করোনা-সংকট ও বিকসেলের বুড়ো

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী
অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

পিটার বিকসেলের একটা গল্প আছে। একটা বুড়ো লোক, একা। প্রতিদিন একই রুটিন, একই জীবনযাত্রা। ঘুম ভাঙা থেকে আবার ঘুমিয়ে পড়া অব্দি। একই সময়ে নাশতা। হাঁটতে যাওয়া। একই লোকের সঙ্গে একই জায়গায় দেখা হওয়া, সম্ভাষণ বিনিময় ইত্যাদি। এভাবে একদিন তিনি তিতিবিরক্ত হয়ে গেলেন। তখন তিনি তার চারপাশের জিনিসপত্রের নাম বদলে দিতে শুরু করলেন। বিছানার নাম দিলেন ঘড়ি, ঘড়িকে টুথব্রাশ, টুথব্রাশকে ফ্যান, ফ্যানকে চেয়ার, চেয়ারকে ড্রয়ার, ড্রয়ারকে টেবিল ইত্যাদি। এতে করে তার জীবনের ন্যারেটিভ দারুণভাবে পাল্টে গেল। কারণ, তিনি এখন সকালে ঘড়ি থেকে উঠে ফ্যান করেন, তারপর চেয়ার চালিয়ে দিয়ে ড্রয়ারে বসেন। এভাবে তিনি ধীরে ধীরে বস্তুর পুরোনো নামগুলো একেবারেই ভুলে গেলেন। একসময় এমন দাঁড়াল, লোকে তার সামনে ওদের স্বাভাবিক গালগল্প করছে। আর তিনি হেসেই খুন। কারণ, তার কাছে ওই শব্দগুলোর অর্থ তো চিরকালের জন্য পাল্টে গিয়েছে।

পিটার বিকসেলের বাড়ি সুইজারল্যান্ড। ইতালির পাশের দেশ। ইতালিতে করোনা মহামারিতে মৃত্যুর মিছিল দেখতে দেখতে বিকসেলের এই গল্পের কথাই মনে পড়ছিল। বিকসেলের সেই বুড়ো কী করছে এখন? হয়তো সে মৃত্যুরও নতুন কোনো নাম দিয়ে ফেলেছে। মহামারিরও। হয়তো মৃত্যু সেই নতুন নাম নিয়ে আর এতখানি ভীতিকর নয় তার কাছে। মহামারিও নয়। সারি সারি কফিন বক্সের ছবি দেখি টেলিভিশনে। এই কফিন বক্সগুলোর কী নাম দিল বুড়ো? এমন কোনো নাম, যাতে ওখানে আরামসে ঘুমাতে যাওয়া যায়!

বেশি বয়স্কদের ব্যাপারে করোনাদেবীর এ রকম পক্ষপাত দেখেও নানা রকম ভাবনার উদয় হয়। বহুদিন ধরেই আলাপ হচ্ছে পশ্চিমা দুনিয়ায়। তাদের ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধ জনগোষ্ঠী নিয়ে। সমাজে উপার্জন নেই, এমন লোক ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে, যারা রাষ্ট্রীয় খরচায় জীবন নির্বাহ করবে। এতে রাষ্ট্রের খরচ বাড়ছে। করোনা যেন এই সব নিওলিবারেল রাষ্ট্রগুলোর উকিল হয়ে পৃথিবীতে নাজিল হলো! এখন পর্যন্ত করোনার কোনো ভ্যাকসিন নেই, নিরাময়যোগ্য ওষুধও আবিষ্কৃত হয়নি। ফলে ‘হার্ড ইমিউনিটি’র জন্য বসে থাকার কথা ভাবছে কোনো কোনো রাষ্ট্র। এই হার্ড ইমিউনিটির ফর্মুলা অনুযায়ী জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগ মানুষ যখন এই ভাইরাসে আক্রান্ত হবে, তখন জনগোষ্ঠীর মধ্যে একটা গণপ্রতিরোধ তৈরি হয়ে যাবে। বেশ, এই অসহায় ফর্মুলার মর্মে আছে নিওলিবারেল নির্মমতা। কারণ, গণসংক্রমণ হতে দিলে মৃত্যুও তো হবে। আর মৃত্যুর মিছিলের অগ্রভাগে যে আছে রাষ্ট্রীয় খরচায় জীবন চালানো বুড়োরা! তারা অকাতরে মরে গিয়ে রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ খরচ বাঁচিয়ে দিয়ে যাচ্ছে তো!

