মহামারির মহা-উপন্যাস আমাদের যা শেখায়

লন্ডনের ১৬৬৫ সালের প্লেগের সময় সলোমন ইগল নাম এক কোয়েকার ঐশ্বরিক ক্রোধের কথা প্রচারে উন্মাদপ্রায়, ড্যানিয়েল ডেফোর “আ জার্নাল অব দা প্লেগ ইয়ার”(১৭২২) থেকে
লন্ডনের ১৬৬৫ সালের প্লেগের সময় সলোমন ইগল নাম এক কোয়েকার ঐশ্বরিক ক্রোধের কথা প্রচারে উন্মাদপ্রায়, ড্যানিয়েল ডেফোর “আ জার্নাল অব দা প্লেগ ইয়ার”(১৭২২) থেকে

করোনা মহামারির প্রাদুর্ভাব ঘটার আগেই ২০০৬ সালের নোবেলজয়ী লেখক ওরহান পামুক ঘটনাচক্রে তাঁর পরবর্তী উপন্যাস রচনার জন্যে মহামারির ইতিহাস ও সাহিত্য পর্যালোচনায় রত ছিলেন। এই লেখায় তিনি আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন পশ্চিমা উপাখ্যানে পাশ্চাত্যের প্রাচ্যবিরোধী সংস্কারের ঐতিহাসিক পরম্পরা। অটোমান ইতিহাস থেকে তিনি খুঁজে বের করেছেন একদিকে ইস্তাম্বুলবাসীর বিধিনিষেধের প্রতি অনীহা, অন্যদিকে সংকটে অবিচল মানবিকতার অনন্য কিছু নিদর্শন।

ইস্তাম্বুল—চার বছর ধরে আমি একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখছি, যার পটভূমিতে রয়েছে ১৯০১ সালের তৃতীয় প্লেগ মহামারি। সেবার এশিয়াতে লাখ লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল, তুলনামূলকভাবে ইউরোপে প্রাণহানি ঘটেছিল কম। আমার বন্ধুবান্ধব, পরিবার-পরিজন, চেনাজানা সম্পাদক আর সাংবাদিকেরা জানেন কী নিয়ে আমি এই 'নাইটস অব প্লেগ' উপন্যাসটি লিখছি, দুই মাস ধরে তাঁরা প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে যাচ্ছেন আমাকে।

তাঁদের কৌতূহলের বিষয় হলো অতীতের প্লেগ ও কলেরার সঙ্গে এখনকার করোনাভাইরাস মহামারির সাদৃশ্য আছে কি না। সাদৃশ্য আসলেই আছে। ইতিহাস ও সাহিত্যের মহামারিগুলো আসলেই একই রকম, কিন্তু তা জীবাণু বা ভাইরাসের কারণে নয়, বরং আমাদের অভিন্ন প্রারম্ভিক প্রতিক্রিয়ার কারণে। অবধারিতভাবে মহামারির আবির্ভাবের পর প্রথম প্রতিক্রিয়া হলো তার উপস্থিতি অস্বীকার করা। প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেখা যায় জাতীয় ও স্থানীয় সরকার সময়মতো ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ। তথ্য ও উপাত্ত বিকৃত করে মহামারির ভয়াবহতাকে কমিয়ে দেখানোর নজিরও ইতিহাসে ভূরিভূরি।

আলেসান্দ্রো মানজোনির “দা বিট্রথেড” প্রকাশিত হয় ১৮২৭ সালে
আলেসান্দ্রো মানজোনির “দা বিট্রথেড” প্রকাশিত হয় ১৮২৭ সালে

