শিপ জাম্পার হাবিব উল্লাহর গল্প

হাবিব উল্লাহ
হাবিব উল্লাহ

দূর থেকে আমেরিকা দেখতে কেমন? সন্দেহ নেই, আমেরিকা কারও কাছে স্বপ্নপুরী, আবার কারও কাছে দুঃস্বপ্নের দেশ। তবে মানুষমাত্রই স্বপ্নতাড়িত। স্বপ্নকে হাতের মুঠোয় নিয়ে মানুষ এক দেশ থেকে আরেক দেশে ভেসে বেড়ায়। পূর্ব বাংলা থেকে আসা হাবিব উল্লাহ ছিলেন তাদেরই একজন।

হাবিব উল্লাহ ইংরেজি তেমন ভালো জানতেন না। ১৯৪০ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে জাহাজের খালাসি হয়ে পূর্ব বাংলার নোয়াখালী থেকে আমেরিকা চলে এসেছিলেন তিনি। নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষাকে সম্বল করেই তাঁর শুরু হয়েছিল আমেরিকার জীবন। আমেরিকায় প্রথমে বোস্টন অঙ্গরাজ্যে, তারপর সেখান থেকে নিউইয়র্কের ম্যানহাটানে ৫৩ লেক্সিংটন অ্যাভিনিউতে একটি ইতালিয়ান রেস্তোরাঁয় ডিশওয়াশারের কাজ নেন হাবিব উল্লাহ। লেক্সিংটনেই তিনি পরিচিত হন পূর্ব বাংলা থেকে আগত আরেক জাহাজের সারেং ইব্রাহিম চৌধুরীর সঙ্গে। লেক্সিংটন থেকে কিছুদিন পর তিনি চলে যান আফ্রিকান এবং স্প্যানিশ অধ্যুষিত এলাকা হারলেমে। হারলেমকে তখন বলা হতো নির্যাতিত মানুষের শহর। শুরু হয় হাবিব উল্লাহর নিউইয়র্ক জীবন।

হারলেম সম্পর্কে দুটো কথা আপনাদের আগেই জানিয়ে রাখতে চাই। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে শুধু বাঙালি অভিবাসী নয়, বলা যায় গোটা পৃথিবীর মজলুম মানুষদের চোখ ছিল নিউইয়র্কের হারলেমের দিকে। হারলেম তখন পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে আসা শ্রমজীবী মানুষের শহর। বিশেষ করে আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলের লোকজন হারলেমের বিভিন্ন জায়গায় তাদের বাসা বাঁধে। হারলেমকে তখন বলা হতো, ' নিউইয়র্কের স্বপ্নপূরণের শহর'। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নির্যাতিত আর অত্যাচারিত মানুষের শহরে পরিণত হয় হারলেম। হারলেম হয়ে ওঠে ক্যারিবিয়ান, আফ্রিকান, জ্যামাইকান, বাহামাস, লেটিনোস এবং দক্ষিণ এশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের মানুষের তীর্থস্থান। হারলেমের এই শ্রমজীবী মানুষের গোড়াপত্তন শুরু হয় ১৯১০ সাল থেকে ১৯৩০ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত। বলা প্রয়োজন যে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি বা ভারতীয় বাঙালিরা সাধারণত পূর্ব হারলেম অর্থাৎ স্প্যানিশ হারলেমকে বসবাসের জন্য বেছে নিয়েছিলেন।

