যেন চোখের সামনে সান্তা ফে

মঈনুস সুলতান শুধু ভ্রমণকারীই নন, যেখানে, যে দেশেই ভ্রমণ করুন না কেন, তিনি তার প্রায় চুম্বক বিবরণ তাঁর নিজস্ব ভাষাভঙ্গির দৌলতে তুলে ধরার চেষ্টা করেন। 

প্রথমা প্রকাশন থেকে চলতি বইমেলা উপলক্ষে প্রকাশিত সান্তা ফের আর্ট ডিস্ট্রিক্ট ও মুনলাইট ক্যাম্পফায়ার শিরোনামের ভ্রমণকাহিনিতেও তাঁর অনন্য কথনভঙ্গি আরও উজ্জ্বল ও জীবন্ত হয়ে উঠেছে। শুধু তা–ই নয়, যেখানে যে দেশ বা মহাদেশের যে জায়গাতেই তিনি ভ্রমণ করুন না কেন, সেখানকার এমন সব দ্রষ্টব্যের বিবরণ তুলে ধরেন, সাধারণের চোখে সাধারণত যা তুচ্ছতুল্য অথবা চোখেই পড়ে না।

যেমন ধরুন আমাদের আজকের আলোচ্য বইটির কথাই। সান্তা ফে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এমন একটি জায়গা, যা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৭ হাজার ১৯৯ ফুট ওপরে অবস্থিত। চিত্র গ্যালারির পর চিত্র গ্যালারিতে জমজমাট একটি শহর। সেখানকার আর্ট ডিস্ট্রিক্ট ঘুরে বেড়ানোর অভিজ্ঞতারই আখ্যান দিয়ে সাজানো হয়েছে এ বই। ভূমিকা মারফত মঈনুস সুলতান আমাদের জানাচ্ছেন, ‘১৬১০ সালে স্প্যানিশ উপনিবেশের রাজধানী হিসেবে সান্তা ফে নগরীর গোড়াপত্তন হয়। এ জনপদ সে জমানায় নিয়ন্ত্রিত হতো পাশের বৃহৎ উপনিবেশ মেক্সিকো থেকে। ১৮৪৬ সালে মেক্সিকান–আমেরিকান যুদ্ধের পরিণামে এলাকাটি যুক্তরাষ্ট্রের করতলগত হয়। এখানকার জনগোষ্ঠীর এক ব্যাপক অংশ মেক্সিকান বংশোদ্ভূত, এ ছাড়া আমেরিকার আদিবাসী নেটিভ আমেরিকানদেরও বেশ কয়েকটি পোয়েবলো বা গ্রাম ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে সাংগ্রে ডে খ্রিস্ত পাহাড়ের ফুটহিলস–শোভিত উপত্যকায়।’ এহেন যে সান্তা ফে, সেখানে ‘সদ্যাগত পর্যটকের প্রথমেই যা চোখে পড়ে, তা হচ্ছে বেশুমার চিত্র গ্যালারিতে জমজমাট একটি আর্ট ডিস্ট্রিক্ট।’

এই আর্ট ডিস্ট্রিক্ট ঘুরে বেড়াতে গিয়ে লেখককে কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি। তারও বিবরণ আছে ভূমিকায়।

মোট ১৩টি ভ্রমণ-আখ্যান দিয়ে সাজানো এ বই। আখ্যানগুলোর শিরোনাম হচ্ছে যথাক্রমে ‘আর্ট ট্রাভেলার ইন সান্তা ফে’, ‘শহরের বাইক-পাথে’, ‘বাসে চড়ে ক্যাথিড্রাল অব্দি’, ‘প্রান্তরে জুনিপার বৃক্ষের ঝোপ’, ‘অ্যাডোবি কটেজ’, ‘মুনলাইট ক্যাম্পফায়ার’, ‘ভাস্কর্যের বাগিচায় মার্মালিনা’, ‘হিজাব পরা নারী ও পোষা মাকড়সা’, ‘বিচিত্র এক চিত্র স্টুডিও’, ‘জর্জিয়া ও‘কিফের বসতবাড়ি ও স্টুডিও’, ‘জেরোলিমো রেস্তোরাঁ’, ‘হট স্পা—টেন থাউজেন্ড ওয়েভ’ এবং ‘গুলিবিদ্ধ হেলিকপ্টার ও অপিওড এপিডেমিক’। উল্লিখিত প্রতিটি ভ্রমণ–আখ্যান বা নিবন্ধকে আরও জীবন্ত করে তুলেছে প্রাসঙ্গিক ফটোগ্রাফ। 

ভ্রমণ–আখ্যানগুলো পড়তে পড়তে পাঠক হিসেবে আপনি নিজেও শিল্পকলার এই তীর্থতটে দেখা পাবেন হামেশা ঘুরে বেড়ানো বোহিমিয়ান শিল্পীদের, পাবেন তাঁদের দিনযাপনের প্রকৃতিগত বৃত্তান্ত। পরিচিত হবেন চিত্রকর সেই রোমেরোর সঙ্গে, যুদ্ধবন্দী হিসেবে যাঁকে অন্ধকার একটি গুহায় তালাবদ্ধ করে রেখেছিল ভিয়েতকং গেরিলারা। সাক্ষাৎ পাবেন চিত্রশিল্পী কেলিমুরের, যিনি প্রেরণার ঘাটতি হলে মরিচের ধোঁয়ায় স্মোক-বাথ করেন, কাকের ছায়ামূর্তির মতো পোর্ট্রেটের নিচে যিনি তৈরি করেছেন একটি বোম্ব-কেইস। জানতে পারবেন চিত্রশিল্পী ও’কিফকে, যিনি ফুলের প্রতিকৃতিতে প্রজননের প্রতীক সমন্বয় করে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তাঁর বসতবাড়ির বিবরণ এমনই জীবন্ত যে সুদর্শন পাহাড়ে অবস্থিত তাঁর সেই বাড়িতে দাঁড়িয়ে যেন উপভোগ করবেন গোধূলি–ঝলসানো রক ফরমেশন এবং হাই-ডেজার্টের প্রান্তিকে নেমে আসা আসমানের বর্ণিল চিত্রপট। আপনাকে সহকর্মী করে তুলবে এল সালভাদরের অভিবাসী যুবকের প্রণয়ে উদ্বেলিত মাকড়সা পোষা নারী কিংবা ওপিওড এপিডেমিকে সন্তান হারানো মেক্সিকান তরুণীর দিনযাপনের আখ্যানও।

ধ্রুপদি চরিত্রের এই ভ্রমণগ্রন্থ যে আমাদের ভ্রমণসাহিত্যে এক অভিনব সংযোজন, তাতে সন্দেহের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই। পড়তে পড়তে মনে হবে যেন আমাদের চোখের সামনে সান্তা ফে। বইটি পড়লেই তার প্রমাণ পাওয়া যাবে।

বইমেলায় বইটি পাওয়া যাচ্ছে প্রথমা প্রকাশনের প্যাভিলিয়নে 

(প্যািভলিয়ন ১৫)।