সাহিত্যে রোগবিস্তার ও মানব প্রকৃতি নিয়ে জানতে একটি অতুলনীয় বই ড্যানিয়েল ডেফোর 'আ জার্নাল অব দ্য প্লেগ ইয়ার'। এর শুরুর পৃষ্ঠাগুলোতে উঠে এসেছে কীভাবে লন্ডনের কিছু এলাকার কর্তৃপক্ষ প্লেগ থেকে মৃতের সংখ্যা কমিয়ে দেখাতে মৃত্যুর কারণ হিসেবে বিবিধ নতুন রোগ আবিষ্কার করে ফেলেন। ইতালির আলেসান্দ্রো মানজোনির ১৮২৭ সালের উপন্যাস 'দ্য বিট্রথেড' সম্ভবত প্লেগের ধ্বংসযজ্ঞ নিয়ে লেখা সবচাইতে বাস্তববাদী সাহিত্যকর্মের একটি। মানজোনি মিলানে ১৬৩০ সালের প্লেগের সময়কালীন কর্তৃপক্ষের অদক্ষতার কারণে স্থানীয় মানুষের সঙ্গত ক্ষোভের কথা লিখেছেন। প্লেগ ধেয়ে আসছে—এর অকাট্য প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও মিলানের গভর্নর স্থানীয় ছোটখাট রাজবংশের কোনো এক রাজপুত্রের জন্মদিনের উৎসব পর্যন্ত বাতিল করেননি। মানজোনির লেখায় দেখা যায়, কীভাবে মিলানে দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়েছিল ঘাতক প্লেগ, যার মূলে ছিল কর্তৃপক্ষের অপ্রতুল ব্যবস্থা গ্রহণ, আইন প্রয়োগে শৈথিল্য এবং নাগরিকদের হেলাফেলা।

সাহিত্যে যখনই সংক্রামক ব্যাধির কথা এসেছে, তখনই জনরোষের মূল কারণ হিসেবে উঠে এসেছে ক্ষমতাবানদের অযোগ্যতা, স্বার্থপরতা ও ঔদাসীন্যর কথা। কিন্তু ডেফো বা কামুর মতো সেরা লেখকদের কাজে আমরা আভাস পাই অন্য কিছুর, এমন সংকটে জনমানুষের ক্ষোভের অন্তর্নিহিত কারণ কেবল রাজনৈতিকই নয়, এর মধ্যে আরও রয়েছে একান্ত মানবীয় কিছু বিষয়। ডেফোর উপন্যাসে আমরা দেখি জনতার সীমাহীন ক্ষোভের পেছনে রয়েছে নিয়তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, মানুষের মৃত্যু আর দুর্ভোগের সামনে ঈশ্বরের নীরব দর্শক এবং প্রশ্রয়দাতার ভূমিকার বিরুদ্ধে এবং সংকটকালে সংঘবদ্ধ ধর্মগুলোর কিংকর্তব্যবিমূঢ় দশার বিরুদ্ধে অসন্তোষ।

মহামারিকালীন আরেকটি বিশ্বজনীন মানবিক প্রতিক্রিয়া হলো গুজব আর অপতথ্যের উৎপাদন, যা আপাতদৃষ্টিতে অপ্ররোচিত। দূরবর্তী অতীতে যথাযথ তথ্য এবং সম্যক ধারণা পাওয়া অসম্ভব ছিল বলে গুজব সৃষ্টি ছিল অনিবার্য। ডেফো এবং মানজোনি দুজনেই লিখেছেন মানুষ কীভাবে দেখা হলে দূরত্ব বজায় রেখেও অন্যকে এলাকার খবরাখবর জিজ্ঞেস করত, যাতে তারা পরিস্থিতির একটা সামগ্রিক ধারণা পেতে পারে। কোথায় নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধান পাওয়া যাবে, তা বুঝতে এ ছাড়া অন্য কোনো উপায় তাদের ছিল না। সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশন বা ইন্টারনেট-বিবর্জিত জগতে সংখ্যাগরিষ্ঠ নিরক্ষর মানুষের কাছে কোথায় বিপদ আছে, তা কতটা গুরুতর আর তাতে পতিত হলে দুর্ভোগ কেমন, তা আঁচ করতে একমাত্র সম্বল ছিল তাদের কল্পনাশক্তি।

