নামগুলো সব 'সঞ্চয়িতা'র

বহুদিন বাদে ফের রবীন্দ্রনাথের নির্বাচিত কবিতা সংকলন 'সঞ্চয়িতা' হাতে নিয়ে বসলাম। পড়া হলো কিছু কবিতা, কিছুদূর গিয়ে মনে হলো, আরে, এই রবীন্দ্রবাক্য দিয়ে তো কারও গোটা একটা বইয়ের নামকরণ হয়েছে; বইটি পড়ার অনেক পর জেনেছি নামটা আহৃত 'সঞ্চয়িতা' থেকে। তারপর একটা ভাবনা এল মনে, 'সঞ্চয়িতা' থেকে চয়িত নাম অন্য লেখকদের যেসব বইয়ের শিরোনামে ব্যবহৃত হয়েছে, তার একটা মোটাদাগের তালিকা আমার খসড়া-খাতায় তুলে রাখলে কেমন হয়! ভাবনাকে বাস্তবতা দিতে সম্ভোগীর চেয়ে অনেকটা সন্ধানীর দৃষ্টিতে পড়লাম পুরো 'সঞ্ আমার প্রতারক পাঠস্মৃতি উজিয়ে যা কিছু মনে এল, সেই সব নাম টুকে রাখলাম এই লেখার পরিসরে।

এই এলোমেলো কাজটি করতে গিয়ে বুঝলাম, প্রকৃতপক্ষে 'গীতবিতান' থেকেই বহুলাংশ নাম ঋণ করেছেন রবীন্দ্র-সমসাময়িক কি উত্তরকালের লেখককুল। তবে এ লেখায় 'সঞ্চয়িতা'য় অন্তর্ভুক্ত 'গীতবিতান' অংশ থেকে নেওয়া নামও উল্লেখ-তালিকায় রাখা হয়েছে। বিপুলসংখ্যক রবীন্দ্রকবিতায় এমন অনেক পঙ্‌ক্তির দেখা মেলে, যারা আজ লোকসিদ্ধ প্রবচন; সেসব নিয়ে আলাদা সংকলন আছে বিধায় আমরা এ মুক্তলেখায় কেবল বর্তমান লেখকের জানাশোনার পরিধিতে পাওয়া 'সঞ্চয়িতা' থেকে নেওয়া বাংলা বইয়ের নাম ও লেখক-তালিকা সংকলনের প্রয়াস চালানো হলো। এ তালিকা নিঃসন্দেহে অসম্পূর্ণ ; ভবিষ্যতে আরও নিবিষ্ট অনুসন্ধানে নিশ্চয়ই একে পূর্ণাঙ্গ করবেন কোনো না কোনো সুধী গবেষক।

noname
noname

'মানসী' বইয়ের 'বধূ' কবিতায় কবি বলেন—

'হায় রে রাজধানী পাষাণকায়া!
বিরাট মুঠিতলে চাপিছে দৃঢ়বলে
ব্যাকুল বালিকারে, নাহিকো মায়া।
কোথা সে খোলা মাঠ, উদার পথঘাট-
পাখির গান কই, বনের ছায়া।'

এই কবিতা থেকে শহীদ আখন্দ তাঁর উপন্যাসের নাম করেছেন 'পাখির গান, বনের ছায়া'। 'শ্যামলী' বইয়ের 'আমি' কবিতায় আমরা পড়ি—
'আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ।'
শহীদ আখন্দের আর একটি উপন্যাসের নাম 'পান্না হল সবুজ'।
'মানসী'রই আরেকটি কবিতা 'বর্ষার দিনে' আছে—
'সমাজ সংসার মিছে সব,
মিছে এ জীবনের কলরব।'
সনৎকুমার সাহার একটি প্রবন্ধ-বইয়ের নাম আছে 'সমাজ সংসার কলরব'।
'সোনার তরী'র 'নিরুদ্দেশ যাত্রা' কবিতার পাঠ নিতে নিতে মনে পড়ে যায় আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের একটি বহুখ্যাত গল্পেরও নাম 'নিরুদ্দেশ যাত্রা'।
'কল্পনা' বইয়ের 'দুঃসময়' কবিতার 'যদিও সঙ্গী নাহি অনন্ত অম্বরে' থেকে হুমায়ূন আহমেদ তাঁর আত্মজৈবনিক একটি বইয়ের নাম করেছেন 'অনন্ত অম্বরে' আর একই কবিতার 'এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা' থেকে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তাঁর প্রবন্ধ-বইয়ের নাম দিয়েছেন 'বন্ধ করো না পাখা'। হুমায়ূন আহমেদ 'গীতিমাল্য' বইয়ের 'সার্থক বেদনা' কবিতা থেকে তাঁর আরও একটি স্মৃতিগ্রন্থের নাম রেখেছেন। 'আমার সকল কাঁটা ধন্য করে ফুটবে গো ফুল ফুটবে' থেকে তাঁর বইয়ের নাম করা হয়েছে 'সকল কাঁটা ধন্য করে।' হুমায়ূনের আরও বহু বইয়ের নাম রবীন্দ্রনাথ থেকে নেওয়া, তবে এর সিংহভাগই 'গীতবিতান' থেকে চয়িত বলে এখানে সে আলোচনা নাই-বা হলো।

