ধীরে চলা

‘নির্বাচিত’। এই যে সাংবাদিক মেয়েটি নিজেকে মনে করেছে ‘নির্বাচিত’। ‘ইলেক্ট’। ‘নির্বাচিত’ কথাটার একটা আধ্যাত্মিক তাৎপর্য আছে। একজন ‘নির্বাচিত’ ব্যক্তি কিন্তু তাঁর স্বাভাবিক প্রতিভার কারণে নির্বাচিত নন। এটা ঈশ্বরের একটা স্বাধীন, খেয়ালি সিদ্ধান্ত, একটা অতিলৌকিক বিচারের মধ্য দিয়ে তিনি চয়িত হন। তাঁর নিশ্চয়ই একটা কিছু আছে, যা অনন্যসাধারণ, ব্যতিক্রমধর্মী। এই বিবেচনা থেকেই সাধুসন্তগণ তাঁদের ওপরে নেমে আসা অসহ্য অত্যাচারও সহ্য করেন। এই আধ্যাত্মিক চিহ্নগুলো মহৎদের জীবনের প্যারোডির মতো আমাদের সাধারণ মানুষদের জীবনেও প্রতিফলিত হয়। আমরা প্রত্যেকেই জীবনে কমবেশি কষ্টে ভুগি। আমরা তা থেকে মুক্তি চাই। আকুল হয়ে উঠি। আমরা নিজেদের স্তর থেকে উঁচুতর স্তরে উন্নীত হই। আমাদের মধ্যে একটা কুহক কাজ করে, ভ্রান্তি যে, আমরা আসলে যা, তার চেয়ে বড় স্তরের জন্য যোগ্য, নিয়তি আমাদের বড় কিছুর জন্য বাছাই করে রেখেছে।

‘ইলেক্ট’ বা’ নির্বাচিত’—এই অনুভূতি প্রতিটা প্রেমের সম্পর্কের মধ্যেই উপস্থিত। কারণ প্রেমের সংজ্ঞাই হলো, কোনো কারণ ছাড়াই প্রেম হলো আসল প্রেম। তোমাকে আমি ভালোবাসি, এর কোনো কারণ নেই, সেটাই হলো ভালোবাসার আসল প্রমাণ। যখন কোনো একজন মেয়ে আমাকে এসে বলে, তোমাকে ভালোবাসি কারণ তুমি বুদ্ধিমান, কারণ তুমি ভদ্র, কারণ তুমি আমাকে সুন্দর সুন্দর উপহার কিনে দাও, কারণ তুমি আমাকে রান্না করে খাওয়ায়, আমি হতাশ হই। এই ধরনের ভালোবাসা আমার কাছে মনে হয় স্বার্থপর। আহা, এর বদলে কত ভালোই না হতো, যদি আমি শুনতে পেতাম, তোমাকে আমি ভালোবাসি, যদিও আমি জানি, তুমি বুদ্ধিমান নও, ভদ্র নও, যদিও তুমি একজন মিথ্যুক, আত্মকেন্দ্রিক, হারামজাদা, তা সত্ত্বেও আমি তোমার জন্য পাগল।

সম্ভবত একজন শিশু হিসেবেই আমরা এই ‘নির্বাচিত’ বা’ ইলেক্ট’ হওয়ার বিভ্রান্তিকর অভিজ্ঞতাটা লাভ করি, আমাদের মায়েরা আমাদের অকারণে অতিরিক্ত ভালোবাসা দেখান। তখন আমরা আরও বেশি মনোযোগ দাবি করে বসি। একজনকে বড় করে তোলার সময় এই জাতীয় ভ্রম থেকে তাকে মুক্ত রাখা উচিত, তাকে বুঝতে দেওয়া উচিত তুমি যা পাচ্ছ, তার প্রত্যেকটার একটা দাম আছে। কিন্তু বড় দেরি হয়ে যায়। আপনি অনেক সময় দেখবেন, দশ বছরের একটা মেয়ে তার ছোট্ট বন্ধুদের ওপরে কিছু একটা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে, তখন যুক্তি দেখাতে না পেরে সে চিৎকার করে ওঠে, এটা করতে হবে, কারণ আমি এই রকমটাই চাই। কিংবা আমি বলেছি, ব্যস, এটাই হবে। কারণ সে নিজেকে ‘নির্বাচিত’ বলে গণ্য করছে। কিন্তু একটা দিন আসবে, যখন সে বলবে, এই রকম হবে, কারণ আমি এ রকম হবে বলছি, তখন তার চারপাশের সবাই হাসতে শুরু করে দেবে। যখন কেউ একজন নিজেকে ভাবে ‘নির্বাচিত’, তার কীই–বা আছে, যার দ্বারা সে প্রমাণ করবে যে সে নির্বাচিত, কীভাবে সে প্রমাণ করবে যে সে পালের মধ্যে আরও একজন সাধারণ মানুষ নয়?

