শহিদ সন্তানকে নিয়ে মায়ের প্রথম স্মৃতিকথা!

যুদ্ধাস্ত্র হাতে তরুণ নৌফেল।
যুদ্ধাস্ত্র হাতে তরুণ নৌফেল।

এ যেন আরেক জাহানারা ইমামের কাহিনি। একাত্তরে স্বাধীনতাযুদ্ধের বেদিমূলে উৎসর্গীকৃত প্রাণ আরেক রুমির জন্য তার মায়ের নীরব বুকফাটা কান্নার বাণীরূপ। এ বইয়ে যেন রুমিরই প্রতিরূপ। নৌফেল ছিল রুমির চেয়ে বছর দুইয়ের ছোট—লেখাপড়ার হিসাবে। রুমি আইএসসি পাস করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকেছিল। নৌফেল সবেমাত্র কলেজে আইএসসিতে ভর্তি হয়েছিল। দুজনেই ছিল আঠারো থেকে বিশের কোঠার টগবগে তরুণ। দুজনেই মুক্তিযুদ্ধের একাধিক দুঃসাহসিক অভিযানে অংশ নিয়েছিল। রুমির রণক্ষেত্র ছিল মূলত ঢাকাকেন্দ্রিক, আর নৌফেলের কেন্দ্র ছিল প্রতিবেশী ফরিদপুর। দুজনেই সম্মুখযুদ্ধে শহিদ হয়েছিল এবং দুজনেরই লাশের কোনো উদ্দেশ পাওয়া যায়নি, যুদ্ধ শেষে বিস্তর খোঁজখবর করা সত্ত্বেও।

মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ নৌফেল শাহাদত বরণ করেছিল ১৯৭১-এর ৯ ডিসেম্বর। অর্থাৎ বিজয় দিবসের মাত্র সাত দিন আগে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হয়। সেই স্বপ্নের স্বাধীনতা দেখে যেতে পারেনি নৌফেল। মাত্র ১৮ বছর বয়সে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সঙ্গে মুখোমুখি যুদ্ধে শহিদ হয় তরুণটি। জানা যায়, ফরিদপুরের করিমপুর নামক স্থানে সদর রাস্তার লাগোয়া এক কৃষকের জনশূন্য বাড়ির আঙিনায় অত্যন্ত নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় তাকে। তার দেহাবশেষও পাওয়া যায়নি আজ পর্যন্ত।

নৌফেলের মা বেগম ফাতেমা বারী তাঁর শহিদ পুত্রের নামাঙ্কিত নিজের বইয়ে লিখেছেন, ‘কোনো শান্তি নেই, কোনো সান্ত্বনা নেই, রচনা হয়নি আমার মেজবাহ উদ্দিন নৌফেলের শেষ সমাধি। খুঁজে পাওয়া যায়নি তার মৃতদেহের ছিটেফোঁটা অংশও। তাই রচিত হয়নি নবশ্যাম দুর্বাদলে ছাওয়া তার ক্ষুদ্র নিরলংকার সমাধি। নির্মল নীল আকাশ থেকে প্রত্যহ নিশীথে নিসৃত হয় না বিন্দু বিন্দু শিশির, প্রভাতে স্পর্শ করে না তরুণ অরুণের প্রথম কিরণরেখা। সন্ধ্যায় ছড়িয়ে পড়ে না গোধূলি আলোকের সোনালি আভা। জানি না কোথায় কোথায় হারিয়ে গেছে আমার সোনার সন্তানের দেহাবশেষ? কোথায় রচিত হয়েছে তার সমাধি?’

কোথাও রচিত হয়নি। এমনকি নৌফেলের নিজ শিক্ষায়তন ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজেও তিনি পরিণত হয়েছিলেন এক বিস্মৃতপ্রায় নামে। প্রিয় পুত্রকে এভাবে বিস্মরণে বিলুপ্তি থেকে বাঁচানোর জন্যই কলম ধরেছিলেন ফাতেমা বারী। তিনি লিখেছেন, ‘অভিশপ্ত এক মা আমি লিখে যাচ্ছি সেই করুণ কাহিনি। এই মর্মান্তিক কাহিনি রচনার জন্যই হয় তো আজও বেঁচে আছি অভাগিনী মাতা?’

মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ নৌফেল শহিদ হন ৯ ডিসেম্বর, ১৯৭১।
মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ নৌফেল শহিদ হন ৯ ডিসেম্বর, ১৯৭১।

ফাতেমা বারী ১৯৭১-এর ১২ বছর পর, অর্থাৎ ১৯৮৩ সাল নাগাদ যখন বইটা লিখছেন, তখনো শহিদ সন্তানকে নিয়ে কোনো মায়ের স্মৃতিকথা বোধ হয় প্রকাশিত হয়নি। তাই তিনি শুরুতেই লিখেছেন, ‘মনের ভার কমানোর জন্যও লিখতে হবে। এই বারো বছরের মধ্যে কোন মা-ই তো এগিয়ে এল না তার বুকের বেদনাবিধুর জায়গাটা প্রকাশ করে ছাপার অক্ষরে রেখে যেতে।’ ফাতেমা বারীর বইয়ের কথা বলতে গিয়ে শুরুতেই তুলনীয় হিসেবে যে বইটার কথা বলেছি, ‘শহিদজননী’ জাহানারা ইমামের সেই সাড়া জাগানো বই ‘একাত্তরের দিনগুলি’ প্রকাশিত হয়েছে তার আরও তিন বছর পর, ১৯৮৬ সালে। সেদিক থেকে বিচার করলে, ১৯৮৩ সালের ১ মার্চ প্রকাশিত ‘শহিদ মেজবাহ্ উদ্দিন নৌফেল’ বইটিকে মুক্তিযুদ্ধের কোনো শহিদের শোকাতুর জননীর প্রথম মুদ্রিত স্মৃতিচারণা হিসেবেও হয়তো গণ্য করতে পারি।

