তরমুজ, ভৃঙ্গরাজ তেলের চুল অথবা ম্যারাথন দৌড়

'এলা নামাজ পড়ি ফির আইসপেন?'

'হ, ভাত আন্দি থোন, আসি হামরা দুইটা ভাত খামো।'
মুখের কথা কেড়ে নেয় হামিদা, 'তারপর, বান্নির ম্যালা যাবান্নন?'
'হ, ঝাঁকাত তরমুজ, বাঙ্গি সউগ সাজে থুবু, কনুং।'

বউকে যথাযথ নির্দেশনামা দিয়ে সুরুজ আলী মসজিদের দিকে একটু ইতস্তত মন নিয়েই রওনা করে। কি নাকি এক করুনা রোগ এসেছে, তাই রাস্তা-ঘাটে বের হওয়া যাবে না, কাজ-কাম করা যাবে না, সাবান দিয়ে সারা দিন হাত ধুতে হবে, আবার মসজিদে জামাতে নামাজও পড়া যাবে না? গত শুক্রবারেই পুলিশ টহল দিয়ে গেছে মসজিদের পাশ দিয়ে। তবু তারা জেদ করে সবাই কাতার বেঁধে নামাজ পড়েছে। সরকার কি মসজিদে নামাজ পড়াও বন্ধ করে দেবে নাকি? কিন্তু খোদ সৌদি আরবে মক্কায় কাবা শরিফ নাকি তালা মেরে দিয়েছে বলে গতকাল চায়ের দোকানে মুরব্বিরা আফসোস করছিল। এই যে সবাই 'লকডাউন-লকডাউন' বলে চেঁচাচ্ছে—কী আপদ! 'লকডাউন' কথাটার মানে কী, সুরুজ আলী বোঝে না। ক্লাস টু পর্যন্ত পড়েই বাবার সাথে চাষে হাত লাগিয়েছে। ইংরেজি আর শিখবে কখন? তবে সে জমির আবাদ বোঝে ভালো। প্রতি চৈত্রে তিস্তার পাড়ে তার কয়েক কানি জমিতে সে যতটা তরমুজ আর বাঙ্গি ফলাতে পারে, তা কজন পারে শুনি? গতকাল বর্মণ পাড়ার বাসুদেব বলছিল, সরকার নাকি এবার বান্নির (বারুনির) সিনানও হতে দেবে না। কেন দেবে না? ইশ, বান্নির মেলায় সুরুজ আলী প্রতিবছর প্রচুর তরমুজ আর বাঙ্গি বেচে। এটাও বন্ধ করে দেবে নাকি?
গরিব-গুর্বা মানুষ সে। একটা কোনো মেলা হলেই সে তার খেতের ফল-ফসলটা কি হামিদা বানুর অবসরে বানানো আচার, নাড়ু কি কদমাটা বা হাতে বোনা শীতল পাটি বা তালের পাখা...কিছু না কিছু মেলায় নিয়ে বেচতে পারলে দুটো পয়সা বেশি পায়। বাচ্চা তিনটার জন্যও খেলনা, জামা, মিঠাই-সদাই আনলে কি বউয়ের জন্য একটু কয়েকটা কাচের চুড়ি আনলে ঘর শান্তি!
'মজ্জিদত নামজ পইড়ব্যার পাইচেন?'
'পুলিশ চাইরোপাশ্যে ঘুরব্যার নাইগচে কিন্তুক বাদা দ্যায় নাই। ভাত দে, ম্যালা ভোক নাইগচে।!'
হামিদা বানু উসখুস করে গরম ভাত আর তপ্ত ব্যঞ্জন বেড়ে দিতে দিতে বলে, 'গেলবার মোক তো সাথ করি মেলাত নিয়া গেইচলেন! ছাওয়াগুলাক?'
'ইশ, করুনায় ব্যাটাছাওয়া আর চ্যাংড়াগুলাক হাটত দেইকলেই পুলিশ নাটি হাতত নিয়া আইসে আরও তো...'
