সোনালি ধানের সময়

খেতের আলে দাঁড়ালেই মনের ভেতরটায় যে জমাট মেঘ, তা ভেঙে চুরমুর হয়ে যায়। গা-গতরে চাষির রক্ত বলেই কিনা, পাকা ধানের ঘ্রাণে অনিশ্চয়তার দানাদার হওয়া গুমোট ভয়-শঙ্কা উড়ে যায়। মনে হয় দূরের পাহাড় থেকে ভেসে আসছে নরম, আদুরে লিলুয়া বাতাস। সেই হাওয়াতে খেতের সোনালি বুক মৃদু দুলে ওঠে। কয়টা কুচকুচে কালো ফিঙে কোথা থেকে উড়ে এসে খেতের বুকে দাঁড়িয়ে থাকা বাঁশের কঞ্চিতে বসে গা দোলায়। এই মুহূর্তে সূর্যটাও কোথাও আড়ালে আছে। ভাঙা মেঘের ফাঁক গলে যেটুকু রোদ আসছে, তাতে অত তেজ নেই। গা পোড়ে না। আরামই লাগে মমিন উদ্দিনের।

এই সোনাফোটা আলো খেতের সোনালি রঙে মিশে কেমন তিরতির করা ঢেউ হয়ে নাচে। মমিন উদ্দিন সেই নাচের ঘোরে মজে যায়। সবুজ ও হলুদ রং ধরা পাতার বাঁধনে থাকা ধানের ছড়ায় যেন ছোট ছোট সোনার কণা ঝুলছে। মুঠো মুঠো হয়ে একদিন তার ঘরে যাবে এই সোনার ফসল। এই জমির মালিক মমিন উদ্দিন। এই একফালি জমির মালিক হওয়ার সুখ এ মুহূর্তে তার চেতানো বুকটাকে বিশাল হাওরের সমান করে তোলে। এই কদিন ধরে মেঘের ছায়ার মতো ম্লান শূন্যতা তাকে ঘিরে রেখেছিল, তা এখন আর নেই। সে বেশ কিছু সময় ধরে জমির চারদিকে ঘুরে ঘুরে খেত দেখে, ধান দেখে। না, কোথাও কোনো খুঁত নেই। ধানে চিটার আলামত নেই।

মমিন উদ্দিন বাড়ির দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। হাওরের পাড়ে দূর থেকে একটুকরো সবুজ রেখার মতো দেখতে বাড়িটি দাঁড়িয়ে আছে। গাছের ফাঁক দিয়ে রোদ পড়া টিনের চাল রুপালি ঝিলিক দিয়ে ঝকঝক করে। মমিন উদ্দিন বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকে।

তার সম্পদ বলতে এই বাড়ি আর একটুকরো জমিই। এ দিয়ে তো আর সংসার চলে না। অন্যের জমিতে কাজ করে সংসারের বাকিটুকুর জোগান আসে। তবে এ নিয়ে তার তেমন কোনো আফসোস নেই। মনে হয়, এই তো ভালো আছে। সংসারে বউ আর ছেলে। বউটাও অনেকটা তার মতোই—যা আছে, এতেই সে খুশি। ঘর সামাল দিয়ে হাঁস-মোরগ পেলে-পুষে বাড়তি কিছু রোজগারও আছে তার। অসুখ-বিসুখে, কামেকাজে যেতে না পারলে সংসারটা ঠেলেঠুলে নিতে পারে। মমিন উদ্দিন ও তার বউ দিলারা বেগম সেই সব মানুষেরই দলের, যারা খুব সামান্য নিয়ে ভালো থাকতে পারে (তবে এটা মনে করা ঠিক নয়, বউয়ের কোনো সাধ-আহ্লাদ নেই। মাঝেমধ্যে এই রঙিন কাচের চুড়ি, দামি সাবান, ঠোঁটপালিশ মেখে বারুনিতে যাওয়া, ঈদ-পার্বণে নতুন একখান শাড়ি...এই চাওয়াটুকু তো তার থাকতেই পারে। এ নিয়ে খিটিমিটিও কিছু হয়, এটুকুই)।