এই দুর্দশা থেকে তাকে রক্ষা করার জন্য এল এক নতুন যুগ, ফটোগ্রাফির যুগ। সঙ্গে নিয়ে এল তারকাদের, নৃত্যশিল্পীদের, নিয়ে এল সেলিব্রেটিদের। তাদের প্রতিবিম্ব বিশাল বিশাল পর্দায় প্রতিফলিত হতে লাগল, সবাই সেসব দেখছে, প্রশংসা করছে, আর সেসব সাধারণের নাগালের কত বাইরে! বিখ্যাত ব্যক্তিদের জন্য মুগ্ধ আকর্ষণের মধ্য দিয়ে একজন ব্যক্তি যখন নিজেকে গণ্য করে ‘ইলেক্ট’ বা ‘নির্বাচিত’ হিসেবে, তখন সে সাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করে অনন্যসাধারণ হিসেবে, দূরত্ব রচনা করতে চায় সাধারণের থেকে, সাধারণ মানে তার সহকর্মী, প্রতিবেশী, পার্টনার—এমন সব মানুষ, যাদের সঙ্গেই বসবাস করতে সে বাধ্য!

এভাবে বিখ্যাত মানুষেরা হয়ে পড়ে একটা গণসম্পত্তি, যেন সে একটা পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা, যেন সে একটা সোশ্যাল সিকিউরিটি বা বিমা বা পাগলাগারদ। কিন্তু তারা ততক্ষণ পর্যন্তই কাজে লাগে, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা সত্যিকার অর্থে নাগালের বাইরে থাকে। যখন কেউ তার ‘ইলেক্ট’ বা ‘নির্বাচিত’ মর্যাদাটাকে নিশ্চিত করার জন্য কোনো একজন বিখ্যাত ব্যক্তির কাছাকাছি যায়, তখন সে নিক্ষিপ্ত হওয়ার ঝুঁকি নেয়। যে অভিজ্ঞতা এই সাংবাদিক মেয়েটি কিসিঞ্জারকে ভালোবেসে লাভ করেছে। আধ্যাত্মিক ভাষায় এটাকেই বলা হয় স্বর্গচ্যুতি। এই কারণে এই নারী তাঁর বইয়ে কিসিঞ্জারের সঙ্গে তার ভালোবাসাকে সঠিকভাবে, স্পষ্টভাবে অভিহিত করেছে ট্রাজিক বলে, কেননা স্বর্গচ্যুতি ব্যাপারটা সব সময়েই ট্র্যাজিক।

বার্কের প্রেমে সে পড়েছে, যতক্ষণ পর্যন্ত ইমাকুলাতা তা উপলব্ধি করেনি, ততক্ষণ পর্যন্ত সে কিন্তু আর দশটা নারীর মতো সাধারণ জীবনই যাপন করত, কয়েকটা বিয়ে, কয়েকটা বিবাহবিচ্ছেদ, কয়েকজন প্রেমিক, যারা এত শান্ত আর সহজপ্রাপ্য যে তার জীবনে সচরাচর হতাশা ছাড়া আর কিছুই দিতে পারেনি। তার সর্বশেষ প্রেমিকটি তাকে খুব পূজা করত। ইমাকুলাতা তাকে অন্যদের চেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্যই মনে করেছিল। সে কেবল বাধ্যগতই ছিল না, সে ছিল উপকারী, কারণ মেয়েটি কাজ শুরু করেছিল টেলিভিশনে আর ছেলেটি ছিল ক্যামেরাম্যান। ছেলেটি তার চেয়ে একটু বেশি বয়স্ক ছিল। সে ছিল একান্ত বাধ্যগত পূজারি ছাত্রের মতো। মেয়েটিকে সে মনে করত সবচেয়ে বুদ্ধিমতী, সবচেয়ে সুন্দরী, সবচেয়ে সংবেদনশীল।

ছেলেটি ভাবত, মেয়েটির সংবেদনশীলতা জার্মান রোমান্টিক চিত্রকরদের আঁকা প্রাকৃতিক ভূদৃশ্যের মতো, কল্পনাতীত উঁচু-নিচু জমিনে ছড়ানো–ছিটানো গাছপালা, তার ওপারে সুনীল আকাশ, যেখানে ঈশ্বর থাকেন, ছেলেটি যখনই এই ল্যান্ডস্কেপে পা রাখে, তার ভেতরে এক দুর্মর তাড়না আসে যেন সে বসে পড়বে হাঁটুমুড়ে এবং সেখানেই থাকবে স্থির। যেন সে একটা স্বর্গের অতিলৌকিক খেলা দেখছে।
(চলবে)