প্লেগের প্রাদুর্ভাবে সবচেয়ে আগে যে গুজব রটে, তার বিষয়বস্তু হলো, কে এই রোগ ছড়াল আর কোথা থেকে তা এল। এ বছরই মার্চের মাঝামাঝি ইস্তাম্বুলের জিহাঙ্গীর এলাকায় আমার ব্যাংকের ম্যানেজার আমাকে বিজ্ঞের মতো বলেছিলেন এই 'জিনিসটা' হলো আমেরিকা এবং বাকি বিশ্বের বিরুদ্ধে চীনের অর্থনৈতিক বদলা। যুগে যুগে অন্য যেকোনো অশুভ শক্তির মতো মহামারিকে সব সময় ধরা হয়েছে একটা বহিরাগত সমস্যা হিসেবে। আমরা মনে করি সংক্রামক ব্যাধি সব সময়ই প্রথমে অন্য কোথাও দেখা দেয়, আর সেখানকার মানুষ তা সামলাতে ব্যর্থ হলে রোগ ছড়িয়ে পড়ে। যেমন, গ্রিসের প্রাচীন ঐতিহাসিক থুসিদিদিস (Thucydides) এথেন্সের মড়কের বিবরণে শুরুতেই উল্লেখ করেন যে এই মড়ক শুরু হয়েছিল 'মিশর বা ইথিওপিয়া'-র মতো দূরবর্তী কোনো এলাকায়। আমাদের কল্পনায় সংক্রামক ব্যাধি সব সময়ই ভিনদেশি, বাইরে থেকে তা আসে এবং কেউ তা নিয়ে আসে অসৎ উদ্দেশ্যে। ব্যাধির আদি বাহকদের নামগোত্রপরিচয়-বিষয়ক জনশ্রুতি তাই সব সময়ই সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং সর্বাধিক প্রচারিত হয়।

মানজোনির “দা বিট্রথেড” (১৮২৭) থেকে একটি অলংকরণ
মানজোনির “দা বিট্রথেড” (১৮২৭) থেকে একটি অলংকরণ

'দ্য বিট্রথেড'-এ মানজোনি আমাদের এক পৈশাচিক চরিত্রের কথা বলেছেন, যা ইউরোপে মধ্যযুগের প্রতিটি মহামারিতে মানুষের কল্পনায় স্থায়ীভাবে একটা স্থান দখল করে নিয়েছিল। তখন মুখে মুখে ফিরত এক অশুভ উপস্থিতির কথা, যে রোজ রাতের অন্ধকারে রোগের জীবাণুদুষ্ট তরল দিয়ে দরজার হাতল আর পানির ফোয়ারা দূষিত করে দিয়ে যায়। কিংবা শোনা যেত কোনো পরিশ্রান্ত বৃদ্ধের কথা, যে চার্চের মেঝেতে জিরিয়ে নিতে বসলে হঠাৎ পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া কোন নারী দাবি করত যে বৃদ্ধ রোগ ছড়িয়ে দিতে তার জীবাণুদুষ্ট কোটটাকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সবকিছুতে ঘষে দিচ্ছে। অনতিবিলম্বে জড়ো হয়ে যেত মারমুখী জনতা।

ইউরোপীয় রেনেসাঁর সময় থেকে মহামারির বিবরণে সহিংসতা, জনশ্রুতি, আতঙ্ক এবং বিক্ষোভের এ ধরনের অপ্রত্যাশিত এবং দুর্দমনীয় বিস্ফোরণের কথা প্রায়ই পাওয়া যায়। রোমান সাম্রাজ্যে গুটিবসন্তের আনতোনিন মহামারির জন্য মার্কাস অরেলিয়াস খ্রিস্টানদের দায়ী করেন, কেননা, তারা রোমান দেবতাদের তুষ্টির জন্যে আয়োজিত আচারানুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। পরবর্তীকালে প্লেগের সময় মুসলিম অটোমান সাম্রাজ্য এবং খ্রিষ্টান ইউরোপ, উভয় ক্ষেত্রেই কুয়ার পানি দূষিত করার দায়ে ইহুদিরা অভিযুক্ত হয়।