হারলেম ছিল প্রচুর স্প্যানিশ ও পুয়ের্তোরিকানদের বসবাস। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বাঙালিরা হারলেম উপকণ্ঠে নিজেদের বসত গড়তে শুরু করেছিলেন। তাদের কেউ কেউ কোনো কৃষ্ণাঙ্গ বা স্প্যানিশ মহিলাকে বিয়ে করে সেখানে স্থায়ী হয়ে যেতেন। আরেকটা বিষয় লক্ষ করার মতো যে বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে নিউইয়র্কে বাঙালিদের মাঝে পুয়ের্তোরিকান মেয়ে বিয়ে করার একটি ধুম পরে যায়। বলার অপেক্ষা রাখে না যে বৈধ কাগজপত্র তৈরি করা ছিল এখানে প্রধান উদ্দেশ্য। হাবিব উল্লাহও তাদের মধ্যে একজন। এই হারলেমে এসেই হাবিব উল্লাহর সঙ্গে পরিচয় হয় পুয়ের্তোরিকা থেকে আগত নারী ভিকতোরিয়া ইচেভেরিয়ার সঙ্গে। প্রথম পরিচয়েই প্রেম এবং তারপর বিয়ে। ভিকতোরিয়া ইচেভেরিয়া তখন সবেমাত্র পুয়ের্তোরিকো থেকে আমেরিকায় এসেছেন। তিনি তার সাত বোনের মাঝে সবচেয়ে বড় এবং যখন তাঁর বয়স উনিশ, ঠিক তখনই তার বাবা হার্ট অ্যাটাক করে মারা যান। পূর্ব হারলেমে আগে থেকেই ভিকতোরিয়ার খালা এবং তার খালাতো ভাইবোনেরা থাকত। তিনি তাদের সঙ্গেই থাকতে শুরু করলেন। ভিকতোরিয়া একটি ফ্যাক্টরিতে কাজ করতেন এবং তখনই হাবিব উল্লাহর সঙ্গে পরিচয় হয়। হাবিব উল্লাহ তখন হারলেমের ১২৫ রাস্তা এবং ফেডরিক ডগলাস অ্যাভিনিউতে একটি হট ডগের দোকানে কাজ করতেন। হট ডগ দোকানটির মালিক ছিলেন একজন ইহুদি। ভিকতোরিয়াকে বিয়ের পর থেকে শুরু হয় হাবিব উল্লাহর আরেক নতুন জীবন।

ভিকতোরিয়া ইচেভেরিয়া
ভিকতোরিয়া ইচেভেরিয়া

তবে হাবিব উল্লাহর সবচেয়ে বড় পরিচয় তাঁর 'বেঙ্গল গার্ডেন' রেস্তোরাঁর জন্যে। হাবিব উল্লাহ, ইব্রাহিম চৌধুরী এবং ভিকতোরিয়া উল্লাহ—এই তিনজন মিলে ১৯৪৯ সালে নিউইয়র্ক শহরের ব্যস্ততম নাটকপাড়া বলে খ্যাত টাইম স্কয়্যারের ৪৬ রাস্তায় 'বেঙ্গল গার্ডেন' নামে একটি রেস্তোরাঁ খুলেছিলেন। তিন অংশীদার তাঁদের কাজ ভাগ করে নিয়ে রেস্তোরাঁটি চালাতেন। হাবিব উল্লাহর দায়িত্ব ছিলেন রান্নাবান্না। ইব্রাহিম চৌধুরী ইংরেজি ভাষায় দক্ষ হওয়ার কারণে তিনি খদ্দেরদের সঙ্গে কথা বলতেন এবং তাঁদের কাছ থেকে অর্ডার নিতেন। আর ভিকতোরিয়া বসতেন ক্যাশ রেজিস্টারে। তিনি টাকা-পয়সা লেনদেনের বিষয়টা দেখতেন।

কিন্তু দুঃখজনকভাবে 'বেঙ্গল গার্ডেন' রেস্তোরাঁটি মাত্র বছর দুয়েক পরই বন্ধ হয়ে যায়। হাবিব উল্লাহর ছেলে হাবিব উল্লাহ জুনিয়রের ভাষায়, 'সে সময় রেস্তোরাঁটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার মূল কারণ ছিল আমেরিকানদের জিবে সেই ভারতীয় খাবার তখন এত জনপ্রিয়তা লাভ করতে পারেনি। তারা বলত “কারি? এটা আবার কী জিনিস?” তাদের দৃষ্টিতে আমাদের খাবার মানেই হল প্রচণ্ড ঝাল অর্থাৎ 'স্পাইসি'। সে কারণে রেস্তোরাঁ খুব বেশিদিন টিকিয়ে রাখা গেল না।'

হাবিব উল্লাহ রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দিয়ে আবার তার পুরোনো পেশা কিচেন সহকর্মী বা ডিশওয়াশারের কাজে নেমে পড়লেন। এরই মধ্যে ভিকতোরিয়া মারা গেলেন। ভিকতোরিয়ার কোলে ছিল তখন হাবিব উল্লাহর দুই সন্তান—হাবিব জুনিয়র এবং হুমায়রা। হাবিব উল্লাহর বয়স তখন ৫২। দীর্ঘ ৪০ বছর পর তিনি আবার তার নিজ জেলা নোয়াখালীতে যান এবং সেখানে তার তুলনায় অল্প বয়সী একটি মেয়েকে বিয়ে করে নিউইয়র্কে নিয়ে আসেন। তাদের ঘর আলোকিত করে একটি সন্তানের জন্ম হয়। সন্তানের নাম দেওয়া হয় আলাদিন উল্লাহ।