বিস্ময়ে সুরুজ আলী কথা শেষ করতে পারে না। হামিদা বানু আর কথা বাড়ায় না।
যাহ বাবা, সকালে খেত থেকে তরমুজ-বাঙ্গি বাছাই করতেই অনেকটা সময় গেছে। তারপর ঘরে এসে টিউবওয়েল চেপে গা ভিজিয়েই মসজিদে দৌড়। এরপর আবার বাড়ি এসে দুটো ভাত খেয়ে বারুনির পথে নামতেই দুপুর দুইটার সূর্য মাথায় গনগন করছে। তবে গতকাল সন্ধ্যায়ই চায়ের স্টলে বর্মণ পাড়ার ওরা বলছিল, এবার চিলমারী বন্দরে বান্নি হবে না। পুলিশ টহল দিচ্ছে। সেই করুনা না কিসের জন্য। বান্নি হবে ভেতরে ভেতরে। এমনিতেই শুকিয়ে আসা তিস্তা যেখানে ভেতরে ভেতরে আরও শুকিয়ে শুকিয়ে ছোট ছোট খাল বা নালার চেহারা নিয়েছে, সেখানেই বান্নি হবে। হতচ্ছাড়া পুলিশ কি সেখানেও আসিবে? গতকাল হাটে মিষ্টির দোকান বন্ধ করে দিল। অমৃত ঘোষের কান্না দ্যাখে কে? সামনে লোকটার চেংড়ির বিবাহ আর পুলিশ আসিয়া কিনা তাহার দোকান বন্ধ করিল। শালা বান্নির মেলা না হলে সুরুজ আলীর এত দিনের যত্ন করে ফলানো তরমুজ আর বাঙ্গিগুলো বিক্রি হবে না...হাট মিস হলে মুশকিল...একেই করুনা না কি যেন আসতে না-আসতেই ওদিকে রাজবংশী পাড়া থেকে নদীর ওপাশে সাঁওতাল পাড়া—সব জায়গাতেই ত্রাহি ত্রাহি করছে অভাব। কয়েক দিনের ভেতর মুসলমান পাড়াতেও ধরবে। ছোটবেলায় ওলা বিবির নাম শুনেছে সুরুজ আলী। মড়কে নাকি গ্রামের পর গ্রাম সাফ হয়ে যেত। রাজবংশীরা বলত মা শীতলার দয়া। তারপর সরকারের লোকেরা আসা শুরু করল ইঞ্জেকশন নিয়ে। সুরুজ আলীদের প্রাইমারি স্কুলে ঢুকে বাচ্চাদের জোর করে চেপে ধরে ইঞ্জেকশন দিত। তারপর দেখতে দেখতে ওলা বিবির দয়া কমে যায়। কিন্তু এই করুনা বিবি বা মা করুনা—যা-ই বলো—সে কেমন? দেখতেই-বা কেমন? ওলা বিবির শিন্নি বা মা শীতলার প্রসাদ তারা ছোটবেলায় কত খেয়েছে! এই করুনার কোনো শিন্নি বা প্রসাদ কি হয়? যাকগে, এত ভেবে তার হাঁটা বরং থেমে যাচ্ছে। যত জোরে এখন তিস্তার পাড়ে যাওয়া যায়, ততই ভালো। বান্নির মেলায় আসা বেটা লোক, বিটি লোক, চেংড়া-চেংড়ি আর গেন্দা-গেন্দিরা সবুজের ভেতর টকটকে লাল তরমুজের ফালি বা কমলাভ বাঙ্গি খাওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকবে। দিন শেষে সুরুজ আলীর কোমরের কাছে গামছার ভেতর বেশ কিছু টাকা জমবে। নাকি পুলিশ সেখানেও লাঠি উঁচায়ে আসিবে? এ কী গজব পড়িল বাহে!

