ধীরে চলা

পঞ্চম কিস্তি


আজকালকার সব রাজনীতিবিদের মধ্যেই কিছু পরিমাণ নৃত্যশিল্পী আছেন, পঁতেভিঁ বলেন, আর সব নৃত্যশিল্পীই রাজনীতিবিদ; তবে দুই দলকে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। নৃত্যশিল্পীরা রাজনীতিবিদের চেয়ে আলাদা, কারণ তাঁরা ক্ষমতা নয়, গৌরব খোঁজেন। তাঁরা পৃথিবীর ওপরে কোনো সামাজিক কর্মসূচি চাপিয়ে দেন না, যদিও সেটাকে কম গুরুত্বপূর্ণও ভাবেন না। বরং নৃত্যশিল্পীরা মঞ্চকে বেছে নেন নিজের রশ্মি বিকিরণ করার ক্ষেত্র হিসেবে।

মঞ্চ দখল করে নেওয়ার জন্য দরকার হয় অন্যকে মঞ্চ থেকে সরিয়ে দেওয়ার। এ জন্য দরকার বিশেষ রকমের যুদ্ধের কৌশল। একজন নৃত্যশিল্পী যে যুদ্ধটা লড়েন, পঁতেভিঁ এর নাম দিয়েছেন ‘নৈতিক জুডো’, সে তার হাতের দস্তানা ছুড়ে মারে সমস্ত পৃথিবীর দিকে; তার চেয়ে নীতিবান আর কে আছে? তার চেয়ে সাহসীতর, ভদ্র, আত্মত্যাগী, ঐকান্তিক, সত্যপূর্ণ? সে চেষ্টা করে সাধ্যমতো অন্যকে তার চেয়ে হীনতর প্রমাণ করার জন্য।

একজন নৃত্যশিল্পী যদি সুযোগ পেতেন রাজনীতির খেলায় অবতীর্ণ হওয়ার, তাহলে তিনি প্রকাশ্যে সব গোপন চুক্তিগুলোকে প্রত্যাখ্যান করতেন (যা আসল রাজনীতির মাঠের সব সময়ই থাকে), সেসব চুক্তিকে অভিহিত করতেন প্রতারণাপূর্ণ, অসৎ, ভণ্ড, নোংরা বলে; তিনি তাঁর নিজের প্রস্তাবগুলোকে ঘোষণা করতেন প্রকাশ্যে, একটা মঞ্চে গাইতে গাইতে আর নাচতে নাচতে, তারপর নাম ধরে ধরে অন্যদের আহ্বান জানাতেন তাঁর নিজের প্রস্তাবমতো কাজ করতে। আমি জোর দিচ্ছি, তাঁরা আহ্বান জানাতেন প্রকাশ্যে। এবং সম্ভব হলে হঠাৎ করে। ‘তুমি কি আমার মতো প্রস্তুত আছ সোমালিয়ার শিশুদের জন্য নিজের এপ্রিল মাসের বেতনটা দান করে দিতে?’ অপ্রস্তুত অন্যদের সামনে তখন কেবল দুটো পথ খোলা থাকত: হয় তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে শিশুদের শত্রু হিসেবে নিজেকে হেয় করা, অথবা চরম অস্বস্তির সঙ্গে ‘হ্যাঁ’ বলা, যা কিনা ক্যামেরা অসৎ উদ্দেশ্যে ধারণ ও প্রচার করত, যেমন করে তা বেচারি বার্কের দ্বিধাসংকুল চেহারাটা দেখিয়েছিল, যখন তাঁর সামনে এই প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছিল যে তিনি কি এইডস রোগীকে চুম্বন করবেন নাকি করবেন না! ‘ডাক্তার এইচ, আপনি কেন নীরব, যখন আপনার দেশে মানবাধিকার পদদলিত?’ ডাক্তার এইচকে এমন একটা সময় এই প্রশ্ন করা হলো, যখন হয়তো তিনি অপারেশন থিয়েটারে, টেবিলে অজ্ঞান রোগী, তার পেট কাটা, তিনি সেলাই করবেন, তিনি জবাব দিতে পারলেন না, তিনি রোগীর কাটা পেট সেলাই করলেন, তাঁর এই নীরবতা এই লজ্জায় ঢেকে দিতে লাগল সবকিছু, সবকিছু ঝাপসা হয়ে যেতে লাগল, তারপর তিনি একটা কিছু বললেন, তখন ওই নৃত্যশিল্পী, যিনি এসব বড় বড় কথা বলছেন ছুড়ে মারলেন আরেকটা চপেটাঘাত: অবশেষে...আচ্ছা দেরিতে হলেও তিনি তো একটা কিছু বলেছেন (এটা ওই নৈতিক জুডোর আরেকটা প্যাঁচ, এবং বিশেষ শক্তিশালী প্যাঁচ)।