মহামারির ইতিহাস এবং সাহিত্য থেকে আমরা বুঝতে পারি যে আক্রান্ত জনগোষ্ঠীর মধ্যে রোগের যন্ত্রণা, মৃত্যুভয়, আধ্যাত্মিক আতঙ্ক এবং অশনি অনুভূতি কতটা প্রবল, তার ওপর নির্ভর করে তাদের ক্রোধ এবং রাজনৈতিক অসন্তোষের মাত্রা। অতীতের মতোই এবারের করোনাভাইরাস মহামারিতে জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও আঞ্চলিক পরিচয়নির্ভর ভিত্তিহীন গুজব এবং অপবাদ ঘটনাপ্রবাহের ওপর একটা বড় প্রভাব বিস্তার করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং লোকরঞ্জনবাদী ডানপন্থী প্রচারমাধ্যমের মিথ্যাকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানোর প্রবণতাও এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু পার্থক্য হলো যে বিরাজমান মহামারির বিষয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্য পাবার যে পরিমাণ সুযোগ আমাদের এখন আছে, অতীতে তা কখনোই ছিল না। একারণেই আমরা এখন যে শক্তিশালী এবং যৌক্তিক ভীতি বোধ করছি, তা অভূতপূর্ব। আমাদের এখনকার ভীতি গুজবের মাধ্যমে নয়, বরং নির্ভুল তথ্যের ভিত্তিতে সৃষ্ট। আমরা আজ যখন বিশ্বের মানচিত্রে দেখছি, দেশে দেশে লাল দাগগুলো বেড়েই চলেছে, আমরা বুঝতে পারছি, পালানোর কোনো জায়গা নেই। চূড়ান্ত দুরবস্থা নিয়ে আতঙ্কিত হবার জন্যে আমাদের কল্পনার আশ্রয় নিতে হচ্ছে না। আমরা চাক্ষুষ দেখতে পাচ্ছি, ইতালিতে কালো সামরিক ট্রাক লাশের পর লাশ বয়ে নিয়ে যাচ্ছে, এ যেন আমাদের নিজেদেরই শবযাত্রা।

আমাদের মনে এখন যে আতঙ্ক, তা যাবতীয় জল্পনাকল্পনা এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্রকে এক পাশে ঠেলে দিয়ে বিশ্বজুড়ে আমাদের জীবনের ভঙ্গুরতা এবং মানবতার অপ্রত্যাশিত অভিন্নতাকে স্পষ্ট করে তুলেছে। মৃত্যুচিন্তার মতোই ভয় আমাদেরকে একাকী করে দেয়। কিন্তু আমরা সবাই একই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, এই উপলব্ধি আমাদের সেই একাকিত্ব থেকে মুক্তি দেয়। কোথায় এবং কী করে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে, বাজার থেকে আনা খাদ্যদ্রব্য কীভাবে নিরাপদে ব্যবহার করা যায়, নিজ উদ্যোগে সঙ্গনিরোধে চলে যাওয়া উচিত কি না—থাইল্যান্ড থেকে নিউইয়র্ক, গোটা বিশ্বের মানুষ আজ একই সব বিষয়ে ভাবছে। আমাদের মনে পড়ে, বিপদে আমরা একা নই। আমাদের হৃদয়ে জেগে ওঠে সংহতি। ভয়ে বিবশ হয়ে না থেকে বরং আমরা নিজেদের আবিষ্কার করি পারস্পরিক বোঝাপড়ার জন্য পূর্ণ নতজানু অবস্থায়।

টিভির পর্দায় বিশ্বের বৃহত্তম হাসপাতালগুলোর বাইরে অপেক্ষমাণ মানুষের ভিড় যখন আমার চোখে পড়ে, আমি বুঝতে পারি, আমার মনের আতঙ্ক বিশ্বমানবতার একটি অভিন্ন অনুভূতি। আমার আর একাকী লাগে না। সময়ের সঙ্গে আমি আমার ভীতি নিয়ে লজ্জা পাই না, বুঝতে পারি এটি একটি যৌক্তিক প্রতিক্রিয়া। মহামারি বিষয়ে একটি আপ্তবাক্য আমার মনে পড়ে যায়: যারা ভয় পায়, তারাই টিকে যায়। একপর্যায়ে বুঝি যে আতঙ্ক আমার মধ্যে, হয়তো সবার মধ্যেই দুটি স্বতন্ত্র অনুভূতির জন্ম দেয়: একদিকে তা আমাকে অন্তর্মুখী করে তোলে, নিঃসঙ্গতা এবং নীরবতার দিকে ধাবিত করে। অন্যদিকে তা আমাকে অন্যের প্রতি বিনম্র করে তোলে, সংহতির শিক্ষা দেয়।