দুপুরের রান্না-খাওয়া কোনোমতে শেষ করেই পাল পাড়ার দিকে পা বাড়ায় ময়না। শাশুড়ি কি এমনিতে যেতে দেয়? তবে কিনা ময়নার বরের মুড়ির ব্যবসা। মুড়ির ব্যবসাই তার জীবিকা। আজ থেকে পঁচিশ-ত্রিশ বছর আগেও এত এলুমিনিয়াম কি মেলামাইনের বাসন-কোসনের চল ছিল না। তখন মুড়িয়ালদের কিনতে হতো বড় বড় মাটির ধামা। আগুনে পুড়িয়ে লাল রঙের বড় বড় মাটির ধামায় সুন্দর ঝাঁজরি কাটা। তেমন সব ধামায় মুড়ি ভরে মুড়িয়ালরা মুড়ি চালান দিত নৌকায় দেশের নানা জেলার সাপ্তাহিক হাটবারে। ময়নার বরও তো সেই কাজ করে। তাই পাল পাড়ায় বেড়াতে যাবার অজুহাত হিসেবে ঝট করে শাশুড়িকে সেটাই বলে ময়না, 'আপনার ছেলে পাল পাড়া দিয়া কয়েকটা মুড়ির ধামা কেনার কথা সাইরা আসতে কইছিল।'
'ও- টাকা দিয়া গ্যাছে তোমারে?'
'দিছে।'
কথা একদম মিথ্যাও না। ময়নার বর বলেছিল বৈকি, যেহেতু সে পাল পাড়ায় মাঝে মাঝে যায়, কয়েকটা মুড়ির ধামা সে-ও দেখে আর পছন্দ হলে অগ্রিম টাকা দিয়ে আসতে পারে। আর এই ফাঁকে পালপাড়ায় তার সই সাবিত্রীদের বাড়ি থেকে সে অনুনয়-বিনয় করে কয়েকটা গাঁদা ফুল, জবা ফুল আর দূর্বা ঘাস কিছু নিয়ে আসবে। এনে থেতো করে দেবে ছোট মেয়েটার চুলে। এই যে তিনটা বাচ্চা হবার পরও ময়নার এত ভালো চুল, তা ওই সাবিত্রীর মা গিরিজা মাসীর কথাতেই তো। ময়নার বাবার বাড়ি ছিল কর্মকার পাড়া আর পাল পাড়ার ভেতর। ওই গরমের দিনে মাটির কলসটা কি ভাত খাবার সানকিটা কিনতে ময়নার মা ছুট লাগাত পাল পাড়ায় আর এমন করেই গিরিজা মাসীর সাথে পরিচয়। গিরিজা মাসীই বলত, 'মাইয়ার এমন চুল, কয়টা গেন্দা ফুল আর তার পাতা ধরো শীতের দিনে বা বারো মাসই জবা ফুলের পাপড়ি, দুব্বা ঘাস এইগুলা ছেঁইচা নাইরকেল তেলের সাথে মিশায় মাইয়ার মাথায় মাখলে সুন্দর, বড় বড় চুল হবে। চুল পড়বে না।' সেই থেকে ময়নার মায়ের শিক্ষা। ময়নাও আজ দ্যাখো মেয়ের মা আর মেয়ের চুল সুন্দর করতে জবা আর গাঁদা ফুল টোকাতে, দূর্বা ঘাস আনতে ছুটছে পাল পাড়ায়। দেখতে দেখতে এই গ্রামে কর্মকার পাড়া, পাল পাড়া, সাহা পাড়া কি কাঁসারী পাড়ার ঘরগুলো সব ফিকে হয়ে আসছে। সারা গ্রামে সব মিলিয়ে ওরা এখন আট কি দশ ঘর। তারপর যদি দেখতে দেখতে গ্রামে ওদের ঘর আর একটাও না থাকে? তখন যদি আর একটাও গাঁদা ফুল কি জবা ফুলগাছ কি দূর্বা ঘাস না থাকে? গিরিজা মাসীর বর পালের কাজের পাশাপাশি টুকটাক কবিরাজিও জানত। তাঁর হাতের কবিরাজি ওষুধের গুণ ছিল। কত জাতের লতাপাতা আর ফুলের বিছন যে ঘরের উঠানে সাজিয়ে রাখত সেই কবিরাজ কাকা। 