পুত্র আলাদিন উল্লাহর স্মৃতিতে পিতা হাবিব উল্লাহ

হাবিব উল্লাহর পুত্র আলাদিন উল্লাহ জন্মগতভাবে আমেরিকান। তিনি বড় হয়েছেন স্প্যানিশ হারলেমে। বাংলা কিছু শব্দ উচ্চারণ করতে পারেন এবং বোঝেনও। তবে অস্থি মজ্জায় তিনি আমেরিকান হলেও আলাদিন উল্লাহ তার পূর্বপুরুষদের ভুলে যাননি। আমেরিকায় বাংলাদেশি অভিবাসীদের গোড়াপত্তনের ইতিহাস, তাদের আচার, জীবনের নানান বাঁক নিয়ে নির্মাণ করছেন তথ্যচিত্র 'বেঙ্গলি হারলেম'। এই অসাধারণ কাজটির সঙ্গে রয়েছেন 'বেঙ্গলি হারলেম' গ্রন্থের লেখক এবং গবেষক ভিভেক বাল্ড। তবে আলাদিন উল্লাহর মূল পরিচয়, তিনি আমেরিকার একজন সফল কমেডিয়ান। তাঁর 'ডিশওয়াশার্স ড্রিম' আমেরিকায় বেশ সাড়া জাগানো একটি কমেডি শো। 'ডিশওয়াশার্স ড্রিমস' মূলত আলাদিন উল্লাহর বাবা হাবিব উল্লাহর জীবন থেকে নেওয়া কিছু গল্প। পিতা হাবিব উল্লাহর জীবনের নানা রকম ঘটনা তীর্যক হাস্য-কৌতুকরস মিলিয়ে সেই গল্প তিনি উপস্থান করেন তার 'ডিশওয়াশার্স ড্রিমস' কমেডি শোতে। তবে সেই গল্পগুলোর পেছনে যে বিষয়টি ফুটে ওঠে, তা হলো হাবিব উল্লাহর জীবনযুদ্ধের নানা রকম চিত্র। পাশাপাশি আলাদিন উল্লাহ তার নিজের গল্পটিও বলতে চান 'ডিশওয়াশার্স ড্রিমস'-এর মাধ্যমে। আলাউদ্দিন উল্লাহর ভাষায়:

'ডিশওয়াশার্স ড্রিমস'কে শুধু একটি কমিক শো মনে করলে ভুল করা হবে। আমার বাবা হাবিবুল্লাহ ১৯৪০ সালের দিকে নিউইয়র্ক এসেছিলেন। তখন সেখানে ছিল জাতিগত বিদ্বেষ, বর্ণবাদ, শ্রেণিবৈষম্য, আরও কত কিছু! পঞ্চাশের দশকে আমেরিকায় 'রেসিজম' ছিল খুব সাধারণ একটি বিষয়। এর সবকিছুরই করুণ পরিণতির শিকার হয়েছেন আমার বাবার মতো সাধারণ মানুষ। তাঁরা ইংরেজি বলতে পারতেন না। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাও তাঁদের ছিল না। বাধ্য হয়ে তাদের “অড জব” বেছে নিতে হতো। তাঁরা কেউ ছিলেন ডিশওয়াশার, কেউ হট ডগ বিক্রেতা, কেউ ডোরম্যান, কেউ কারখানার শ্রমিক ইত্যাদি পেশার মানুষ। আমার বাবা হাবিব উল্লাহ কাজ করতেন রেস্তোরাঁয় ডিশওয়াশার হিসেবে। তাঁর কাছে শুনেছি তিনি কত বিচিত্রভাবেই না এই আমেরিকার সমাজে ঘৃণা আর বর্ণবাদের শিকার হয়েছিলেন। আমি আমার কমেডি শো “ডিশওয়াশার্স ড্রিম”-এ সেই কথাগুলোই ব্যাঙ্গাত্মকভাবে বলার চেষ্টা করি।'