মৃত্যু আর আতঙ্কের মোকাবিলায় করোনা মহামারিকে একটি ভাষাতাত্ত্বিক সংকটরূপে খেয়াল করা যাচ্ছে, তৃতীয় বিশ্বে। বিকসেলের বুড়ো যেভাবে শব্দের অর্থ পাল্টে দিয়ে দুর্বিষহ জীবনকে অর্থবহ করে নিয়েছিল, আমরাও সেভাবে চেষ্টা করছি। শুরুতে করোনার নাম দিলাম ‘খোদার গজব’, কেননা সেটা উইঘুর মুসলিম-নির্যাতক চীনের ওপর নাজিল হচ্ছে। তারপর মধ্যপ্রাচ্য বা মালয়েশিয়ার ওপর ছড়িয়ে যেতে শুরু করলে নাম বদলে দিলাম ‘ইমানি পরীক্ষা’। যখন নিজেদের ওপর এসে পড়ল, ভালোবেসে তার নাম দিয়ে দিলাম ‘জ্বর-সর্দি-কাশি’। এভাবেই মৃত্যু আর আতঙ্ক সহনীয় হয়ে আসতে থাকল! লকডাউনের নাম দিলাম ‘ছুটি’। আর তাতে ঢাকা শহরের অভ্যন্তরীণ অভিবাসীরা করোনা-টরোনা ভুলে গিয়ে নাড়ির টানে বৃদ্ধ মা–বাবার কাছে ছুটতে শুরু করল। এই যাওয়া এত আবেগী, এত অবিবেচক, আর এত তীব্র! সেই সঙ্গে এত ভালোবাসাময়! সেই ভালোবাসার ফাঁদেই পড়ে গেলেন গ্রামে-মফস্বলে থাকা আমাদের করোনা-বিপন্ন বুড়োরা। বিদেশ থেকে, ঢাকা শহর থেকে সন্তানেরা বাড়ি যাচ্ছে। বৃদ্ধ মা–বাবার জন্য নিয়ে যাচ্ছে রেশমি জায়নামাজ, ডায়াবেটিস মাপার মেশিন। আর পেছন পেছন পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে করোনাদেবীকে!

এটাই নতুন মহামারির ভাষাতাত্ত্বিক সংকট। বলাবাহুল্য, এই ভাষাতাত্ত্বিক সংকটের পেছনে আছে রাজনীতি—জীবন ও মৃত্যুর রাজনীতি। কে মরবে আর কাদের বাঁচিয়ে রাখা হবে, পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো সচেতনভাবে এসব সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এটিকে বলা হয় নেক্রোপলিটিকস। আমাদের অবশ্য এত বিলাসিতার সুযোগ নেই। করোনাকে বিন্দুমাত্র সুযোগ দেব না, দরকার হলে বিনা পরীক্ষায় ‘সর্দি-কাশি’তে হাসতে হাসতে মরে যাব। কবরের জায়গা না মিললেও সমস্যা নেই। একটা নতুন ভাষাব্যবস্থার মধ্যেই আমাদের দাফন করা হবে। আমরা ইনফ্লুয়েঞ্জার পরিচয়ে নিহত হয়ে থাকব, নিউমোনিয়ার পরিচয়ে নিহত হয়ে থাকব, এমনকি হার্ট ফেইলিউরের পরিচয়েও নিহত হয়ে থাকব। এরা তো মৃত্যুর পুরানা সখা। এদের নিয়ে এত ভয় নেই। কিন্তু করোনা পরিসংখ্যানকে একদমই করুণা করা হবে না!