'কবিরাজ কাকা' বলে সবাই ডাকত বলে তার আসল নামটাই বোধ হয় সবাই ভুলে গেছে। একবার ময়না ছোটবেলায় বেশ কিছুদিন সর্দি-কাশিতে ভুগল। মা তাকে নিয়ে গেল কবিরাজ কাকার কাছে। শ্রাবণ মাসের টানা বৃষ্টি চলছে তখন। কবিরাজ কাকার হাতে ছিল একটি হলুদ রঙের ফুল। ঘরের ভেতর কবিরাজি ওষুধ নিতে বৃষ্টি মাথায় করে আসা কিছু নারী-পুরুষ। কবিরাজ কাকা হাতে ফুলটা দোলান, 'এই হইল ভৃঙ্গরাজ ফুল। ইহা কটু, তিক্ত ও হালকা কষ স্বাদযুক্ত। পিত্ত ও শ্লেষ্মা, বিকার, কফের ওপর ভালো কাজ করে। সূর্যোদয়ের পর অনেকের মাথায় যন্ত্রণা হয় বা আধকপালে ব্যথা হয়, সে ক্ষেত্রে ভৃঙ্গরাজের পাতার রস মাথায় মাখলে শান্তি। মাথার চুল ওঠায় এই পাতার রস দুপুরে মাথায় লাগালে অথবা রস দিয়ে তেল পাক করে ব্যবহার করলেও চুল পড়া বন্ধ হয়।'
তা ছোটবেলায় ভৃঙ্গরাজ ফুল আর পাতা ছেঁচে তার ওষুধও কত ময়নার মাথায় মেখে দিয়েছে তার মা। এসব করেই না তার চুল এত সুন্দর!
'পাল পাড়ায় যাচ্ছিস দেইখাই বুঝছি যে মুড়ির ধামা কিনতে বাইরইস নাই, গেন্দা ফুল, ঘাস-পাতা আনতে গেছিস। মাইয়াডারে কেশবতী বানাবি?' দুপুরের ঘুম থেকে উঠে শাশুড়ির মন-মেজাজ বোধ করি এখন ভালো। ময়না বেগম অপ্রতিভ হয়।
'মুড়ির ধামা পছন্দ করছি কয়েকটা। আপনার ছেলে গিয়া পরে নিয়া আসবে।'
'বুঝছি। হউক, আমার নাতনি কেশবতী হউক। সমস্যা নাই। আজকাল তো এই সব চল উইঠাই গেছে। আগে তো আমরা কত আমলকী-হরিতকী সব ছেঁইচা চুলে দিতাম। জবা ফুল তুলতে গেছি কত বাওনগো পাড়ায়। বাওন তো এখন এক ঘরও নাই। ভবপ্রসাদ ঠাকুরগো বাড়িতে রক্তজবা, শ্বেতজবা তুলতে যাইতাম সক্কালবেলা। আমার বড় বুবুর বাচ্চা হওনের পর চুল সব উইঠা যাইতে লাগছিল। তহন আম্মায় কইত যে একটু জবাফুলের পাতা-পুতার রস দিলে চুল পড়া কমবে। তহন বেহানবেলা ওই জবা ফুল তুলতে যাইতাম আর দ্যাখতাম কি ওই ভব ঠাহুর কি জানি ওগো একটা মন্ত্র পড়তে, পিতলের ঘটি হাতে পুকুরে নামতেছে। একটু একটু মনে আছে, ওং জবাকুসুমং জবাকুসুমং। এখন মানুষ সব কিছু ভুইলা যাইতেছে বউ। তুমি এক কাজ করো। তুমি চা বানাও। আমি নাতিনের চুল দেখতেছি।'
এরপরই শুরু হতো ছয় বছরের মিলি বেগমের চুল নিয়ে টানাটানি। নারকেল তেলের সাথে ভৃঙ্গরাজের ফুল কি পাতা, কখনোবা অনেকটা জবা ফুলের পাপড়ি, দূর্বা ঘাস আবার কখনো মেথি কি আমলকীর ছেঁচা মিশিয়ে রাখা। দেখতে দেখতে মিলি বেগমের চুল হয়ে ওঠে বাহারি, মনোলোভা। বিয়ের সময় পাত্রপক্ষ মেয়ের চুল দেখেই হাঁ হয়ে যায়। এককথায় বিয়ে পাকা।

'চুল বেচবেন চুল? অই, চুল বেচবেন চুল?'