হাওরের পেটে বাড়ি বলে ভিটা বেশ উঁচুতে। যাতে বর্ষার পানি অতটা উঁচুতে উঠতে না পারে। বাড়ির পথের মুখেই গাছের ছায়াতে একটা বরুণ গাছের ডাল ধরে দাঁড়িয়ে ছিল দিলারা বেগম। বেশ দূর থেকেই দেখা যায় মমিন উদ্দিন বাড়ি ফিরছে। মমিন উদ্দিন কাছাকাছি আসতেই মুখটা স্পষ্ট হতে থাকে। সেই মুখ থেকে সকালবেলার রোদের মতোই ছলকে পড়ছে হাসি।

দিলারা বেগম হাসির কারণ বুঝতে পারে না। বলে, 'কী অইল। আইজ দেখি মুখভরা রইদ। কোনো সোনার খনিটনির খোজ পাইছ না কিতা!'
'আলুয়ার আর সোনার খনি কিতা, বউ আর ধানখেত।'
'বাহ, কিতা অইছে হুনি।'
'না, খেতও গেছলাম। খুব ভালা ধান অইছে। কয়দিনের মধ্যেই কাটতাম পারমু।'
'দেখো, আসমানে কিতা করে। যে রকম মেঘ ভাসের।' দিলারা বেগম তার পাশে পাশে ঘরের দিকে যেতে যেতে বলে, '...দুনিয়ার মাঝেও যে মড়ক লাগছে, খালি হুনি করোনা আর করোনা। দপদপাইয়া মানুষ মরের। লন্ডন, আমেরিকা অত বড় বড় দেশ। অত বড় বড় কথা তারার। তারার অখানউ কিচ্ছু করতো পারের না। কিতা যে অইব আল্লাহই জানইন। ঠিকঠাক মতো ধান চাইরটা তুলতে পারলেই অইল।'

মমিন উদ্দিন বউয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। এ কদিন ধরে তার মাথার মধ্যেও এ রকম চিন্তা ঘুরেফিরে উড়ছে। কোথাও বের হতেও ভয় লাগে। কোথাও যাওয়া হয় না বলে টেলিভিশনের সামনেই বেশির ভাগ সময় কাটে। আর এই টেলিভিশন খুললেই খালি করোনার বুক কাঁপানো কথাবার্তা। দেশে দেশে মানুষের অসুস্থ হওয়ার কথা। মৃত্যুর কথা। কিছুক্ষণ দেখলে কলিজা শুকিয়ে যায়। যে মমিন উদ্দিন বৈশাখ মাসের ঝড়, বিজলি ও বাজের মধ্যে হাওরের বুকে পড়ে থাকে, একটুও ভয় পায় না, সেই মমিন উদ্দিন না দেখা এক করোনার কথা শুনতে শুনতে কেমন যেন ভয়কাতুরে হয়ে পড়েছে। মাঝেমধ্যে মনে হয় এই বিটলা করোনা বুঝি হাট থেকে বাড়ি এসে ঢুকল, হাওরের বুকে ছড়িয়ে পড়ল। মানুষের নাকেমুখে ঢুকে পড়ল। এমন এক অসুখ, মানুষ মানুষকে এখন ছুঁতে ভয় পায়। কাছে যেতে ভয় পায়। সবাই খালি ঘরে থাকার কথা বলে। খেত-কামলা মানুষ, এইভাবে ঘরে থাকলে পেট চলে!

সেদিন হাটে গিয়ে তো অবাক। সন্ধ্যার আগে আগেই হাট ফাঁকা। হাটের পাশে হিজল ও করস গাছের ঝোপে সন্ধ্যার মধ্যেই যেন অন্ধকার ঘুমাতে এসেছে। কেমন যেন ভয় ধরা, গা ছমছম করা নিরিবিলি পরিবেশ। যে হাট শুরুই হয় সন্ধ্যার দিকে—হাওর থেকে, খেত থেকে মানুষ বাড়ি ফেরে, তারপর বাড়ির কামকাজ গুছিয়েই তবে হাটে আসে—সেই হাট এখন দেখতে পোড়োবাড়ি, পোড়োবাড়ি লাগে। কিছু সবজি-আনাজ কিনে বাড়ি ফেরার পথে যারা ছিল; তাদের সবার মধ্যেই একধরনের ভয়, রক্ত হিম করা অজানা আশঙ্কা।

