কবিতা বই

একদিন ভোরে ঘুম ভাঙতে নিজেকে আবিষ্কার করলাম এক কিশোরীর বুক শেলফে; আমি আর মানুষ নই, এখন থেকে আমি একটা বই, কবিতার বই।

আমার মলাটে মায়ের একটা ছবি; তার পরনে তাতের শাড়ি, হাতে চুড়ি, কপালে ঘাম, ঠোঁটে হাসি আর কালো দুই চোখে কিসের যেন আতঙ্ক। মা আমাকে বললেন, 'ভয় পাইস না, সামনে আগায়া যা। আমি তো আছি তোর সাথে।'

আমি সামনে এগোই, আমাকে উৎসর্গ করা হয়েছে যার নামে, সে-ও একজন নারী, আমার প্রেমিকা; চৈত্র মাসের কাঠফাটা রোদ্দুরে চৌচির হওয়া খোলা মাঠে যে আমাকে ছায়া দিয়েছিল একদা! আবার সে-ই আমাকে ছেড়ে চলে গেছে কোনো এক অগ্রহায়ণে, কারণে কিংবা অকারণে!

সূচিপত্রের শুরুতেই বাবার নাম লেখা; রোজ সকালে অফিসে যান আর সন্ধ্যায় ফেরেন। দিন-রাত সারাক্ষণ আপ্রাণ চেষ্টা করেন আমার কবিতাগুলোর ছন্দ যেন ঠিক থাকে!

কবিতা শুরু হয় যে পৃষ্ঠাটায়, সেখানে আমার শৈশব; আমি মায়ের কোলে বসে বাবার গলার গান শুনি, পৃষ্ঠা ওল্টাই, আমার ভাই আমাকে টানে খেলতে যেতে, আমি যাই খেলার মাঠে, আমার বোন আমার চুল বাঁধার বৃথা চেষ্টা করে, আমার কপালে চুমু দেয়, আমার পিঠে চিমটি কাটে, আমরা সবাই মিলে হাসি, হাসতে হাসতে পরের পাতায় যাই।

নতুন কবিতায় দেখা হয় আমার নতুন বন্ধু সুজিত; এক ক্লাসে পড়ি, একসাথে খাই একসাথে ঘুরে বেড়াই। সুজিতের বাবা বেকার, মা কাজ করে পরের বাসায়। একদিন হঠাৎ সুজিত স্কুলে আসে না, পরদিন আসে না, তার পরদিনও তার দেখা নাই। জানতে পারি সুজিত পরপারে পাড়ি দিয়েছে ভীষণ অবেলায়, অনাহারে, অপঘাতে। পৃষ্ঠা ওল্টাই—

নতুন কবিতা, নতুন জীবন, নতুন গল্প শুরু; গল্পের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা লাস্যময়ী ডাগর চোখের মেয়েটা আমাকে ডাকে, তার পিছে যাই, তার কথা শুনি, তার পথে দিন গুনি—পথ শেষ হয় নতুন পথে, আমি দাঁড়াই, পাতা ওলটাই...

মহাকাল আমার সামনে দাঁড়িয়ে, আমি তার মুখোমুখি; ফাঁকা পৃষ্ঠায় নীরব কবিতা, নিবিড় গাঁথুনি, কবিতা আমায় জীবন দিয়েছে, কবিতা আমার খুনি!

শেষ পৃষ্ঠা শেষ হয়ে গেলে কেঁদে ওঠে কিশোরী, বুকের মধ্যে জাপটে ধরে আমাকে, তার হৃদ্স্পন্দনে বাজে আমার জীবনের প্রতিধ্বনি।