কিন্তু ক্ষীণকায় পুস্তকটি বৃহত্তর পাঠক সমাজের দৃষ্টির অন্তরালে থাকতে থাকতেই একসময় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে ১৯৮৫-তে বইটির লেখকও চলে গেলেন পরপারে। এরপর সবাই যখন শহিদ নৌফেল, তার নামাঙ্কিত বই, আর তার লেখক বেগম ফাতেমা বারীর কথা প্রায় ভুলেই গেছে, তখন বইটিকে ফের বিস্মৃতির অতল থেকে তুলে এনে বৃহত্তর পাঠকসমাজকে উপহার দিয়েছেন শহিদের ছোট বোন নাজমুন নাহার খান। বইটি পুনঃপ্রকাশ করতে গিয়ে তিনি এ বইয়ের ব্যাপক সংশোধন, পরিমার্জন, পরিবর্ধন করেছেন। যোগ করেছেন বইটির প্রথম প্রকাশের পরবর্তী প্রায় চার দশকে জমে ওঠা আরও অনেক তথ্য, আরও অনেক স্মৃতি। ভূমিকা অংশে রেখেছেন বিশিষ্ট লেখক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের মন্তব্য-মতামত। পরিশিষ্ট অংশে যুক্ত করেছেন নৌফেলের সহযোদ্ধাদের কয়েকজনের, তাঁর নিজের, তাঁর আরেক বোনের প্রত্যক্ষদর্শিতার স্মৃতিচারণা। এসবের ফলে বইটি প্রথম সংস্করণের তুলনায় ধারে-ভারে বেশ খানিকটা বৃহত্তর ও গুরুতর রূপ নিয়েই দেখা দিয়েছে এবারের বইমেলায়।

কিন্তু বইটির সারবস্তু লুকিয়ে আছে হারানো ছেলের জন্য মায়ের হাহাকার, দীর্ঘশ্বাস আর অশ্রুমথিত প্রতিটি শব্দে, বাক্যে। কল্পনা নয়, সত্য অনুভবের প্রতিফলন হিসেবে এ লেখা অনন্যসাধারণ তো বটেই, এর সাহিত্যমূল্যও একেবারে ফেলনা নয়। জাহানারা ইমামের মতো ফাতেমা বারীর লেখায়ও একটা রাবীন্দ্রিক ভাব নজর কাড়বেই।

নৌফেলের মা বেগম ফাতেমা বারী।
নৌফেলের মা বেগম ফাতেমা বারী।

‘ভরা দুপুর। আজ পহেলা ফাল্গুন। বসন্তের সমারোহ। মনটা উদাস হয়ে যায়। ঐ যে জানালার বাইরে মস্ত বড় পৃথিবীটা চুপ করে আছে, ওটাকেই কি বেশি ভালোবাসি? নইলে সন্তান বিসর্জন দিয়ে আজ কোন আকর্ষণে বেঁচে আছি। ঐ কুহকিনী স্বাধীনতায় লুব্ধ হয়েই তো আমার সন্তান ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুক্তিসংগ্রামে।’

‘এই গাছপালা, নদী-মাঠ, কোলাহল, নিস্তব্ধতা, প্রভাত, সন্ধ্যা—সমস্তটা দুই হাতে আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছা করে। মনে হয়, পৃথিবীর কাছ থেকে জোর করে আমার সন্তানকে ছিনিয়ে নিয়ে আসি।’

লেখার এ ভঙ্গি কি আমাদের মনে করিয়ে দেয় না রবীন্দ্রনাথের ‘ছিন্নপত্র’-এর কোনো চিঠি বা ‘পোস্টমাস্টার’–এর মতো কোনো ছোটগল্পের কথা? সত্যি বলতে কি, জাহানারা ইমাম হোন বা ফাতেমা বারী—বিগত শতকের চল্লিশের দশকের দিকে জন্ম নেওয়া কেই–বা পেরেছে কলম হাতে নিয়ে রবীন্দ্রপ্রভাবকে অগ্রাহ্য করতে?

ইতিহাস ও সাহিত্যমূল্য—দুদিক থেকেই বইটি পাঠযোগ্য বটে। আসলে এ ধরনের বইগুলোতেই টুকরো টুকরো বিধৃত ও বিবৃত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সত্য ইতিহাস। এসব টুকরো-টাকরা জোগাড় করালেই সুস্পষ্ট পরিস্ফূট হয়ে উঠবে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে জাতির অকুতোভয় অংশগ্রহণের সম্পূর্ণ মানচিত্র।

‘শহিদ মেজবাহ্ উদ্দিন নৌফেল’
বেগম ফাতেমা বারী
পাঠাগার প্রকাশনী
মূল্য: ২৫০ টাকা