'ক্ষণিকা' বইয়ের 'এক গাঁয়ে' কবিতা থেকে নেওয়া হয়েছে বিধায়ক ভট্টাচার্যের দুটো বিখ্যাত বাংলা নাটকের নাম৷ 'আমরা দুজন একটি গাঁয়ে থাকি' আর 'আমাদের সেই তাহার নামটি রঞ্জনা' থেকে নাটকদ্বয়ের শিরোনাম যথাক্রমে 'একটি গাঁয়ে থাকি' এবং 'তাহার নামটি রঞ্জনা'।
'নৈবেদ্য' বইয়ের 'প্রার্থনা' কবিতার শুরুতেই সেই স্মরণীয় রবীন্দ্রবাক্য—
'চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির'।
প্রয়াত অর্থমন্ত্রী শাহ এম এস কিবরিয়ার একটি কলাম-সংকলনের নাম 'চিত্ত যেথা ভয়শূন্য'।
'উৎসর্গ' বইয়ের শুরুতেই—
'আমি চঞ্চল হে,
আমি সুদূরের পিয়াসি।'
বুদ্ধদেব বসুর ভ্রমণবইয়ের নাম 'আমি চঞ্চল হে'। তাঁর প্রথম প্রবন্ধ-বইয়ের নাম 'হঠাৎ-আলোর ঝলকানি'-ও নেওয়া হয়েছে 'মহুয়া' বইয়ের 'পথের বাঁধন' কবিতা থেকে, যেখানে বলা হয়েছে—
'হঠাৎ-আলোর ঝলকানি লেগে ঝলমল করে চিত্ত।'
মিতকথার কবিতা-বই 'লেখন'-এর ২১ সংখ্যক কবিতাটি এমন—
'ফুলগুলি যেন কথা,
পাতাগুলি যেন চারি দিকে তার
পুঞ্জিত নীরবতা।'
আমাদের নিশ্চয়ই স্মরণে আছে দ্বিজেন শর্মার পুষ্পবিদ্যার এক অনন্য বই 'ফুলগুলি যেন কথা'। আর 'আরোগ্য' বইয়ের একটি কবিতার নামেই দ্বিজেন শর্মার আত্মজীবনীর নাম 'মধুময় পৃথিবীর ধূলি'।
'গীতিমাল্য' বইয়ের 'পথ-চাওয়া' কবিতাংশ থেকে সেলিনা হোসেন তাঁর স্মৃতিগ্রন্থের নাম রেখেছেন 'পথ-চাওয়াতেই আনন্দ'। '
'বলাকা' বইয়ের 'শঙ্খ' কবিতার প্রথম দুই পঙ্‌ক্তি—
'তোমার শঙ্খ ধূলায় প'ড়ে, কেমন করে সইব!
বাতাস আলো গেল মরে, একি রে দুর্দৈব!'
মনজুরে মওলার একটি কলাম সংকলন 'একি দুর্দৈব'।
'বলাকা'র 'ছবি' কবিতা থেকেই অভিজিৎ রায়ের বিজ্ঞানবিষয়ক বইয়ের নাম হয়েছে 'আলো-হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী'।
একই বইয়ের 'শাজাহান' কবিতার যুগজয়ী পঙ্‌ক্তি—
'কালের কপোলতলে শুভ্র সমুজ্জ্বল