ফার্মগেট ওভারব্রিজের ওপর দিয়ে হেঁকে যায় এক ফেরিওয়ালা। এই শহরের এত গল্প শুনেছে তারা, আগে তেমন আসা হয়নি। মিলির বর দিনমজুর হিসেবে ভালো স্বাস্থ্যের জোয়ান, কাজ-কামাই খারাপ করত না তো! কী এক অসুখ নাকি আসছে, দেশে সব কাজ বন্ধ। মিলির বর প্রায় মাসখানেক ঘরে বসা। এমন অবস্থা যে চুলা চড়ে না।
'চল, ঢাকায় যাই।'
ঢাকায় নাকি দিন-রাত্রি অষ্ট প্রহর গাড়ি-ঘোড়া চলে। মানুষের ধাক্কায় মানুষ হাঁটতে পারে না। ওমা, সব কী ফাঁকা! এ কেমন বিরান শহর গো! য্যান সেই কিসসায় শোনা দৈত্যের কথায় ফাঁকা হয়ে যাওয়া রাজ্য, যেখানে রাজার মাইয়া সোনার পালঙ্কে অচেতন ঘুমায় তার লম্বা চুল মেইলা। কারণ দৈত্য সোনার কাঠিটা পায়ে আর রুপার কাঠিটা মাথায় দিয়া রাখছে।
'চুল বেচবেন, চুল?'
ঢাকায় এসে মিলি বেগম উঠেছে সেজ মামাতো ভাইয়ের বাসায়। সে দুই কামরার এক ঘরে থাকে তেজতুরি পাড়ার বাজারের কাছে। তাদের বারান্দায় তারা চারজন মানুষ কদিন আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু মামাতো ভাইয়েরও তো কাজ বন্ধ। খাবার নাই এক দানা। জীবনে এই প্রথম ভিক্ষার কাজেই মামাতো ভাবির সাথে বের হয়েছে সে। ঘরে পুরুষেরাই বাচ্চাদের দেখছে। মেয়ে মানুষ ভিক্ষা চাইলে মানুষ অনেক সময় নরম হয়। কিন্তু এর আগে তারা কেউ যে কখনো ভিক্ষা করেনি। ভিক্ষা চাইতে গেলে গলা দিয়ে স্বর ফুটছে না। এই তারা ননদ-ভাই বউ এতক্ষণ হেঁটে হেঁটেও খোলামেলা গলায় ভিক্ষা চাইতে পারছে না।
'ভাবি, দ্যাখো, এই ফেরিওয়ালা কী কইতাছে! চুল ব্যাচলে টাকা দেবে? তইলে বেচুম?'
'এত সুন্দর চুল বেচবা?'
'ভিক্ষা করনের চাইয়া ভালা।'
'তইলে যা বোঝো। চুল অবশ্য তোমার আছে ভালোই। গ্রামে থাকো তো। আমার চুল তো তেমন নাই আর।'
'কত দেবেন?'
'দেখি, আপনার চুল দেখি?'
ফেরিওয়ালা কোমরের নিচ অবধি কালো চুলের ঢেউ একবার জহুরীর চোখে দ্যাখে।
'তিন শ'
'এত সুন্দর চুল মাত্র তিন শ টাকা? অন্তত চাইর শ না দিলে হয়?' মামাতো ভাইয়ের বউ দর-দস্তুর করে।
'আচ্ছা, আগে তো কাটি।'
ফাঁকা ওভারব্রীজের এক পাশে ফেরিঅলা কাঁচি হাতে দাঁড়ায়। কচ কচ করে চুল কাটার শব্দ হয়। চোখ দিয়ে জল পড়ে মিলির। ছোটবেলায় মা তার চুল কখনো কাটতে দেয়নি। কত যত্ন করে আর লম্বা সময় নিয়ে তেল দিয়ে, মেথি আর আমলকী দিয়ে, কখনো গাঁদা ফুল কি জবা ফুলের পাপড়ি থেতো করে চুলে মেখে দেয়া হতো!
'সুন্দর চুল, মাশাল্লাহ! দাঁড়াও, দাম দিয়া লই,' ফেরিঅলা নগদ এক শ টাকার দুটো নোট বাড়িয়ে দেয়।
'হায় আল্লাহ, এই না নিজেই কইলেন যে তিন শ টাকা অন্তত দেবেন?'
