আমি কভু ভুলিব না

>এই করোনা মহামারি স্মরণ করিয়ে দেয় গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের ‘লাভ ইন টাইম অব কলেরা’, সমারসেট মমের ‘দ্য পেইন্টেড ভেইল’। মনে পড়ে শরৎবাবুর ‘গৃহদাহ’র সুরেশ। সে মরেছিল প্লেগে। তারাশঙ্করের ছোটগল্পেও আছে গ্রাম্য ডাক্তারের কথা, তড়কা রোগে রোগীরা মরে যাচ্ছে। ব্ল্যাক ডেথের সময়কার স্মৃতি নিয়ে রচিত হয়েছে কত শত রাইম, চিত্রকর্ম...

অল্প বয়সে যখন মানুষ বাতিঘরের মতো চকচকে চোখে প্রেম খোঁজে আর প্রেমের কবিতা পড়ে, সেসব সময়ে আমার মতো করে আপনিও নিশ্চয়ই পড়েছেন রবীন্দ্রনাথের ‘অভিসার’, ওই যে ‘সন্ন্যাসী উপগুপ্ত, মথুরাপুরীর প্রাচীরের তলে একদা ছিলেন সুপ্ত’, সেই সন্ন্যাসী আর নগরনটী বাসবদত্তাকে নিয়ে কবিতা। যখন বাসবদত্তার প্রদীপ্ত যৌবন, যখন সে সুসজ্জিতা আর অভিলষিতা, তখন সন্ন্যাসী তার ডাকে সাড়া দেননি, বলেছেন তার সময় আসেনি। বছর ফুরাতে এসেছে আরেক চৈত্রের রাত্রি। নগরের চারদিকে যে পরিখা থাকত, সেখানে আমগাছের ছায়ায় কে ফেলে রেখেছে বাসবদত্তাকে, ‘নিদারুণ রোগে মারীগুটিকায় ভরে গেছে তার অঙ্গ’। সন্ন্যাসী বসন্তরোগীকে কোলে তুলে নিলেন, তাকে জল দিলেন, গায়ে লেপে দিলেন রোগহর চন্দন, প্রায় অচেতন রোগিণী তাঁকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, ‘আজি রজনীতে হয়েছে সময়, এসেছি বাসবদত্তা!’ ‘লাভ ইন দ্য টাইম অব কলেরা’র ফ্লরেন্টিনোর চেয়ে অনেক বিশুদ্ধ অনুরাগের কাহিনি অনেককাল আগেকার এই ‘লাভ ইন দ্য টাইম অব স্মলপক্স’ কিংবা ‘অভিসার’।

করোনাভাইরাসের প্রতাপে এখন গোটা দুনিয়া ভয়ে-আশঙ্কায় অস্থির, জীবাণু-অস্ত্রের পরীক্ষা-নিরীক্ষা আসলে চীনে হয়েছে নাকি আমেরিকায়—এসব নিয়ে প্রতিদিন নতুন গল্প শোনা যাচ্ছে, জেনেটিক্যালি মোডিফায়েড জীবাণু কত ভয়ানক, এসব চিন্তার ছায়ায় ধূসর হয়ে গেছে আমাদের প্রতিদিনের কর্মকাণ্ড। মানুষ পালে পালে মানুষকে মেরে ফেলার জন্য জীবাণু তৈরি করছে, এই ভয়ানক ঘটনায় আসলে জেনেটিক্যালি মোডিফায়েড জীবাণুর চেয়ে অনেক ভয়ানক হয়ে ধরা দেয় ‘জেনেটিক্যালি মোডিফায়েড মানুষ’, যে তার মনুষ্যত্বের অঙ্গীকার থেকে সরে গেছে। একদা সে মিক্সোম্যাটোসিস ভাইরাস প্রয়োগ করে পালে পালে জংলি খরগোশ মেরেছে, এখন মারছে মানুষকে। সেই যে পুরপরিখার অন্ধকারে শুশ্রূষারত সন্ন্যাসী, স্বাস্থ্যবান আর রোগক্লিষ্ট যার প্রেমের কাছে সমান, তাকে সুদূরবর্তী মিথের মতো দেখায়।