এ তাজমহল' থেকেই মালেকা বেগম তাঁর একটি বইয়ের নাম রেখেছেন 'শুভ্র সমুজ্জ্বল।'
'পরিশেষ' বইয়ের 'বাঁশি' কবিতায় পড়ি—
'কিনু গোয়ালার গলি।
দোতলা বাড়ির
লোহার-গরাদ-দেওয়া একতলা ঘর
পথের ধারেই।'
আমরা মনে করতে পারি, সন্তোষকুমার ঘোষের সেই আলোচিত উপন্যাসের নাম 'কিনু গোয়ালার গলি।'
'সানাই' বইয়ের 'রূপকথায়' কবিতায় পড়ি—
'সাত সাগরের ফেনায় ফেনায় মিশে
যাই ভেসে দূর দিশে,
পরীর দেশের বদ্ধ দুয়ার দিই হানা
মনে মনে।'
এই কবিতাংশ থেকেই বেলাল চৌধুরী তাঁর একটি স্মৃতিগ্রন্থের নাম রাখেন 'সাত সাগরের ফেনায় ফেনায় মিশে'।
'গীতিমাল্য' বইয়ের 'সুরের আগুন' কবিতার নামে কবি গোলাম কুদ্দুস শিল্পী কে মল্লিকের জীবন নিয়ে লেখা উপন্যাসের নাম দিয়েছেন 'সুরের আগুন' আর একই কবিতার শেষ পঙ্‌ক্তি 'আগুনের কী গুণ আছে কে জানে।' থেকে জহুরুল হক তাঁর বিজ্ঞানবিষয়ক বইয়ের নাম দিয়েছেন 'আগুনের কী গুণ'।
'গীতালি' বইয়ের 'পরশমণি' কবিতার প্রথম পঙ্‌ক্তি 'আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে' থেকে হুমায়ূন আহমেদ তাঁর নামকরা উপন্যাস ও চলচ্চিত্রের নাম রেখেছেন 'আগুনের পরশমণি'।
'শ্যামলী' বইয়ের 'হঠাৎ দেখা' কবিতায় আমাদের বহু পড়া -
'একটুকু রইলেম চুপ করে;
তারপর বললেম,
“রাতের সব তারাই আছে
দিনের আলোর গভীরে।”'
স্মরণে আসে কবি আতাউর রহমানের আত্মজীবনী 'রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে।'

'গীতাঞ্জলি'র 'বেলাশেষে' কবিতার নামেই বেদূইন সামাদের উপন্যাস 'বেলাশেষে'।
'জন্মদিনে' বইয়ের 'ঐকতান' কবিতার প্রারম্ভ-ভাগ—
'বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি!' আনিসুজ্জামানের আত্মজীবনীর একাংশের নাম 'বিপুলা পৃথিবী'।

'শেষ লেখা' বইয়ের 'রূপ-নারানের কূলে' কবিতার এই অংশ কে না পড়েছি আমরা—
'রূপ-নারানের কূলে
জেগে উঠিলাম;
জানিলাম এ জগৎ
স্বপ্ন নয়।
রক্তের অক্ষরে দেখিলাম
আপনার রূপ—'

noname
noname

রিজিয়া রহমানের কালজয়ী উপন্যাসের নাম এখান থেকেই চয়িত 'রক্তের অক্ষর'।
এই বইয়েরই 'প্রথম দিনের সূর্য' কবিতার নামে শামসুল আলম সাইদ ভারতবর্ষের স্বাধীনতা-সংগ্রামীদের নিয়ে একটি বইয়ের নাম দিয়েছেন 'প্রথম দিনের সূর্য'।
'শেষ লেখা' বইয়ের 'তোমার সৃষ্টির পথ' রবীন্দ্রনাথের লেখা শেষ কবিতা। এই নামেই আনিসুজ্জামান তাঁর রবীন্দ্রবিষয়ক প্রবন্ধ সংকলনের নামকরণ করেন 'তোমার সৃষ্টির পথ'।
'শেষ সপ্তক' বইয়ের 'পঁচিশে বৈশাখ' কবিতায় রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন—
'পঁচিশে বৈশাখ চলেছে
জন্মদিনের ধারাকে বহন ক'রে
মৃত্যুদিনের দিকে।
সেই চলতি আসনের উপর ব'সে কোন কারিগর গাঁথছে
ছোটো ছোটো জন্মমৃত্যুর সীমানায়
নানা রবীন্দ্রনাথের একখানা মালা।'
আবুল হাসনাত বাংলাদেশের কবি-লেখকদের রবীন্দ্রবিষয়ক গদ্যগুচ্ছ সম্পাদনা করেছেন 'নানা রবীন্দ্রনাথের মালা' শিরোনামে।
এভাবেই পঁচিশে বৈশাখে কেবল জন্মদিনের ধারাকে মৃত্যুদিনের দিকে বহন করে নিয়ে চলে না বরং পঁচিশে বৈশাখের বিরল জাতক তাঁর বাক্যবিভূতিতে সমকালীন ও উত্তরকালীন লেখকের সৃজনঘরে নিরন্তর জাগরূক থাকেন আচ্ছন্নতার বারান্দা হয়ে।