একই গ্রামের কুরবান আলি হাঁটতে হাঁটতে বলে, 'হারাটা জীবন লন্ডন, আমেরিকার ক্ষমতার কথা হুনতে হুনতে বুড়া অইলাম। তারার নাকি অনেক বড় বড় অস্ত্র। দেশে বইয়াই আরেক দেশও বোমা মারতো পারে। কত যন্ত্রর কথা হুনি। আমরার পাকঘরও কিতা রানরাম, তারার দেশও বইয়া দেখত পারে। আর দেখা যায় না এক করোনায় ঘরও ঘরও লাশ ফালার। কিচ্ছু করতো পারের না। এত দিন মানুষ থইয়া খালি ক্ষমতা লইয়া চোটপাট করছইন। অখন কে বাঁচমু, কে মরমু ঠিক নাই।'
হাসিম মিয়া বলে, 'হাছাও কইছ, ধাননি কাটতাম পারমু বোঝরাম না। এবার ধানও অইছে ভালা। কিতা যে অইব, আল্লা-মাবুদে জানইন।'

এমনিতেই সোনাপুর হাওরের বুকের কাছের একটি গ্রাম। সন্ধ্যা নামলেই অন্ধকারের বুক সেলাই করতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে জোনাক পোকার দল। এখন আরও আগেই গ্রামটি যেন ঘুমিয়ে পড়তে চাইছে। দিলারা বেগম মাঠ থেকে ফেরা হাঁস-মোরগ বাইরের ছোট ঘরটিতে ঢুকিয়ে টিপকলের পানিতে ছেলেটার গা মুছে, নিজের হাতমুখ ধুয়ে ঘরে আসে। ঘরে ঢুকে মমিন উদ্দিনকে দেখে যেন কিছুটা চমকে ওঠে। কোন ফাঁকে মমিন উদ্দিন ঘরে ঢুকছে, খেয়াল হয়নি।

'হাট থাকি যেন রাইত বারোটা না বাজাইয়া আইলে ঘুম অয় না। অখন দেখি হাইনজা বালা ঘর লইলিলায়। করোনায় দৌড়াইয়া আনল না কিতা!'
মমিন উদ্দিন বলে, 'অয়। আইলাম। সরকার আইন করছে সন্ধ্যার আগেই বাজার বন্ধ করতে অইব। সব দোকানও খোলা যাইত নায়। চা-স্টলও বন্ধ। কই বইতাম। বাজার হাইনজার আগেই খালি। মানুষ নাই।'

দিলারা বেগম এ নিয়ে আর কথা বাড়ায় না। তার টেলিভিশনের কথা মনে পড়ে। সেখানে তো বারবার ঘরে থাকার কথাগুলো বলছে। একদিক থেকে মন্দ না, মরদ-মানুষটা তো এক অছিলায় সকাল সকাল ঘরে ফিরছে। অনেক বছর এ বাড়িতে হয়ে গেলেও একলা বাড়ি, রাত হলে পুরুষ মানুষ বাড়িতে না আসা পর্যন্ত কেমন গা শিউরে ওঠা একটা ভয় কাজ করে তার।

মমিন উদ্দিন হাত-পা ধুয়ে যখন ঘরে ফেরে, তখন হাটের মসজিদের মাইক থেকে মাগরিবের আজান ভেসে আসে। আজান শেষ হওয়ার সাথে সাথেই রাতটা যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল সোনাপুরের ওপর। একদিকে হাওরে পাকা ধান, আকাশে উড়ছে ভাঙা ভাঙা মেঘ, অন্যদিকে করোনোর ভয়। মনটা পুরোই থম ধরে আছে মমিন উদ্দিনের। এ থেকে যেন সে কিছুতেই বের হতে পারছে না। খেতের কাছে গেলেই মনটা যা একটু হালকা মনে হয়। সোনালি ধানের খেত বুকের ভেতর সাহস তৈরি করে। সামনের দিনে সঞ্চয়ের সম্ভাবনাটুকু জাগিয়ে রাখে। মমিন উদ্দিন তার মায়ের কাছে শুনেছে, তাদের ছোটবেলায় নাকি গ্রামে ওলা ওঠা আসর করত। কলেরায় মানুষ মরে গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে গেছে। ওলা ওঠার ভয়ে কেউ রাত-বিরেতে ঘরের বাইরে যেত না। এখন তো আরও খারাপ। রাত কি, দিনেই তো বাইরে বের হওয়ার সাহস হয় না। কখন কারে যে করোনায় ধরে ফেলে!