আলাদিন উল্লাহ
আলাদিন উল্লাহ

আলাদিন উল্লাহ যখন কথা বলছিলেন, তখন আমার চোখে ভেসে আসছিল সেই অভিবাসীদের হাজারো মুখের ছবি, যাঁরা কত কষ্ট সহ্য করে আর ধৈর্যকে পুঁজি করে এই আমেরিকায় তাঁদের নোঙরটি ফেলেছিলেন। সেই কঠিন সময়টা কেমন ছিল? জানা যায়, সেই উনিশ শতকের গোড়ার দিকে যেসব বাঙালিরা প্রথম আমেরিকায় এসেছিলেন, তাঁরা কেউ ছিলেন জাহাজের ইঞ্জিনরুমের হেলপার, কেউ ছিলেন 'বয়লার বয়', আবার কেউ ছিলেন স্রেফ জাহাজের খালাসি। মূলত জাহাজকে পুঁজি করেই শুরু হয়েছিল বাঙালির আমেরিকা দর্শনের প্রাথমিক অভিবাসনপ্রক্রিয়া। আমেরিকার কোনো বন্দরে জাহাজ যখন ভিড়তে যাবে, সেই মোক্ষম সময়ে তাঁরা রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে জাহাজ থেকে টুপ করে সমুদ্রে ঝাঁপ দিতেন। তারপর সাঁতার কেটে আমেরিকার মাটি স্পর্শ করে শুরু করতেন তাঁদের নতুন জীবনের গল্প। তাদের বলা হতো 'শিপ জাম্পার'। অবশ্য অনেক শিপ জাম্পারকে আবার আক্ষরিক অর্থে জাহাজ থেকে 'জাম্প' দিতে হতো না। জাহাজ বন্দরে ভিড়লে ক্যাপ্টেন সাহেব জাহাজের সব খালাসি ও কর্মচারীকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে 'শোর পাস' দিতেন। সেই শোর পাস দেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল জাহাজে নিয়োজিত কর্মচারীদের মানসিকভাবে প্রণোদিত করা। সে লক্ষ্যে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে তাদের জল থেকে ডাঙায় সময় কাটানোর সুযোগ দেওয়া হতো এবং তারপর আবার জাহাজমুখী হওয়া। কিন্তু সবাই কি তা করতেন? অনেকেই নতুন জীবনের আশায় 'শিপ জাম্পার' হয়ে যেতেন।

হাবিব উল্লাহর স্মৃতিতে আবারও আলাদিন উল্লাহর কাছে ফিরে যাই। তিনি তখন কথা বলছিলেন তাঁর বাবাকে নিয়ে:

'সত্যি বলতে, ছেলেবেলায় বাবার সঙ্গে আমার একটা দূরত্ব ছিল। বাবার চিন্তা-মনন, বিশ্বাস আমার থেকে ছিল ভিন্ন। তিনি ছিলেন মনে-প্রাণে বাংলাদেশি। বাবার চিন্তা বা প্রতিবাদের ভাষা আমি কখনো বুঝতে পারতাম না। আমি ছিলাম স্বাধীনচেতা। মুক্তমনে দেয়ালে প্রতিবাদী চিত্র আঁকতাম। বাবা তা পছন্দ করতেন না। পরবর্তীকালে বুঝতে পেরেছিলাম, বাবার প্রতিবাদের ভাষা ছিল আরও স্পষ্ট, আরও দৃঢ়। তা ছাড়া তিনি জীবনের শেষের দিকে উচ্চ রক্তচাপজনিত রোগে ভুগতেন। তবে বাবার কথা মনে হলেই শুধু মনে হয় অভিবাসী হওয়ার শত যন্ত্রণায় ছটফট করা একটি মুখ। তিনি হয়তো প্রতিনিয়ত তার ছোট্ট বুকে সেই যন্ত্রণাগুলো আজীবন লালন করেছেন, যা আমরা কখনো বুঝতে পারিনি।'

এভাবেই পূর্ব বাংলা থেকে আসা হাবিব উল্লাহর জীবন রচিত হয়েছিল সম্পূর্ণ ভিনদেশি আলো-হাওয়ার দেশ আমেরিকায়। তাঁরা সবাই ছিলেন স্বপ্নচারী।

তথ্যসূত্র:

সৈয়দ, আদনান, 'শিপ জাম্পার: বাঙালির আমেরিকা যাত্রা', প্রকাশক: মুক্তধারা, নিউইয়র্ক, ফেব্রুয়ারি ২০২০

Bald,Vivek, Bengali Harlem and the Lost Histories of South Asian America, Harvard University Press, Hardcover – November, 19, 2013