ওদের জন্য ভালোবাসা

অবসরে যাওয়ার পর কোথায় একটু হাত-পা ছড়িয়ে আরাম-আয়েশ করবেন, তা নয়, যুক্তরাজ্যের ব্রুস ইংলেফিল্ড থিতু হলেন তাসমানিয়ার এক জঙ্গলে! গড়ে তুললেন বিশাল এক উদ্যান। ব্রুসের ভালোবাসা এবং একক প্রচেষ্টায় বিশাল এক ফাড়া থেকে বেঁচে গেল ‘তাসমানিয়ান ডেভিল’ নামের একদল বিরল প্রাণী।২০০১ সালের সুন্দর একটা সকাল। রাস্তার মৃদু কোলাহল ছাপিয়ে পাখপাখালির কিচিরমিচিরে মুখরিত চারপাশ। ইউক্যালিপটাসের চিরল পাতায় খেলে যায় ঝিরিঝিরি বাতাস। ব্রুস হাঁটছিলেন তাঁর গড়া ওয়াইল্ড লাইফ পার্কের নিরিবিলি এক পথ ধরে। যুক্তরাজ্যের একটি টেলিভিশনের টেকনিক্যাল ডিরেক্টর পদ থেকে অবসর নেওয়ার পর ব্রুস পুরোদস্তুর কৃষক বনে গিয়েছিলেন। তবে মাস ছয়েক আগে তাসমানিয়ার পূর্ব উপকূলবর্তী বিচেনো শহরের পাশের এই জায়গাটিতে সস্ত্রীক ঘুরতে এসেছিলেন তিনি। ছবির মতো সুন্দর একটা জায়গা! তখনই হুট করে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন, জায়গাটি হাতছাড়া করবেন না। স্ত্রী মরিনও তাতে একমত। পাক্কা ২৮ হেক্টর জমি কিনে ব্রুস ফোন করলেন মেয়ে সান্দ্রাকে, ‘জামাতা আর দুই নানুকে নিয়ে শিগগির এখানে চলে এসো। একটা উদ্যান বানাতে চাইছি।’ ব্যস তা-ই সই। বন্ধুরা অনেক হাসিঠাট্টা করল। কেউ কেউ পরামর্শ দিল, এই বুড়ো বয়সে একটু আরাম-আয়েশ করো গে। কিন্তু ৫১ বছর বয়সে যে মানুষ এনিমেল বিহ্যাভিয়রের ওপর এমএসসি শেষ করেছেন, তাঁকে কী আর সহজেই নিরস্ত করা যায় এসব থেকে? পশুপাখি আর জল-জঙ্গলের সঙ্গে যে ব্রুসের নাড়ির টান। সেই টান পকেটের টানকেও হার মানায় একসময়। ব্রুসের বয়স তখন ৫৮। ক্যালেন্ডারে ২০০১-এর এপ্রিল। গোড়াপত্তন হয় ব্রুসের ওয়াইল্ড লাইফ পার্কের।কদিন ধরেই বন বিড়ালের বড় বাড় বেড়েছিল সেই পার্কে। ব্রুস তাই সীমানাবেড়ার গা ঘেঁষে ফাঁদ পেতে রেখেছিলেন বাছাধনদের একহাত দেখে নেওয়ার আশায়। কিন্তু একহাত দেখে নেওয়ার আগে অদ্ভুত এক প্রাণী দেখে বিস্মিত হতে হয় তাঁকে। ব্রুসের ভাষায়, ‘প্রাণীটির মুখ দেখতে ঠিক কুকুরের মতো, গোঁফ বিড়ালের, পেছনের পা জোড়া ক্যাঙ্গারুর, ভালুকের পশম আর চোয়াল পুরো কুমিরের মতো। প্রথম দেখাতেই চিনে ফেলেছিলাম প্রাণীটি আর কিছু না, তাসমানিয়ান ডেভিল। প্রখর শ্রুতিশক্তি, আদর্শ মা এঁরা। নিকষ কালো আঁধারেও ৪৮ কিলোমিটার পর্যন্ত ছুটতে পারে। মাংসাশী হলেও খুব বিপদে না পড়লে মানুষের ক্ষতি করে না। আর এই তাসমানিয়ান ডেভিল দুনিয়ার জীবিত মাংসাশী মারসুপিয়ালের (ক্যাঙ্গারু গোত্রভুক্ত প্রাণী) মধ্যে একমাত্র।’ তবে ব্রুস সেই সকালে প্রাণীটিকে দেখে যতটা না বিস্মিত হয়েছিলেন, তার থেকে বেশি বিস্মিত হয়েছিলেন প্রাণীটির হাল দেখে। কারণ, ফাঁদে আটকে পড়া ডেভিলটির এক চোখ ছিল কানা। সারা শরীরে অজস্র ক্ষত! দেরি না করে অসুস্থ প্রাণীটিকে পশুচিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান ব্রুস। চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞরা সব দেখেশুনে বললেন, সারকোমার ধাত (সারকোমা হলো এক ধরনের মারাত্মক টিউমার)। আরও জানালেন, ইদানীং চারপাশেই এই অজানা রোগের কথা শোনা যাচ্ছে। ব্রুসের মাথায় বাজ পড়ল। দিব্যদৃষ্টিতে দেখলেন, তাঁর সাধের পার্কের লালবাতি জ্বলে গেছে। কারণ, সেখানে অধিকাংশ দর্শনার্থীই আসে এই তাসমানিয়ান ডেভিল দেখতে। তবে অমন বিপদের সময় ঘোরতর আরেক বিপদে পড়লেন ব্রুস। হঠাৎ একদিন ফোন এল, মেয়ে সান্দ্রা নাকি গাড়ি দুর্ঘটনায় মস্তিষ্কে চরম আঘাতপ্রাপ্ত! বিপদ কখনো একা আসে না—কথাটি সত্য হলো তাঁর জীবনে।