ছেলেটা খাওয়া-দাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়েছে। বাইরে ঝিঁঝি পোকা ডাকছে। পাকঘর থেকে দিলারা বেগমের বাসনকোসন গোছানোর টুং টাং শব্দ আসছে। ঘরের ভেতর একটি সচল সংসারের মায়া। মমিন উদ্দিন টেলিভিশনের পর্দায় চোখ রেখে তাকিয়ে আছে। কিন্তু সেখানে কী দেখছে, কিছুই মাথায় ঢুকছে না। একটার পর একটা চিত্র আসছে, যাচ্ছে। কিছুই তাকে টানতে পারছে না।

তার মন পড়ে আছে হাওরের বুকে। সারা হাওরে এখন পাকা ধান, কাঁচা ধান। কিছু কিছু কাটা শুরু হয়েছে। যদি বৃষ্টি নামে, যদি ঢল নামে। তাহলে এই ধান গোলায় তোলা যাবে কি না, এ নিয়ে উদ্বেগের শেষ নেই। তার তো একটুকরো খেত মাত্র। তবে সে শুধু তার এই খেত নিয়েই ভাবছে না, সে ভাবছে পুরো হাওরের কথা। যদি কাটার সুযোগ না মেলে, তাহলে তার ঘরেও ধান উঠবে না। গোলা খালি পড়ে থাকবে। করোনার ছোবলে এমনিতেই সবকিছু তছনছ হয়ে গেছে। ঘরে চারটা ভাত থাকলে নাহয় শাক-লবণ দিয়ে পেট পোরা যাবে। ধান গেলে তো তার মতো মানুষের আর জান থাকা না-থাকা সমান।

এসব ভাবনা মানুষকে যেমন উদ্বিগ্ন করে, তেমনি হয়তো ক্লান্তও করে। দিলারা বেগম পাকঘর থেকে এসে দেখে মমিন উদ্দিনের নাক ডাকছে। মমিন উদ্দিন কখন ঘুমিয়ে পড়েছে। দিলারা বেগম আর মানুষটাকে জাগাতে চায়নি। দরকার নাই। কালকে খেতের ধান কাটবে। সকাল সকাল উঠতে হবে। ঘুমিয়ে পড়েছে, পড়ুক। সময়টা এমনিতেই এত থমকে যাওয়া, এই ঘরে থাকা দিলারা বেগমও টের পায়। এই সোনাপুর কখনোই হইচইয়ে চঞ্চল হয় না (শুধু একবারই হয়, এই ধান কাটার সময়টিতে। তখন ধান মাড়াই, ধান ঝাড়াই, ধানসেদ্ধ—সেই রাত গভীর পর্যন্ত লেগে থাকে)। তবু এই গ্রামটির দিকে তাকালেও এই থমকে যাওয়ার টের মেলে। হিজল-করসের গাছগুলোও যেন দম ধরে আছে। পাতাগুলো আর পাতা নেই, নিষ্প্রাণ হয়ে গেছে (বাস্তবতা হয়তো এ রকম নয়, পাতা হাওয়াতে দুলছে ঠিকই, কিন্তু মানুষের মনে পাতার এই উচ্ছ্বাস দেখার সেই প্রাণটুকু নেই, হয়তো এ কারণে পাতাকেও স্থির মনে হচ্ছে)।

