বুরা

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী
অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

পৃথিবীর সব বৃষ্টি আজ ফুরাবে। মধ্যরাত থেকে অঝোরে নেমেছে। ধরে অল্প সময়ের জন্য, আবার স্টার্ট নেয়। স্টার্ট। ইস্টার্ট। এত বৃষ্টি কোন হ্যান্ডলম্যান ইস্টার্ট দেয়? পুরোনো দিনের কথা মনে পড়ে বুরা মিয়ার? কত পুরোনো? আড়াই-তিন কুড়ি বছর আগের কম না। বাসের হ্যান্ডলম্যান ছিল বুরা মিয়া। নাক লম্বা বাস। হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে ইঞ্জিন ইস্টার্ট দিতে হতো।

‘তুই এই দুনিয়ার সেরা হ্যান্ডলম্যান বুরা।’

পুলু ওস্তাদ বলতেন। বাবা খাজা নূর পরিবহন-২–এর পাইলট রাস্তার রাজা পুলু ওস্তাদ। মস্ত গোঁফঅলা হাঁকডাকের মানুষ। ষন্ডামতো দেখতে হলেও পুলু ওস্তাদ কখনো মানুষ মারেননি।

হ্যান্ডলঅলা বাস উঠে যাবে একদিন, এটা তারা কেউ কখনো ভাবেনি। না পুলু ওস্তাদ, না বুরা মিয়া। তবে ওস্তাদ হলেন পাইলট। তার কিছু সমস্যা হয়নি। সমস্যা হলো বুরা মিয়ার। সারা জীবন বাসের হ্যান্ডলম্যান থাকবে, এই ছিল তার একমাত্র স্বপ্ন। ইতুবিবি দেখে বড় খুশি হয়েছিল।

‘আপনে বাস ইস্টাট দিয়া দেন! ও আল্লাহ, আপনে একদিন না থাকলে বাস কেমনে চলব?’

সন্তানসন্ততি তাদের হয়নি। ইতুবিবি আতকা জ্বরে মরল। বিয়ের বয়স ছিল বুরা মিয়ার। সে আর বিয়ে করেনি। ইতুবিবি পরিবহন-২ নামে একটা বাস এখনো তার স্বপ্নে ‘হরন’ দিয়ে যায়। ইতুবিবি পরিবহন-২–এর হ্যান্ডলম্যান সে। তাকে ছাড়া ইতুবিবি পরিবহন-২ ইস্টার্ট নেয় না।

বুরা কেন সে? বুরা মিয়া?

তার আগে তার বাপ–মায়ের আরও আটখান ছাওয়াল হয়েছিল। কেউ থাকেনি। মসজিদের ইমাম সাব এ জন্য তার নাম বুরা রাখতে বলেছিলেন বাপকে। বুরা অর্থ মন্দ। নামে দোষ কাটে। সে মরেনি। এখনো মরেনি।

ওরে বৃষ্টি রে! বৃষ্টির লুটপাট। টিনের চালে বৃষ্টি এক রকম। শণের চালায় বৃষ্টি আরেক রকম। বুরা মিয়ার ঘর শণের। এমনিতেই দিক–দিশা নেই—এ রকম ঘুমে ধরে তার, বৃষ্টির শব্দে আরও ধরল। তার শরীর এখনো যথেষ্ট মজবুত। বিমার ধরে না। আতকা ধরেছে। জ্বর, কাশি। কয়ছর বলছিল, করোনা না হয়। বুরা মিয়া করোনার কথা শুনেছে। চৌদ্দ দিন আগে টাউনে গিয়েছিল সে। বিনোদ ‘কম্পান্ডার’ সুই ফুটিয়ে অর্ধেক সিরিঞ্জমতো রক্ত রেখে দিয়ে খরখরে গলায় বলেছে, ‘চৌদ্দ দিন পরে রিপোট দিমু।’

‘বুরা দাদা! ও বুরা দাদা!’

কেউ ডাকে?

‘ও-ও-ও বুরা দাদা।’

ডাকে সহিদা। কয়ছরের বউ। বুরা মিয়ার দূরসম্পর্কের নাতি কয়ছর। না-ও হতে পারে। তবে বুরা মিয়া তার উঠানের কানায় ঘর তুলে থাকতে দিয়েছে এদের। সহিদা তার ভাতটা–সালুনটা রান্না করে দেয়। হুঁকা সাজিয়ে দেয়।

সামান্য জ্বর আছে আজও শরীরে। সহিদা বুরা মিয়ার কপালে হাত দিয়ে বলল, ‘ও মানুষ! ও মানুষ!’

সহিদা না ইতুবিবি বলল? সহিদা কেন বলবে? ইতুবিবি বলত।

‘ও মানুষ, উঠেন।’

বুরা মিয়া তাকিয়ে ইতুবিবিকে দেখল। কিশোরী ইতুবিবি। বিনুনি করেছে, লাল ফিতা পরেছে। চোখে কাজল। কুপির আলো ঝিকমিক করছে তার দুই চোখের তারায়। বুরা মিয়া বোবা হলো, কী বলবে?

ইতুবিবি বলল, ‘ও মানুষ, গাড়ি ইস্টাট দিবেন না।’

গাড়ি ইস্টার্ট দেবে! বুরা মিয়ার সব রক্তকণিকা চনমন করে উঠল।

‘ও মানুষ!’

বুরা মিয়া উঠল। দরজা খুলে যা দেখল, সেটাকে বলে দুয়ারে প্রস্তুত গাড়ি। ইতুবিবি পরিবহন-২। আরে! পাইলট দেখি কয়ছর। হ্যান্ডল ঘুরিয়ে ইঞ্জিন ইস্টার্ট দিল বুরা মিয়া। গাড়ি চলল। লাফ দিয়ে গাড়ির ফুটবোর্ডে উঠে পড়ল বুরা মিয়া।

ধরে ধরে বৃষ্টি পরদিন সকালেও থাকল এবং সহিদার চিলচিৎকার বৃষ্টির মেঘ বিদীর্ণ করল। বুরা দাদা তার ঘরে নেই! পাড়ার লোক জমল। বৃষ্টির মধ্যেই টাউনে গিয়েছিল কয়ছর। বৃষ্টির মধ্যেই ফিরল। বুরা মিয়ার রক্তের রিপোর্ট নিয়ে ফিরেছে। বিনোদ ‘কম্পান্ডার’ হাসিমুখে বলেছে, ‘বুরার মরণ নাই। করোনা নেগেটিভ।’

সহিদা আবার কাঁদল। কয়ছর বলল, ‘এই নটীর বেটি কান্দন বন কর। তোর কান্দনে তোর ছিনালির বুরা দাদা আর ফিরব? কুনুদিন ফিরব?’

কান্না বন্ধ করল, খরচোখে তাকাল সহিদা, হিসহিস করে বলল, ‘ফিরব না, কী করছ তুমি? কী করছ?’

কয়ছর চোখ লাল করে তাকাল।

সহিদা আর কাঁদল না, কিছু বলল না, গলা টিপে ধরল কয়ছরের।

পাড়ার লোক দেখল। বৃষ্টি ধরল।