'টাকা এর চাইয়া বেশি নাই। নিলে নেবা, না নিলে না-নেবা!'
এটুকু বলে ফেরিওয়ালা নিপুণ হাতে মিলি বেগমের দীর্ঘ কালো কুন্তল ভাঁজ করে তার হাতে ধরা কাচের বাক্সে পুরে ফের হাঁটতে থাকে।
'ও আল্লাহ গো, কী বেরহম লোক! কী মিথ্যাবাদী!'
মিলি বেগমের গোটা শরীর বেঁকে যেতে থাকে দমকে ওঠা কান্নায়।
চৈত্রের প্রবল রোদে হাইওয়ের পাশে শিমুল গাছটায় আস্ত রাঙা ফুলগুলো ফেটে তুলা বের হচ্ছিল। কালো পিচ যেন ঝলসে পায়ে লেগে যাচ্ছিল কালো আলতার মতো। বিয়ের দিনে পরানো লাল আলতার মতো তো নয় এই পিচ। প্রায় মাইলখানেক হাঁটার পর শেয়ারে একটি টেম্পু মিলেছিল। জমানো টাকার প্রায় অর্ধেকটা তবু আতাহারকে খরচ করতেই হয়। জোহরার চার মাস চলছে। তবু চাকরিটা এখনো আছে। আতাহারের সাথে তাকেও যেতে হবে বৈকি ঢাকায়। পায়ে হেঁটে, খানিকটা পথ টেম্পোতে, আবার পায়ে হেঁটে, তারপর খানিকটা পথ ভ্যানে, আবার পায়ে হেঁটে আর শেষটায় রিকশা—এমন করে কতবার কত ওঠা-নামা করে তবে তারা পৌঁছেছিল 'নিটওয়্যার ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড'-এর দরজার সামনে। পৌঁছেই শোনে শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত বদলেছে। আগামীকাল আবার ফিরে যেতে হবে। ভাগ্যে জোহরা বড়লোকের আদরের মেয়ে নয়। তার কষ্ট করার অভ্যাস আছে। তাই এই শরীরে এতটা পথ এত ভেঙে ভেঙে এসেও, পুরো রাস্তায় তেমন কিছুই প্রায় না খেয়েও টিকে ছিল। রাত্রিটা কোথায় থাকবে আর কার কাছে থাকবে? বস্তির বাড়ি তো ছেড়ে দিয়েছিল। এখন কি বাড়িওয়ালা থাকতে দেবে? তবে একই কারখানার আরও দু-একটা লেবার ফ্যামিলি যারা লকডাউনে ঢাকা ছাড়েনি, তারাই শেষে সেই রাতটা থাকতে দিয়েছিল তাদের। পরের দিন ঢাকা থেকে ফেরার পথে সে আরেক ঝকমারি! টেম্পো, ভ্যান কিছুই মিলছে না। কত কষ্টে তারা চার-পাঁচটা শ্রমিক পরিবার মিলে শেষে একটা প্রাইভেট কারকে শেয়ারে টাকা দেবে বলে রাজি করাল আবার সেই ময়মনসিংহের এগার সিন্দুরে যাবে বলে। জোহরা সাথে না থাকলে সে পুরুষ মানুষ একাই হয়তো হেঁটে যেত। কিছু টাকা তো বাঁচত। কিন্তু জোহরার শরীরের এই অবস্থায় কী আর করা? এরপর কাণ্ড দ্যাখো! একটা মাস বাড়ি এসে না জিরাতেই আবার ফ্যাক্টরি থেকে খবর এসেছে। আবার ঢাকা যেতে হবে।
'এই ঝড়-তুফাইন্যা কালবৈশাখির ভিতরে যাইবা? বউও যাইব?'
মায়ের কথায় ঘাড় নাড়ে সে, 'চাকরিডা আছে না অহনো!'
'চাকরি—শইলডা ত বালা না!'
'হের বেতনডা খারাপ না আম্মা! এই বাজারে চাকরি ছাড়নডা কি ঠিক অইব? মালিকরা যত দিন রাহে!'
'যেবা বালা অয় কর। আবার কবে আইবি?'