এমন সময় শিথানের কাছে রাখা মমিন উদ্দিনের মুঠোফোন বেজে ওঠে। দিলারা বেগম হাইস্কুল পর্যন্ত যাওয়া নারী। সে মুঠোফোনের স্ক্রিনে ভেসে ওঠা নামটা পড়তে পারে। দুলু মেম্বার...। দিলারা বেগম তাকে চেনে। গাঁয়েরই মানুষ। কিন্তু এত রাতে তার ফোন ধরা ঠিক হবে কি না, নাকি মানুষটাকে ডেকে দেবে—এই দোনোমনার মধ্যেই রিং বাজতে বাজতে থেমে যায়। কিছুক্ষণ পর আবার বেজে ওঠে। এবার দিলারা বেগম মমিন উদ্দিনকে ডাকারই সিদ্ধান্ত নেয়।

'এই হুনছ, মেম্বার ফোন দিছে।' বলে গা ধরে যখন ঝাঁকুনি দেয়, ধড়মড়িয়ে ওঠে মমিন উদ্দিন।
'নেও, মেম্বারের ফোন।'

ঘুমভাঙা থতমতো খাওয়া অপ্রস্তুত অবস্থাতেই ফোন ধরে মমিন উদ্দিন। ফোনের ওপাশে থাকা ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বারের সাথে তার কী কথা হয়, দিলারা বেগম বুঝতে পারে না। শুধু অনেকবার 'আইচ্ছা' 'আইচ্ছা'... শুনেছে। ফোন রেখে দুই হাত মেলে হাইম ছাড়তে ছাড়তে মমিন উদ্দিন বলে, 'আল্লাই জানে কী তামশাত পড়ছি।'

কৌতূহলে থাকা দিলারা বেগম জানতে চায়, 'কী অইছে! কোনো ঝামেলা-টামেলা করছোনি।'
'না, ঝামেলার কুনতা না। আবার ঝামেলাও। আমরা গরিব মানুষ। আমরারে লইয়া টানাটানি না করলেই তো ভালা।'
কথার কোনো দিশামিশা পায় না দিলারা বেগম। কী রকম ধুলোঝড়ের মুখে পড়ে গেছে সে।
'কিতা অইছে। প্যাঁচ করিও না। খোলাসা করি কও।'

মমিন উদ্দিন যা বলে, তার অর্থ এই—করোনাভাইরাসের কারণে এবার শ্রমিকসংকট চলছে। ঝড়-বন্যার আগেই চাষিদের পাকা ধান কেটে তুলতে হবে। সেই ধান কেটে দিচ্ছেন অনেকে। এর জন্য তারা কোনো টাকা-পয়সা নেন না। পারলে আরও গরিব মানুষরে খাদ্যটাদ্য দেন। মমিন উদ্দিন বলে, 'লকডাউন না কী অইছে। এতে শুধু জেলারই না, এক উপজেলার মানুষ আরেক উপজেলায় যাইতে পারব না। তাই শ্রমিকও আইতে পারব না। সদরের কোন নেতা না চেয়ারম্যান নাকি ঠিক করছে আমার জমির ধান কাটব। আমি তো আগামাথা কিচ্ছু বোঝরাম না।'

দিলারা বেগম খোলা শ্বাস ছাড়ে। যাক, তাহলে কোনো জটিল কিছু নয়। সে সরলভাবেই বলে, 'ভালাই তো। তোমার আর ধান কাটতে অইল না। পরিশ্রম বাঁচল। আমার জামাইর খেতে কইছলাম না সোনার খনি। নেতারাও ঠিকই টের পাইছে।'

মমিন উদ্দিনের কেন জানি বউয়ের এই রসিকতাটা এখন আর ভালো লাগেনি। তবে এ নিয়ে সে আর রাগ দেখায়নি (বউয়ের সাথে যে সে রাগে না, এমন নয়। তবে কমই রাগে। এর একটা কারণ হয়তো, বউটাও তার ওই এক টুকরো জমির মতো বুকের ধন, আহ্লাদি। তাকে বড় মমতা দিয়ে আগলে রাখে)। মমিন উদ্দিন বালিশে মাথা রাখতে রাখতে বলে, 'অইছে তামশা থও। ঘুমাও অখন।'