মহামারি নিয়ে একটি উপন্যাস লেখার স্বপ্ন আমি প্রথম দেখা শুরু করি আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে। শুরু থেকেই আমার ভাবনার কেন্দ্রে ছিল মৃত্যুভয়। সুলতান সুলেমানের আমলে অটোমান সাম্রাজ্যে হ্যাপ্সবর্গ সাম্রাজ্যের রাজদূত ছিলেন অজিয়ের গিসলন দে বুস্বেক (Ogier Ghiselin de Busbecq)। ১৫৬১ সালে ইস্তাম্বুলে প্লেগ দেখা দিলে তিনি ছয় ঘণ্টা দূরে প্রিনকিপো দ্বীপে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এটি ছিল ইস্তাম্বুলের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে মারমারা সাগরে অবস্থিত দ্বীপমালার সর্ববৃহৎ দ্বীপ। তিনি লক্ষ করেন, ইস্তাম্বুলে কোয়ারেনটিনের প্রয়োগ ছিল তুলনামূলকভাবে অনেক শিথিল এবং মতামত দেন যে তুর্কিদের অদৃষ্টবাদিতাই এর কারণ, যার মূলে রয়েছে তাদের ইসলামি ধর্মবিশ্বাস। এর প্রায় দেড় শতাব্দী পর প্রাজ্ঞ ডেফোও তার লন্ডনের প্লেগ-বিষয়ক উপন্যাসে লেখেন, 'তুর্কি আর মোহামেডানরা অদৃষ্টের কথা প্রচার করছে, বলছে প্রতিটি মানুষের ভবিতব্য দৈবনির্ধারিত।' আমি ভেবেছিলাম আমার উপন্যাসটি আধুনিকতা এবং সেকুলারিজমের পটভূমিকায় মুসলিম অদৃষ্টবাদ নিয়ে ভাবতে সাহায্য করবে।

ড্যানিয়েল ডেফোর “আ জার্নাল অব দা প্লেগ ইয়ার”(১৭২২) থেকে গণকবরে মৃতদেহ ফেলার দৃশ্য
ড্যানিয়েল ডেফোর “আ জার্নাল অব দা প্লেগ ইয়ার”(১৭২২) থেকে গণকবরে মৃতদেহ ফেলার দৃশ্য

অদৃষ্টবাদিতা বা অন্য যে কারণেই হোক, ঐতিহাসিকভাবেই অন্তত অটোমান সাম্রাজ্যের ক্ষেত্রে খ্রিষ্টানদের তুলনায় মুসলিমদেরকে কোয়ারেনটিন মানিয়ে চলতে বেগ পেতে হয়েছে। ধর্মনির্বিশেষে দোকানদার এবং গ্রামীণ জনগোষ্ঠী অর্থনৈতিক কারণে কোয়ারেনটিন মানতে আপত্তি তুললেও মুসলিমদের ক্ষেত্রে নারীর পর্দা এবং পারিবারিক গোপনীয়তা রক্ষার প্রশ্নে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠত। ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে দেখা যায় মুসলিম জনতা মুসলিম চিকিৎসকের দাবি তুলছে, কেননা, তখন পর্যন্ত চিকিৎসা পেশায় খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বীদের আধিপত্য বিরাজমান। মুসলিম অটোমান সাম্রাজ্যও তার ব্যতিক্রম ছিল না।