২০০৩ সালে দুজন প্রাণীবিশেষজ্ঞ জানালেন, ডেভিলদের এই রোগ প্রাণঘাতী। নাম ডেভিল ফেসিয়াল টিউমার ডিজিজ (ডিএফটিডি)। এই রোগে আক্রান্ত প্রাণী মাস খানেকের মধ্যেই মারা পড়ে। মাছি, নীল জিহ্বার টিকটিকি, পাখি, মশা, মানুষ এমনকি বাতাসের মাধ্যমেও তা ছড়াতে পারে। তাতেই খটকা লাগল ব্রুসের। তাঁর পার্কের আক্রান্ত সব ডেভিলই ছিল বুনো। অথচ পার্কের ভেতরে জন্ম নেওয়া ডেভিলগুলো ছিল পুরোপুরি সুস্থ! রোগটি যদি বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায়, তাহলে তো ওদের সুস্থ থাকার কথা নয়! তাহলে? উত্তর দিলেন অ্যানি-মারি পিয়ারসে নামের এক প্রজনন এবং ডেভিল বিশেষজ্ঞ। আক্রান্ত ডেভিলের টিস্যু পরীক্ষা করে অ্যানি জানালেন, ‘এই রোগ ছড়াচ্ছে আসলে অসুস্থ ডেভিলের কামড় থেকেই।’ এদিকে তাসমানিয়া সরকার ব্রুসকে নির্দেশ দিল, ‘তোমার পালিত ডেভিলগুলোকে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দাও।’ তা কানেই তুললেন না ব্রুস। যুক্তি দেখালেন তাঁর সিদ্ধান্তের পক্ষে।তবে ২০০৬ সালে হঠাৎ এক বুদ্ধি খেলে যায় ব্রুসের মাথায়। পার্কের ১১ হেক্টর জায়গা ডেভিলদের জন্য বেড়া দিয়ে ঘিরে দেন তিনি। যাতে করে বাইরের কোনো অসুস্থ ডেভিল ভেতরে ঢুকতে না পারে। পাশাপাশি তাসমানিয়া সরকারের কাছে আবেদন জানান, ‘ডেভিলদের রক্ষার জন্য একটা ফান্ড তৈরি করে দিন।’ কিন্তু কেউ কথা শোনেনি। ‘তবে একলা চলো রে’ বলে কাজে নেমে পড়েন স্বয়ং ব্রুস। সিদ্ধান্ত নেন লন্ডন ম্যারাথনে নামবেন ফান্ডের জন্য। কিন্তু তাঁর ৬৪ কিলোগ্রাম ওজনের শরীরের কারণে সেবার বিফল মনোরথে পিছু হটতে হয়েছিল। শুরু করেন কঠোর পরিশ্রম, অনুশীলন। পরিশ্রমের সুফল পান ২০০৮-এর লন্ডন ম্যারাথনে। প্রচণ্ড ঠান্ডা, প্রবল তুষারপাত এবং বয়সের ভার—সবকিছুই হার মানে তাঁর ভালোবাসার কাছে। একটানা চার ঘণ্টা ৫২ মিনিট দৌড়ে ম্যারাথন শেষ করেন ব্রুস! দৌড়ের সময় তাঁর মাথায় নাকি কেবল ডেভিলদের কথাই ঘুরছিল। দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন—বিপন্ন প্রাণীগুলোর জন্য কিছু একটা করতেই হবে। ঠিকই তিনি ‘কিছু একটা’ করলেন। ডেভিলদের জন্য ম্যারাথনে দৌড়ানোর ফলেই এক লাখ ২১ হাজার ৫০০ ডলার জমা হলো ফান্ডে। সেই টাকায় ২০০৬-এর ১৮ মে প্রতিষ্ঠিত হলো ‘ডেভিল আইল্যান্ড’। এখন সেখানে নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে তাসমানিয়ান ডেভিলগুলো। পুরোনো ডেভিলগুলোর ৯৮ শতাংশই অবশ্য চিরবিদায় নিয়েছে এরই মধ্যে। তবে ব্রুসের ১১ হেক্টর জমিতে গড়ে ওঠা ‘ডেভিল আইল্যান্ডে’ এখন আশা জিইয়ে রেখেছে ১১টি পূর্ণবয়স্ক ডেভিল ও তাদের ছানা-পোনারা। আর ব্রুস বলছেন, ‘আমার জন্মই হয়েছে আসলে এখানে থাকার জন্য।’ (ব্রুসের মেয়ে সান্দ্রা এখন আগের থেকে ভালো আছে। এখনো চিকিৎসা ও পরিচর্যা চলছে নিয়মিত।)রিডার্স ডাইজেস্ট অবলম্বনে মাহফুজ রহমান