কিন্তু মমিন উদ্দিনের মাথা থেকে ঘুম উড়ে গেছে। এত জমি থাকতে তার খেতই কেন বেছে নেওয়া হল। যদিও কদিন ধরে সে দেখছে যে সব খেতের ধান পেকে গেছে। সেসব খেতের পাশে সরকারের লোক আসছে। শহরের অনেক মানুষ আসছে। কেউ ছাত্র, কেউ শিক্ষক, কেউ ব্যবসায়ী। এখন সবকিছু বন্ধ বলে তাদের কোনো কাজ নেই। তাদের কেউ জমির পাকা ধান কাটছে, কেউ কাঁধে করে খলায় নিয়ে দিচ্ছে। এরা কেউ আগেভাগে জানায়ওনি। দল বেঁধে আসে, তারপর ধান কেটে দিয়ে চলে যায়। তার ক্ষেত্রে আগেভাগে জানিয়ে আসছে কেন! তার জমির মধ্যে এমন বাড়তি কী আছে! ঘুম না আসায় এপাশ-ওপাশ করে মমিন উদ্দিন।

বউ মাথায় হাত রেখে বলে, 'এবার যদি ধানটান ভালা পাও, তাইলে ঘরর টিনর বেড়াটা বদলাইও। ইট দিয়া ওয়াল দেওয়ার কথা একটু চিন্তা করিও। তুফানটুফান আইলে যা ডর লাগে।'

ভিটার কাছেই তখন কয়েকটি শিয়াল একসাথে ডেকে ওঠে। লাফ দিয়ে ওঠে দিলারা বেগম। সে দরজা খুলে উঠানে এসে দাঁড়ায়। উঠানের পাশে ছোট ঘরটিতে তার পোষা হাঁস-মোরগ। কখন শিয়াল বেড়া ভেঙে ঢুকে পড়ে। হাঁস-মোরগ নিয়ে পালায়। দিলারা বেগম 'দূর' 'দূর' করে অন্ধকারের দিকে শিয়ালকে তাড়াতে থাকে। এতে চুপ হয়ে যায় শিয়ালের দল। থপথপ পা ফেলে কিছু পালিয়ে যাওয়ার শব্দও শোনে। দিলারা বেগম কিছুক্ষণ উঠানে ঘোরাঘুরি করে এসে ঘুমিয়ে যায়। হয়তো ঘুমিয়ে পড়ে মমিন উদ্দিন, ঘুমিয়ে পড়ে রাতটিও।

রাতের বেলা ঘুমের মধ্যে মমিন উদ্দিনের মধ্যে ধান কাটা নিয়ে যে অস্থিরতা ছিল, ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথে সেই অস্থিরতা আর নেই। কোথাও মিলিয়ে গেছে। উল্টো মনের ভেতর একধরনের ভালো লাগা তৈরি হতে থাকে। তার খেতে বিশেষ কারও উপস্থিতি তাকে সবার মধ্য থেকে আলাদা করবে। সবাই তাকে আলাদা করে একটু হিসেব করবে (এ রকম ভাবনায় মমিন উদ্দিনের নিজেরই অবাক লাগে। চমকে ওঠে। সে এই আলাদা হওয়া, বিশেষ কারও উপস্থিতি—এসব কী ভাবছে। এসব দিয়ে সে কী করবে। সে সাধারণ চাষাভুষা মানুষ, তা-ই তো থাকতে চায়)।

মমিন উদ্দিন শিং মাছের ঝোল-তরকারি দিয়ে গরম ভাত খেয়ে কাস্তে নিয়ে খেতের কাছে ছুটে যায়। তার মাগনা ধান কাটার দরকার নেই। সে নিজেই তার খেতের ধান কাটতে পারবে। বেশ বেলা গড়িয়ে গেছে। মমিন উদ্দিন আর সময় নষ্ট করতে চায় না। ধান কাটার প্রস্তুতি নেয়। এ রকম মুহূর্তে দুলু মেম্বার অনেকটা হাঁপাতে হাঁপাতে খেতের কাছে ছুটে আসে।

'এই মমিন, করছ কিতা? মান-ইজ্জত থাকবোনি? আমি নেতারে কইছি তর খেতর ধান কাটবা। একটু অপেক্ষা কর। শহর থাকি তারা রওয়ানা দিলাইছইন। তর তো ক্ষতি নায়। মাগনা ধান কাটা পাইলিবে।'