'ঈদের আগে আগে যদি আইতাম পারি!'
'কী যে ঈদ অইব, কইব কেডা ! রোজা-রমজানের দিনও মজ্জিদে নামাজ পড়া যায় না—কী কাইলা যে আইল খুদা!'
'কাইল বেইন্যার সুম ডাহুনযে আমরারে!'
সকাল থেকেই অবশ্য মুষলধারে বৃষ্টি আর থেকে থেকে বজ্রপাত। টেম্পো-ভ্যান-রিকশা কিছুরই দেখা নেই। কী ভেবে জোহরাকে কাঁধে তুলে নিল আতাহার।
'ও আল্লাহ! আতাহার আলী দেহি সিনামাত শুটিং হরে। পেরেমের তাজমহল!'
দীর্ঘপথ হাঁটতে হাঁটতেই মজা করে সহযাত্রী বন্ধুরা।
'হেইডা না রে ! শইলডা বালা না আমার পরিবারের।'
'জানি—'
দীর্ঘশ্বাস ফ্যালে বন্ধুরা। জেনেও যে তামাশা করা, এ যেন শুধু এই দুঃসময়কে ভুলে থাকারই মরিয়া চেষ্টা। তারপর? তারপর থেকে থেকে আকাশে কত না বিজুলি আলো আর কত না অশনি সঙ্কেত! মাথার ওপর বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে কালো মেঘা আর ফুল তোলা মেঘ। ধুলট ও তুলট মেঘা ঘামতে থাকে। কানা মেঘা ও টলমল বারো মেঘার ভাই বজ্র হুহুঙ্কারে নামে—নামে তারা ফুটিক ডলকে চিনার ভাত খাবার দুরূহ বাসনায়। চোখের কাজলে মাখা কাজল মেঘা নামে। নামে আড়িয়া-হাড়িয়া-কুড়িয়া মেঘার নাতি। নামে সিঁদুর-রাঙা মেঘ। তেমন সব তীব্র মেঘ জলে আর ঝড়-বিদ্যুৎ মাথায় নিয়ে দীর্ঘ পথে যেতে যেতে জোহরা বারকয়েক বমি করে। ধারাজল সেই বমি ধুয়ে দেয়। আর আতাহারের দেহে ভর করেছিল যেনবা খোদ মহিষাসুরের শক্তি। এক গর্ভবতী নারীকে কাঁধে নিয়ে, হিম হাওয়া ও বৃষ্টির ভেতরে কিছু পথ টেম্পো, কিছু পথ ভ্যান আবার কিছু পথ পায়ে হেঁটে পাকুন্দিয়া-মটখোলা-টোক অবধি কোনোমতে না হয় তারা পৌঁছাল। কাপাসিয়া থেকে আর একটি যানবাহন নেই। অল্প কিছু টেম্পো-ভ্যান-রিকশা-অটো যা আছে, সব ভাড়া হয়ে আছে। তাতে আকাশের এই তুমুল অবস্থা! কতজনেরই না হাত-পা ধরল সে। কিন্তু পাকুন্দিয়া, মটখোলা আর টোক পার হবার পর কোনো অটো-ভ্যান-সিএনজিই আর খালি নেই। এরপর কাপাসিয়া, গাজীপুর, সাভার থেকে মহাখালী অবধি কাদা ও বৃষ্টির ভেতর, আকাশের কড়াৎ কড়াৎ চিরে যাওয়া বিজলির ভেতর আতাহার আলীর পা জোড়াই একমাত্র সম্বল। কাঁধে তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী। মহাখালী থেকে তেজগাঁ অব্দিও সেই এক জোড়া পা-ই তো শেষ সম্বল। ডান পায়ের রবারের স্যান্ডেলের ফিতা খুলে গেল। যা শালা! যা! শুধু জোহরা বেঁচে থাক আর তার গর্ভের সন্তান। আর খানিকটা পথ গেলেই...আর দশ মিনিট হাঁটলেই 'নিটওয়্যার ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিজ'-এর দরজা। আহ, কোথা থেকে ম-ম করছে নতুন চালের ঘ্রাণ! বৃষ্টি শেষ হয়ে আসছে শহরের রাস্তায়। ভোরের আজানের পরপর বের হয়েছিল তারা। আর এখন এই সন্ধ্যা নেমে আসা খাঁ খাঁ ঢাকা শহরের সোডিয়াম বাতির আলোয় ট্রাকে থামিয়ে চাল দিচ্ছে কারা? একটু দাঁড়াবে? দুই কেজি চাল পেলেও তো এই অবেলায় অনেক! কিন্তু অনেক মানুষ যে সামনে! আর শরীরটা ঠিক তখনি ছেড়ে যায় তার। কাঁধে অবসন্ন, ধারাসিক্ত জোহরাকে নিয়ে পড়ে যেতে যেতে সে টের পায় নাকে এসে লাগছে নতুন চালের ম-ম গন্ধ। গন্ধটা চাড়া দিয়ে উঠছে। যেন প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে উঠছে। যেন পৌষের সকালে মাটির চুলার পাশে মা বসেছে আয়েশ করে। মা কি পিঠা ভাজবে? পায়েস রাঁধবে পৌষের সকালে?