পশ্চিমের হিসাব অবশ্য ভিন্ন। মহামারি সেখানে কল্পিত হয় একটা নৈতিক সংকট হিসেবে। ২০১১ সালে হলিউডে বানানো কন্ট্যাজিয়ন ছবিটা করোনা পরিস্থিতিতে অনেকেই নতুন করে দেখছেন। একেবারে যেন কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়ারই কাহিনি। ছোট ছোট আপাতবিচ্ছিন্ন ন্যারেটিভ দিয়ে একটা ভয়াল মহামারির বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার গল্প। ছড়ানোর শুরু চীন অঞ্চল থেকেই। কিন্তু ছবিতে যেটা দেখি, ভাইরাস ছড়ানো শুরু করেছে একটা অনৈতিক যৌন সম্পর্ক থেকে। ফ্লু (২০১৩) নামের একটি কোরিয়ান মুভিতে দেখা যায়, ভাইরাস বহন করে নিয়ে আসছে অবৈধ অভিবাসী। ইবোলা ধরনের আরেকটি ভাইরাস নিয়ে বানানো আউটব্রেক (১৯৯৫) ছবিতে দেখা যায় বানরজাতীয় বন্য প্রাণী পাচার থেকে মহামারির সূত্রপাত। বাস্তবে মহামারির শুরু কীভাবে হয়, সেটি না জানা গেলেও গল্পে বা সিনেমায় জানতেই হয়। এর মর্মে মর্মে থাকে শ্রেণি ও বর্ণের রাজনীতি। টাইটানিক মুভিতেও আমরা জাহাজডুবির প্রেক্ষাপটরূপে জ্যাক আর রোজের বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ককে শনাক্ত করতে বাধ্য হই। টাইটানিক ঠিকঠাক গন্তব্যে পৌঁছাতে পারলে এই প্রেম হয়তো তিন দিনও টিকত না! জিজেক আরও এক ধাপ এগিয়ে বলছেন, গরিব জ্যাক আর অভিজাত রোজের এই ইউটোপিয়ান প্রেমখানি বাঁচানোর জন্যই টাইটানিককে ডুবতে হয়েছে।

মহামারিকে নৈতিক সংকটরূপে দেখার পেছনেও রাজনীতি আছে। অনৈতিক সম্পর্ক, অবৈধ অভিবাসী, বন্য প্রাণী পাচার, পরিবেশ ধ্বংস—যেভাবেই মহামারির গল্পটা শুরু হোক না কেন, শুরুটা কিন্তু প্রান্তে, অর্থাৎ তৃতীয় বিশ্বেই ঘটে। পশ্চিমা ন্যারেটিভ অনুযায়ী, সেটা হতে পারে এশিয়ার কোনো নোংরা কাঁচাবাজার অথবা আফ্রিকার কোনো জঙ্গল, ভূমধ্যসাগরের কোনো জনাকীর্ণ জাহাজ। ভ্যাকসিন অবশ্য পশ্চিমেই বানানো হবে।

মড়ার কোনো জাত নেই, একটা জাতপন্থী সমাজে ইন্দ্রনাথ শ্রীকান্তকে বলেছিল। প্যানডেমিক আমাদের সেই জাতহীন সমাজের ধারণা একটু একটু করে দেখাচ্ছে। করোনায় ধনী-গরিব, প্রাচ্য-প্রতীচ্যের কোনো ভেদ নেই। পশ্চিম যেভাবে মহামারিকে নৈতিক সংকট আকারে কল্পনা করে, তার মধ্যে জাতভেদ আছে, শুদ্ধতাবাদের ধারণা আছে, এমনকি বর্ণবাদও আছে। ফলে বিকসেলের বুড়োর পলিসিই ভালো। তৃতীয় বিশ্বের পলিসি। নতুন ভাষাব্যবস্থা। যা আমাদের মরতে দেবে না। আতঙ্কিত হতে দেবে না। এটাই তো ভালো। যেহেতু আর কোনো জ্ঞানগরিমা দিয়েই মৃত্যুর মিছিল থামানো যাচ্ছে না!