মমিন উদ্দিন কী বলবে। হাঁ করে দুলু মেম্বারের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। হাওরে, তার চারপাশে তখন অনেক মানুষ। পাকা খেতে ধান কাটা চলছে। করোনাকালে যাতে পানিতে ধান তলিয়ে না যায়, এ জন্য যে যেভাবে পারছে দ্রুত ধান কাটছে।

এমন সময় হাওরপাড়ের বাজারে বেশকিছু গাড়ি দেখতে পায় মমিন উদ্দিন। দুলু মেম্বার বাজারের দিকে ছুটতে থাকে। এ সময় মমিন উদ্দিনকে কেমন ক্ষমতাশূন্য রাজার মতো মনে হয়। খেত তার, ফসল তার—কিন্তু চাইলেই এখন সে খেতে কাঁচি চালাতে পারবে না। কিছু সময়ের মধ্যেই দলবল নিয়ে নেতা এসে খেতের আলে দাঁড়ান। সাথে অনেক মানুষ। মমিন উদ্দিনের ভাবনায় তার খেত, খেতের ফসল—এর বাইরে কিছু নেই। এত লোক যদি ধান কাটতে নামে, তাহলে খুব বেশি সময় লাগবে না। তার খেতের ধান কাটা শেষ হয়ে যাবে। তার খেতের ধান কাটা শেষ হলে সে অন্যের খেতে ধান কাটতে যাবে। সারা বছরের খোরাক আসবে সেই থেকে। বেশি হলে তা বিক্রি করে ঘরে ইটের দেয়াল তুলবে। এ সময় দিলারা বেগমের মুখটা মনে পড়ে। 'সংসার ছাড়া বেচারির আর কোনো চিন্তাই নাই।'

মাথার ওপর তখন ধক ধক করছে বৈশাখের সূর্য। তবে বেশ হাওয়া আছে, তাই শরীর থেকে ঘাম ঝরলেও সূর্যের তাপ অতটা গায়ে লাগছে না। ঠিক তখনই মুখে মাস্ক, হাতে গ্লাভস পরা ধবধবে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরা নেতা কাস্তে হাতে ধান কাটতে শুরু করেন। তার সাথে আরও দু-চারজন কাস্তে নিয়ে খেতে নামেন। কিন্তু, একি! বাকিদের হাতে তো কাস্তে নেই, মোবাইল। সবাই পায়ের তলায় পাকা ধান মাড়িয়ে এদিক-ওদিক দৌড়াচ্ছে আর ছবি তুলছে। গায়ে গা লাগা মানুষের ভিড়। ততক্ষণে পায়ে পায়ে খেতের অর্ধেকই কাদামাটিতে শুয়ে গেছে।

মমিন উদ্দিন চিৎকার করতে থাকে, 'ভাই, খেত থনে বাইর অইন। আমার ধান তো শেষ। ও ভাই, আমার ধান কাটার দরকার নাই। ও মেম্বার, এতা কিতা অইল। ও মেম্বার, আমার ধান...। ও মেম্বার...।'
মমিন উদ্দিনের চেঁচামেচি কারও কানেই ঢুকছে না। যে যার মতো করে ধানের ওপর দিয়ে হাঁটছে, দৌড়াচ্ছে। মমিন উদ্দিন খেতের আইলে বসে পড়ে। তার গা-গতরে কোনো চেতমেত নেই। চোখের সামনে সোনালি ধানের বদলে ক্ষতবিক্ষত এক টুকরো জমি ধ্বস্ত শরীর নিয়ে শুয়ে আছে। ওখানে সোনার মতো ফসলের আর দোলা নেই। কখন যে লোকজন খেত ছেড়ে চলে গেছে, তা-ও সে বলতে পারে না। মমিন উদ্দিনকে ঘিরে আছে আশপাশের খেত-কামলারা। তখন তার কানে সোনার খনি লুট হওয়ার হু হু কান্না ছাড়া আর কিছুই ঢুকছে না।

মে ২০২০