'সরুইন সরুইন!' এতটা পথ কাঁধে করে বয়ে আনায় প্রেম বা কৃতজ্ঞতার বদলে এ কেমন হিসহিসে, ক্ষিপ্ত গলার স্বর জোহরার?
'আমার রক্ত ভাঙতাছে—মায়াগো মায়া—চাকরি, চাকরি! কীরুম বেডাইন যে ভাত দিতারে না?'
ডুকরে কেঁদে উঠতে উঠতে ট্রাক থেকে বিতরণের সময় রাস্তায় ছিটকে পড়া কিছু চালের ভেতরেই শুয়ে পড়ে জোহরা। বড় খালার কাছে সে শুনেছিল যে একাত্তরে মিলিটারির ভয়ে এক গ্রাম থেকে আর এক গ্রামে পালানোর সময়ে খালার প্রথম গর্ভ নষ্ট হয়েছিল। কিন্তু দেশে তো এখন কোনো যুদ্ধ নাই।
নিজেরই শরীর থেকে ভাঙতে থাকা রক্তের কাঁচা গন্ধে মাথাটা কেমন ধরে আসে জোহরার আর তার সালোয়ারের নিচ থেকে চুঁইয়ে রক্ত মিশছিল সেই চালের সাথে, যা সন্ধ্যার পর শহরের সোডিয়াম বাতির আলোয় ভৌতিক দেখায়। আতাহারও সম্ভবত তার দমের শেষটায় চলে এসেছিল। ফ্যাক্টরি গেট আর কতটা দূর? মালিককে কি জানাতে হবে না যে সে আতাহার আলী ও তার স্ত্রী জোহরা সুলতানা বৃষ্টি-বাদলের পরোয়া না করে এতটা পথ হেঁটে এসেছে? এখন গর্ভের সন্তান বিনষ্ট হলেও অথবা সে নিজেও যদি তার শেষনিশ্বাসে পৌঁছে যায়, তবু তো তারা সবার কথা ঠিকঠাক শুনেছে? সব দায়িত্ব পালন করেছে?
'নিকোমেন—'
'নিকোমেন? আমরা জিতেছি? পারস্যের সাথে আমরা জিতেছি?'
দর্পিত উল্লাসে ফেটে পড়ে এথেন্সবাসী।
'কিন্তু তুমি এত ক্লান্ত কেন দূত? পুরো পথে একবারও কি বিশ্রাম নাওনি? কম পথ তো নয়। এতটা দীর্ঘ রাস্তা!'
ঘামে টপটপ কপাল শেষবারের মতো ডান হাতের তালুতে মুছে মেঝেতে গভীর অবসাদে গড়িয়ে পড়ে দূত ফেইডিপ্পিডেস, 'নিকোমেন। আমরা জিতেছি। আমি তোমাদের জানালাম। আমার কর্তব্য পালন করলাম।'
আর সে মাথা তোলেনি। না ৪৯০ অব্দের আগস্টে গ্রিসে, না আজ এগার সিন্দুর-তেজগাঁওয়ের দীর্ঘ পথ চলার পর।

১৯ মে ২০২০