হাসি-ঠাসা গোলার্ধে ঠোকাঠুকি শুরু হয়।
৬.
এক শ বছর আগের সেদিনটায় আমাকে সবাই ঘুরে ঘুরে দেখছিল, নবীনবরণের অনুষ্ঠানে আমি গাইলাম ‘বুলবুলি নীরব নার্গিস বনে’। আমার স্পষ্ট মনে আছে, বুটিদার ব্লাউজ, মেরুন জরি জামদানি আর খোঁপাবোঝাই কাশীগাঁদা, পায়ে ভেলভেটের চটি। বন্ধুরা সবাই খুব তারিফ করছিল, কেন যেন আমারও মনে হচ্ছিল, আমার এই আনন্দরূপ থেকে রশ্মি ফুটে বের হচ্ছে, একেবারে রক্তিম। কিন্তু সে কেন আমাকে দেখে অত খেপে গেল, কেন আমার হাত ধরে বলল, ‘চলো চলো, এভাবে আর মেলাবার চেষ্টা করতে হবে না। আমরা বিয়ে করেছি, আজকে থেকেই আমরা এক সাথে থাকব।’ ওর মুখ কালো থমথমে, হাতের বাঁধন শক্ত, আমি যেন একটা দুষ্পাচ্য মেরুন খাবারের মতো ওর পাকস্থলী দিয়ে উলটো পথে বের হয়ে এসেছি। কিন্তু অনুষ্ঠান ছেড়ে কী করে যাই আমি! কত দিন ধরে আমিই না কত প্ল্যান করেছি ডিপার্টমেন্টের নবীনবরণ নিয়ে, আমাকে ঘিরেই পৃথিবী ঘুরছে আজ। অনুনয় করে বললাম, ‘তুমি আমার কথাটা রাখো, আমি শেষ করে বাসায় গিয়ে সার্টিফিকেট-টিকেট সব গুছিয়ে আসছি।’ ওই রকম কালো করে তাকিয়ে থাকল সে। আমি ফিরে গেলাম অনুষ্ঠানে।
বাড়ি ফিরতে সেদিন এত দেরি হলো! ভীষণ ক্লান্ত। ভাবলাম, আজ আর যাব না, কাল কায়েসের কাছে চলে গেলে কী এমন দেরি হবে! ফিরে দেখি বড় ভাই তৈরি হয়ে বসে আছে, সিনেমা দেখবে আমাকে নিয়ে। আমি নিজের রুমে ঢুকছি, বড় ভাই ঢুকতেই দিল না, সে আজ সারা দিন খুঁটিয়ে শুনে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে মান্না দের কফি হাউসের আড্ডায় ‘মইদুল ঢাকাতে’ ছাড়া মইদুলের আর কোনো খবর নেই, কেন? আমি, কফি হাউসের সুজাতা হইনি তখনো, আমি বড় ভাইয়ের সাথে বসার ঘরেই আড্ডা মারলাম রাত বারোটা পর্যন্ত। রুমে ফিরে দেখি অবিরাম ফোন বাজছে, ধরলাম, কায়েস, অদ্ভুত গলায় সে বলল, ‘তোমার সেই হাতটা আমি চিরদিনের মতো ছেড়ে দিলাম বউ।’
ফোন ছেড়ে দিল সে। সারা রাত আমি মোফাজ্জলের দোকানে ফোন দিলাম। কেউ ধরল না। এখনো আমি এই নাজলি ওই নাজলিকে মেঝের ধুলায় লুটিয়ে কাঁদতে দেখে কুড়ি বছর আগের মতোই ব্যথা পেলাম। জানে না, কায়েস সেই রাতেই গলায় দড়ি দিয়ে মরেছে। জানে না, নিজের ওই দমচাপা ঘরটায় অসহ্য স্নায়বিক চাপে সে–ও মরতে চাইবে...কিন্তু সে বেঁচে থাকবে। অচিকিৎস্য মানসিক রোগীর বিষণ্নতাই দেখেছে সে দিনের পর দিন, চিনতে পারেনি, আর দেখেছে মৃত্যু, অতটা দায়ী করে যেতে পারে কেউ...দায় তার, সে ভেবেছে তার। সুরেফা বেগম পুলিশকে গিয়ে পুত্রহন্তা হিসেবে প্রথম বলেছেন নাজলির নাম। ওই নাজলি এখনো আরও বহুদিন এই আকস্মিকতাকে পার হতে না পেরে কাঁদবে, আনন্দশংকরের ‘মিসিং ইউ’ শুনে কাঁদবে, ‘এক তরিতে যাব মোরা আর-না হারা গাঁ’ পড়ে কাঁদবে, স্নায়ুরাক্ষস তাকে একটা ভ্যাপসা পচা আনারসের মতো ফাটিয়ে ফেলে কুরে কুরে খাবে। গুরুজি দেখবেন, নাজলির গলা-বুক সব মিশে গিয়ে দর্দ নিঃসরিত হচ্ছে। পালকে ভরে যাচ্ছে মেঝে। ফোঁটা ফোঁটা রক্ত মিশছে শ্বেতগোলাপে। নাজলির বড় ভাই একটা জলঝাড়ু এনে সেই রক্ত সাফ করছে ক্রমাগত।
এই নাজলি জেগে গেছে সক্কালবেলা ঘুমের ঘোরে শিশুদের সমবেত চিৎকারে ‘কুমির তোর জলে নেমেছিইইইইই’, সুরেফা বেগম যখন বলেছেন, ‘আমার ছোট ছেলে রফিকুল্লাকে বিদেশে পাঠাইতে চাই মা, তুমি না কথা দিসিলা কায়েসরে, তার ছোট ভাইয়ের দায়িত্ব তোমার?’, তখন সে প্রায় মুখ ফসকে বলেই ফেলছিল ‘কুমির তোর জলে নেমেছি!’ কুড়ি বছর আগের অসম সম্পর্কের দায় টানা অনভিজ্ঞা নাজলির ম্লানমুখ পটু হাতে মুছতে মুছতে এই নাজলি মৃদুগলায় কী সব বলে, শোনা যায় না।

০২/০২ /২০২০