আমার মনে পড়ছে সমারসেট মমের ‘দ্য পেইন্টেড ভেইল’–এর কথা, ১৯২৫ সালে প্রকাশিত উপন্যাস, সিনেমাও হয়েছে পরে। ব্যাকটেরিওলজিস্ট স্বামীর সঙ্গে কলেরাবিপন্ন চীনে পাড়ি দেওয়া অনিচ্ছুক বউটি, বিয়ের পরপর সে প্রেমে পড়েছিল অন্যত্র, স্বামী জানত মেয়েটিকে তার খেলুড়ে প্রেমিক গ্রহণ করবে না, জোর করেই স্বামী তাকে নিয়ে আসে মহামারিতে ছারখার হয়ে যাওয়া জনপদে, যেখানে তার কর্মক্ষেত্র। স্ত্রী স্বামীকে বুঝতে পারে না, পরকীয়া সম্পর্ক আবিষ্কৃত হওয়ার পরেও জেদ না কাপুরুষতা কিসের বশে সে রয়ে যাচ্ছে স্ত্রীর পাশে? কেন তারা প্রতি রাতের খাবারে কলেরার মৃত্যুভয়কে তুড়ি মেরে সখেদে খায় কাঁচা সালাদ? ভাঙা-বুক কি মরতে চায়, নাকি মারতে চায়? বাইরে প্রতিদিন মানুষ মরছে, ঘরে মেয়েটি জানতে পারছে তার পেটে প্রেমিকের সন্তান। তবু এইখানে, এই কলেরাবিক্ষুব্ধ চীনা জনপদে কনভেন্টের সন্ন্যাসিনীদের অবিরাম অক্লান্ত সেবা দেখে আর মানুষের মৃত্যুযন্ত্রণা চাক্ষুষ করে মেয়েটি কখন বদলে যায়! তার প্রদীপ্ত বাসনার আলো যত দিনে স্পটলাইটের মতো পড়েছে সন্তপ্রায় স্বামীর দিকে, তত দিনে স্বামীটি কলেরায় আক্রান্ত হয়েছে—সম্ভবত কলেরার প্রতিকার নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে, কিংবা নিরন্তর একরকম আত্মহত্যা করবার অন্তর্গত প্ররোচনায়। মৃত্যু হানা দেয়, কিন্তু প্রেম রয়ে যায়। মেয়েটি হাতছানি সত্ত্বেও আর ফিরে যায় না সেই প্রেমিকের কাছে। মারির করালগ্রাসে পড়ার আগে এবং পরে মানুষই যে জয়ী, তার প্রেম যে মৃত্যুঞ্জয়, তাই নিয়ে ভারী অদ্ভুত এক উপন্যাস।
মহামারির প্রসঙ্গ এলে সাহিত্যের আরেকটি চরিত্রকে ভুলে থাকা মুশকিল, সে শরৎবাবুর ‘গৃহদাহ’র সুরেশ। সেও মরেছিল প্লেগে। উপন্যাসের খলচরিত্র, একদিকে সে মুঙ্গেরে খরস্রোতা নদীতে ভেসে যাওয়া বাল্যবন্ধুকে বাঁচায়, আরেক দিকে বাল্যবন্ধুর স্ত্রীকে হরণ করে নিয়ে যায় তার সঙ্গে থাকবে বলে। শেষের দিকে উজাড় হয়ে যাওয়া গ্রামের কথা আছে, ভাঙা হাটের চিহ্ন, ঝাঁপ ফেলে দেওয়া দোকান, পথে পথে বাঁশ আর চাটাইয়ে বাঁধা মৃতদেহ বহন করে নিয়ে যাওয়া লোক, কান্নার রোল আর পুকুরের পাড়েই গলিত শব। মনে পড়ে, তারাশঙ্করের ছোটগল্পেও এমন আছে গ্রাম্য ডাক্তারের কথা, তড়কা রোগে রোগীরা মরে যাচ্ছে, সে মনোযাতনায় এতটুকু হয়ে যাচ্ছে—মৃত্যুপথযাত্রী রোগীর মায়ের অসংবৃত শরীরের দিকে তাকিয়েছে বলে।