১৮৫০ সালের পর থেকে বাষ্পীয় জাহাজে ভ্রমণের খরচ কমে এলে মক্কা এবং মদিনাগামী মুসলিমরা হয়ে ওঠেন বিশ্বজুড়ে সংক্রামক ব্যাধির শীর্ষস্থানীয় ধারক ও বাহক। বিংশ শতাব্দীর প্রাক্কালে মক্কা ও মদিনায় তীর্থযাত্রীদের উভমুখী প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে ব্রিটিশরা মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ায় বিশ্বের একটি প্রথম কোয়ারেনটিন দপ্তর প্রতিষ্ঠা করে। ইতিহাসের এই ঘটনাচক্রে কিছু বদ্ধমূল ধারণা দানা বাঁধে, যেমন মুসলিমরা অদৃষ্টবাদী এবং কেবল মুসলিম নয়, মোটের ওপর এশিয়ার মানুষ সংক্রামক ব্যাধির উৎপাদক এবং বাহক। পশ্চিমা সাহিত্যের এই একই সংস্কার থেকে ফিওদর দস্তয়ভস্কি 'ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট' উপন্যাসে মূল চরিত্র রাসকলনিকভের দুঃস্বপ্নের বিবরণে লিখেছেন, 'সে দেখল সারা পৃথিবী বিচিত্র এক নতুন মহামারিতে আক্রান্ত, যা এশিয়ার গহিন থেকে ইউরোপকে এসে গ্রাস করেছে।'

১৭ ও ১৮ শতকের মানচিত্রসমূহে দানিউব নদীকে প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের সীমারেখা হিসেবে বিবেচনা করা হত। তা মূলত অটোমান সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক সীমান্ত, যেখান থেকে পাশ্চাত্যের ওপারে বাকি পৃথিবীর শুরু। এই দুই জগতের রাজনৈতিক সীমানা তৈরি করেছিল দানিউব নদী আর সাংস্কৃতিক ও নৃতাত্ত্বিক সীমারেখা এঁকে দিয়েছিল প্লেগ। কারণ দানিউবের পশ্চিমের চেয়ে পূর্বে প্লেগে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি ছিল বেশি। এভাবে বিভিন্ন উপায়ে এই পশ্চিমা সংস্কারটি তৈরি হয় যে অদৃষ্টবাদিতা প্রাচ্য এবং এশীয় সংস্কৃতির একটি সহজাত বৈশিষ্ট্য। সেইসঙ্গে জোরদার হয় এই ভ্রান্ত ধারণা যে প্লেগ ও অন্যান্য মহামারি সর্বদাই প্রাচ্যের কোনো অন্ধকার গুপ্তস্থান থেকে উদ্ভূত হয়।

তুরস্কের বিভিন্ন স্থানীয় ঐতিহাসিক বয়ানে দেখা যায়, প্লেগের প্রকোপ যখন তুঙ্গে, তখনো ইস্তাম্বুলের মসজিদগুলো দাফনের বন্দোবস্ত বহাল রেখেছিল। শোকাভিভূত মানুষ তখনো একে অন্যের সঙ্গে দেখা করে শোক প্রকাশ ও অশ্রুসজল আলিঙ্গন বিনিময় করত। ব্যাধি কোথা থেকে এল আর কীভাবে ছড়াল, তা নিয়ে ব্যস্ত না হয়ে পরবর্তী শেষকৃত্যের আয়োজনের প্রস্তুতি ছিল তাদের চিন্তার বিষয়।

ওরহান পামুক
ওরহান পামুক

অথচ এবারের করোনাভাইরাস মহামারিতে তুরস্কের সরকার একটি সেক্যুলার পন্থা গ্রহণ করেছে। করোনাভাইরাস রোগে মৃতদের জানাজায় জমায়েত এবং শুক্রবারে মসজিদে জুমা বন্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। এই দুই ক্ষেত্রেই সবচেয়ে বেশি মানুষ একত্রিত হয়ে থাকে। কিন্তু তুরস্কের নাগরিকেরা তাতে আপত্তি তোলেননি। আমাদের মানুষের আতঙ্ক যতটা তীব্র, ততটাই সহনশীল এবং বিবেচক তাঁদের হৃদয়। এই সংকটে আমাদের মধ্যে যে বিনম্রতা এবং সংহতির অনুভূতি জেগে উঠেছে, মহামারির পর একটি মহত্তর পৃথিবী আশা করতে হলে তাকেই আঁকড়ে ধরে লালন করতে হবে আমাদের সবাইকে।

[নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত। মূল তুর্কি ভাষা থেকে ইংরেজি অনুবাদ করেছেন একিন ওকলাপ।]