একনায়কতন্ত্রের সময়ে যেমন, কখনো কখনো এ রকম পরিস্থিতি আসতে পারে, যেখানে কোনো প্রকাশ্য পক্ষাবলম্বন হয়ে উঠতে পারে বিপজ্জনক। কিন্তু একজন নাচিয়ের জন্য পরিস্থিতিটা কিছুটা কম বিপজ্জনক, কারণ সমস্ত পাদপ্রদীপের আলো এসে পড়ে তার ওপরে, সমস্ত পৃথিবী তাকে দেখছে। তা তাকে সুরক্ষা দেয়। এই নাচিয়ের অনেক মুগ্ধ ভক্ত আছে। তারা তার সুন্দর কিন্তু বিবেচনাহীন আহ্বানে সাড়া দিয়ে স্মারকলিপিতে সই করে, গোপন নিষিদ্ধ সভায় যোগ দেয়, রাজপথে আন্দোলন–সংগ্রাম করে, এবং তাদের ওপরে দমন-নিপীড়ন নেমে আসে। কিন্তু নাচিয়ে কখনোই এই রকম আবেগপূর্ণ প্ররোচনার দ্বারা চালিত হন না, এ কথা ভাবেন না যে এই মানুষগুলোর এই বিপন্নতার জন্য তিনিই দায়ী, কারণ তিনি জানেন, একটা মহান আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে গেলে দুই–চারজনের ব্যক্তিস্বার্থ বিসর্জন দিতেই হবে।

পঁতেভিঁর সঙ্গে ভিনসেন্ট ভিন্নমত পোষণ করেন। ‘আপনি যে বার্ককে দুই চোখে দেখতে পারেন না, সেটা সবাই জানে। আমরা আপনার সঙ্গে আছি এই বিষয়ে। যদিও লোকটা একটা গাধা। তবু তো সে কতগুলো মহৎ উদ্দেশ্য সামনে নিয়ে কাজ করে। আর আমরা তার উদ্দেশ্যগুলোকে নিজেরাও সমর্থন করি। এবং তার অতি-অহংকার সেসবকে সমর্থনও করে। কিন্তু আপনি যদি কোনো গণবিতর্কে অংশ নিতে চান, কোনো একটা ভয়াবহ জিনিসের প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চান, কোনো নির্যাতিতের পাশে দাঁড়াতে চান, নিজেকে একজন নাচিয়ে না বানিয়ে বা নাচিয়ের মতো ভাবভঙ্গি না অর্জন করে কীভাবে আপনি নিজে তা করবেন?’

রহস্যময় পঁতেভিঁ এই প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘আপনি যদি ভেবে থাকেন যে আমি নৃত্যশিল্পীদের আক্রমণ করতে চেয়েছি, তাহলে আপনি ভুল করছেন। আমি তাদের পক্ষ সমর্থন করি। যে কেউ নৃত্যশিল্পীদের অপছন্দ করেন, তাঁদের হেয় করতে চান, তাঁদের সামনে আসবে এক অলঙ্ঘনীয় বাধা: নৃত্যশিল্পীদের শালীনতা। একজন নাচিয়ে সারাক্ষণ থাকেন প্রকাশ্য, সবার সামনে, তিনি সমালোচনার ঊর্ধ্বে ওঠার ব্যাপারটাকে নিন্দা করেন, ফাউস্টের মতো তিনি শয়তানের সঙ্গে সন্ধি করেন না, তাঁর সন্ধি দেবদূতের সঙ্গে। তিনি তাঁর জীবনকেই একটা শিল্পকর্ম করে তোলেন, দেবদূতেরা তাঁকে সহায়তা করেন, কারণ নৃত্য ব্যাপারটা নিজে একটা শিল্প। নিজের জীবনকে একটা শিল্পের উপাদান হিসেবে দেখাটাই একটা নৃত্যশিল্পীর জীবনের সত্য সারবত্তা। তিনি নৈতিকতা প্রচার করেন না। তিনি তো নাচেন। তিনি তাঁর নিজের জীবনের সৌন্দর্য দিয়ে পৃথিবীটাকে নাড়াতে এবং ঝলকিত করতে চান। তিনি তাঁর নিজের জীবনের প্রেমে পড়েন, যেমন করে একজন ভাস্কর তাঁর ভাস্কর্যের প্রেমে পড়ে থাকেন।

[৬ নম্বর অনুচ্ছেদ শেষ হয় গেল। আপনাদের মনে আছে তো যে আমরা আসলে একটা শহরের বাইরের হোটেলে বেড়াতে গেছি, আমরা মানে এই উপন্যাসের নায়ক-নায়িকা। হয়তো মিলান কুন্ডেরা নিজে আর তাঁর স্ত্রী ভেরা। তাঁরা হোটেল রুমে টিভি দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়েছেন।

কিন্তু আমাদের গল্প আছে সাহিত্যের আলোচনায়। তারপর দর্শনের আলোচনায়। এখন আমরা একটা বকিয়ে দার্শনিককে পাচ্ছি, যিনি রেস্তোরাঁয় বসে শিষ্যদের সঙ্গে তত্ত্ব আলোচনা করেন। বার্ককে আমরা ভুলে গেছি। এখন আমরা নাচিয়েদের সঙ্গে রাজনীতিবিদদের তুলনা আলোচনা করছি। দেখা যাক, এরপর ৭ নম্বর চ্যাপ্টারে কী হয়?]

(চলবে)