চাইনিজ-আমেরিকান ঔপন্যাসিক ও গল্পকার হা জিনের একটি ছোটগল্প পড়েছিলাম, অনুবাদও করেছিলাম, নাম ‘অন্তর্ঘাতক’ (স্যাবোট্যার)। সদ্য বিবাহিত মিস্টার চু মধুচন্দ্রিমায় যাওয়ার আগে একটা রেস্টুরেন্টে খাওয়াদাওয়া করছিল, পুলিশের ছুড়ে ফেলা চা লাগে তার আর তার কনের গায়ে। সেই থেকে শুরু। মিস্টার চু’কে জেলে পোরা হয়। সে নির্দোষ, তাই সে কিছুতেই দোষ স্বীকার করে না। জেলখানার অসহনীয় পরিবেশ সইতে সইতে মিস্টার চু বারবার কারারক্ষীদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে তার মাস কয়েক আগেই হেপাটাইটিস হয়েছিল, কেউ শোনে না তার কথা। ছারপোকায় আচ্ছন্ন বিছানায় শুয়ে শুয়ে সে অনেক কিছু ভাবে, যেদিন সে ছাড়া পায়, সেদিন সে জেলখানার আশপাশের অনেকগুলো রেস্টুরেন্টে পরপর গিয়ে খাবারের অর্ডার দেয়, যেন এত দিনের অনাহার আর অর্ধাহারে পাগল হয়ে গেছে সে, অথচ প্রতিটি খাবার সে আধখাওয়া করে ফেলে আসে। এক মাসের ভেতর সেই এলাকায় ৮০০ জন অ্যাকিউট হেপাটাইটিসের রোগী পাওয়া যায়, ছজন মারা যায়, যাদের ভেতর দুটি শিশু। এই গল্পটা আমাকে থমকে দিয়েছিল মনে আছে, জেনেটিক্যালি মোডিফায়েড মানুষের কথা বলছিলাম শুরুতেই। এই মোডিফিকেশন সম্ভবত এক দিনে হয় না, অগণন অবমাননার গল্প আছে তার পিছে, আছে ক্রোধ, আছে লিপ্সা, আছে গর্বমদ।
ব্ল্যাক ডেথের সময়কার স্মৃতি নিয়ে কত শতক ধরে বয়ে গেছে নার্সারি রাইম—রিঙ্গা রিঙ্গা রোজেস, পকেট ফুল অব পোজিস, অ্যাশেজ অ্যাশেজ উই অল ফল ডাউন। অনেক বছর ধরেই আমরা জানি ‘উই অল ফল ডাউন’, সকলেই মৃত্যুর পেয়ালায় চুমুক দেবে। ‘একাকী যাব না, অসময়ে’ বললেও মহামারি-মন্বন্তর এসব আমাদের হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যেতে পারে শেষ গন্তব্যের দিকে। সেই অবশ্যম্ভাবীকে কী ভয় আমাদের! নিজেদের জন্য যত নয়, প্রিয়জনদের জন্য আরও। তাই আমরা প্রায় লুট করে নিয়ে আসছি বাজারের সব পণ্য, শস্য বোঝাই করছি ঘর, যেন নুহের নৌকায় আবার উঠব বলে সরবরাহ সংগ্রহ করে চলেছি। সব চরাচর প্লাবিত হয়ে গেলেও যেন আমাদের যার যার বংশচিহ্ন রয়ে যায়। কী সাংঘাতিক এই চাওয়া, অবশ্য এই চাওয়াটাও বংশগতিরই দান, প্রকৃতিরই দান।

কিন্তু এরপরও কথা আছে। মৃত্যুভয়কে তুচ্ছ করে সবচেয়ে আক্রান্ত শহরেই ঢুকেছে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় স্বেচ্ছাসেবক, মানুষের নাম তারা লিখে যাবে, জীবাণু-অস্ত্র নিয়ে খেলতে পটু শাসকদের নাম ধুলোয় মিলাবে, তৈমুরের সমাধির মতো নিখোঁজ হয়ে যাবে সেসব নাম। মানুষের মায়া-করুণা-ভরসা এবং আন্তরিক প্রত্যাশার কাছে, মানুষের মেধার কাছে এই মহামারি বা অতিমারির পরাজয় ঘটবে। তত দিন ভরসা থাকুক। কে বলেছে, যত বড় রাজধানী, তত বিখ্যাত নয় হৃদয়পুর (ইস্টিশনটা নয়)?