স্বার্থপরতার দিন

হাতে হাতে স্যানিটাইজার-মাস্ক-গ্লাভসের প্যাকেট। কারও হাতে বড় কার্টন। ছেলেটা বুকের সামনে চেপে রাখা প্যাকেটের লেখা পড়ে—নেবুলাইজার, অক্সিজেন কনসেনট্রেটর। অক্সিজেনের মেশিনটা ভারী, হাতে ওঠানো কঠিন। বাবা লাইনে দাঁড়িয়ে পাশে রাখে, বলে, ‘কতক্ষণ দাঁড়াব, লোকজনের নিশ্বাস নাকে-মুখে ঢুকে যাচ্ছে!’ হাতের উল্টো পিঠে মাস্কটা জায়গামতো বসায় দুজনে। ছেলেও দেখাদেখি নাকটা ভালোমতো ঢেকে নেয়।

‘দেখ তো, তোর মা যা যা লিখেছে, সব নেওয়া হলো নাকি?’

ছেলে ফোনে তাকিয়ে তালিকায় চোখ বোলায়, ‘ভিটামিন সি বাদ গেছে, বাবা। নেই।’ ব্যস্ত ওষুধকর্মীর দিকে তাকিয়ে বাবা খেঁকিয়ে ওঠে, ‘ভিটামিন সি নেই কেন? দায়িত্বজ্ঞান থাকা উচিত নয়, মানে, এই সময়ে ওটা কত দরকার, জানা আছে না আপনাদের?’

দোকানের লোকটা নির্লিপ্ত। ক্লান্ত গলায় বলে, ‘আছিল। থাকতেছে না।’ পরমুহূর্তে সামনের ক্রেতাকে অক্সিজেন কনসেনট্রেটরের ব্যবহার শেখাতে ব্যস্ত হয়, ‘এই যে, ডিস্টিল্ড ওয়াটার দিবেন এইখানে। নলটা নাকে এইভাবে বসাবেন।’ 

‘আসলে, কখন বুঝব যে এটা লাগবে?’ ক্রেতার সরল প্রশ্নে যারপরনাই বিরক্ত হয় ওষুধকর্মী। বিরক্তি ভাব লুকাতে গিয়ে হিসাবে মন দেয়, বিড়বিড় করে বলে, ‘কিনতে হইব, তা যখন বুঝছেন...যাউকগা, স্যানিটাইজারটা আমার কাছে দুই শ কার্টন আছে। পরেও পাবেন। একলগে পাঁচ কার্টন নিলে...পরে দাম বাড়বে কিন্তু।’

ক্রেতার পাঁচ কার্টনই লাগবে। দুর্গার মতো আরও কিছু হাত থাকলে আরও কয়েক কার্টন নিয়ে লাইনে দাঁড়ানো যেত।

ছেলের মায়ের ফোন, ‘শোনো, আরিয়ানের বন্ধু রোহান আছে না? ওরা না কোন ক্লিনিকের কাকে ধরে একটা ভেন্টিলেটর ম্যানেজ করে ফেলেছে। বাসায় এনেছে, বুঝেছ? আমাদের কী হবে?’

বাবা চিন্তায় পড়ে, ‘সত্যি, কী যে হবে আমাদের!’ পাশে রাখা এতগুলো বাক্সকে অর্থহীন লাগে তখন। মৃত্যু কি তবে আসবেই? মানে, এত টাকা-পয়সা থাকতেও...পরমুহূর্তে বলে, ‘তবে জ্বর-শ্বাসকষ্টে মানুষ যা নেয়, সব যে খোঁজ করে লিখে দিলে, সেসব লাগবে না?’

‘তা তো লাগবেই। কিন্তু ভেন্টিলেটর না থাকলে শেষপর্যন্ত কি...’ 

‘এনি প্রবলেম?’ ছেলে জানতে চায়।

‘আসলে হয়েছে কী, তোর মা কত দিন হলো না বুটিকে যেতে পারে, না ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডে, কী কিনলে যে ওর ভালো লাগবে...’

দোকানটায় যাচ্ছেতাই ভীড়। গায়ে গা লাগিয়ে একেকজন অপেক্ষমাণ। কেউ কেউ পাগলের মতো শেলফে এটা–সেটা হাতড়ে মরে। সাধারণ সাবান-শ্যাম্পুর তাকটাও প্রায় খালি। এরই মধ্যে কোত্থেকে পেছন থেকে একজন বিদেশি প্রায় হুমড়ি খেয়ে কাউন্টারে পড়ে, জানতে চায়, ‘ডু ইউ হ্যাভ মাল্টিভিটামিনস? ফ্রম ব্ল্যাক মোরস?’ বাবা নাক সিঁটকায়, ‘উহ্ এই ফরেনারটার সঙ্গে ধাক্কা খেলাম, কী যে আছে কপালে!’ বাবা-ছেলে অনেক কষ্টে দাম দিয়ে বেরিয়ে আসে।

প্রেসক্রিপশন পয়েন্টের সামনে বনানীর ১১ নম্বর রাস্তায় তখন বিকেল। বেরোনোর মুখে কণ্ঠার হাড় উঁচিয়ে রোগা-পটকা একটা লোক পথ আগলে ধরে। হাত পাতে, মলিন পাঞ্জাবির ফেঁসে যাওয়া হাতাটা গোটানো, ‘হাঁপানির রোগী, বাবা, মেশিনটা দেড় মাস চলে, আঠারো দিন হইল শ্যাষ হইছে, খুব কষ্ট পাইতেছি।’ বলতে গিয়ে বারকয়েক বিরতি নিয়ে শ্বাস নিতে হয় তাকে।

‘কোন মেশিনের কথা বলে, বাবা?’ ছেলে জানতে চায়।

‘আরে, ওই ইনহেলারের কথা’, কাছেই দাঁড়ানো গাড়িকে ইশারা করতে করতে বলে বাবা। 

‘যেটা আমরা দশটা কিনলাম?...এর করোনা নাকি, বাবা?’

বাবা-ছেলে ছিটকে সরে। গাড়িতে উঠতে গিয়ে বাবা মুখ কুঁচকে বলে, ‘অ্যাই, সরো দেখি, এত কাছে আসছ কেন?’

হাপরের মতো বুকে লোকটা হাঁপায়, ‘একটা মেশিন আমারে দিয়া যান, বাবা, দামও দ্বিগুণ হইয়া গেছে। কষ্ট পাইতেছি...আল্লায় আপনের ভালো করব, দোয়া করি। খালি একটা মেশিন...’

‘উহ্ কী বিপদ, এ কি কাচের এদিক থেকে কী কিনছি, সেটা দেখছিল? সেয়ানা ফকির তো! কে জানে এর নিশ্বাস থেকে আবার করোনা...উহ্ সরো দেখি!’

‘করুনা না, হাঁপানি, খালি হাঁপানি।’

কথা বন্ধ করে লোকটা হাঁপায়। মেলে রাখা হাতটা কাঁপে। 

গাড়ির দরজা বন্ধ হয়। সুনসান রাস্তায় গাড়িটা একপলকে উধাও।