অল্পসল্প দীর্ঘ জীবন

নিজেকে মহাসৌভাগ্যবান মনে হয়। এসেছিলাম হারিকেন–জ্বলা মফস্বল থেকে। এই ঢাকা শহরে কে ছিল আমার? অজানার পথে বেরোবার সময় ভয়ের চোখ পাকানো ছিল, আবার উত্তেজনাও কানের পেছনে ফুঁ দিয়ে লুকিয়ে থাকছিল।

পারুলিয়া গ্রাম যখন আজানে জেগে উঠছে, কাজের ছেলেটা ট্রাংক আর বেডিং নিয়ে রওয়ানা হয়ে যায় রাস্তার দিকে; তখন আম্মার চোখ দিয়ে অঝোরে ঝরছে জল। আব্বা ঘড়ি দেখে বলেন, আর দেরি করা যায় না, এখনই বাস এসে পড়বে।

সে বাস সাতক্ষীরা পর্যন্ত। তারপর নিতে হবে যশোরের গাড়ি। এগারোবার যানবাহন বদলে আরিচা ফেরিঘাটে নেমে যে বাহন নিতে হলো, তা দিয়েছিল সন্মানিত অতিথির অনুভব। বিশালাকৃতির শেভ্রলে ট্যাক্সিতে আরও ছয়জন যাত্রীর সঙ্গে গাদাগাদিকরে বসতে হলেও মনে হয়েছিল রথে চড়ে বসেছি।

ঢাকা কলেজের সামনে সন্ধ্যায় নেমে অনুভব করিনি, এই শহরে আমি নতুন আগন্তুক। আমাকে প্রথম খুব আপনের মতো ইশারায় ডেকেছিল বলাকা।

রিকশার পা-দানিতে ট্রাংক আর বেডিং রেখে তার ওপর পা চড়িয়ে দিয়ে এদিক-ওদিক দেখতে দেখতে যাচ্ছিলাম অচেনা আজিমপুরের দিকে। হঠাৎ চোখে পড়ল আলো–ঝলমলে বলাকা সিনেমা হল। মাথা অনেক উঁচু করে দেখতে হলো টাটকা মুক্তিপ্রাপ্ত'দর্পচূর্ণ ' সিনেমার ব্যানার। পাতনার বিলের পাগলা হাওয়া বুকের ভেতরে হল্লা তুলে দেয়। সিনেমা হল থেকে ছুটে বেরিয়ে আসে ঠান্ডা একটা সৌরভ। মনকে বেঁধে রাখা মুশকিল হয়ে পড়ে। আমি শুনতে পেয়েছিলাম, বলাকা ডাকছে, এসো।

এতকাল কপালে জুটেছে মফস্বল শহরে মুক্তি পাওয়া পুরোনো রদ্দিমার্কা ছবি। সেই সন্ধ্যাবেলায় মনে হয়েছিল, জীবনে এসে গেছে নতুন সকাল। এখন থেকে এই রকম নিত্য-নতুন সব নতুন অভিজ্ঞতা সামনে এসে দাঁড়াবে। সবই ঝলমলে বলাকার মতো।

রিকশা চলছে। কোথায় কত দূর গিয়ে নামতে হবে জানা নেই। আমি পথ মুখস্থ করতে থাকি। যত দূরেই হোক, সেখান থেকে চিনে বলাকা সিনেমা হলে ফিরতে হবে। আজই দেখতে হবে 'দর্পচূর্ণ'।

>

রিকশার পা-দানিতে ট্রাংক আর বেডিং রেখে তার ওপর পা চড়িয়ে দিয়ে এদিক-ওদিক দেখতে দেখতে যাচ্ছিলাম অচেনা আজিমপুরের দিকে। হঠাৎ চোখে পড়ল আলো–ঝলমলে বলাকা সিনেমা হল। মাথা অনেক উঁচু করে দেখতে হলো টাটকা মুক্তিপ্রাপ্ত'দর্পচূর্ণ' সিনেমার ব্যানার। পাতনার বিলের পাগলা হাওয়া বুকের ভেতরে হল্লা তুলে দেয়। সিনেমা হল থেকে ছুটে বেরিয়ে আসে ঠান্ডা একটা সৌরভ। মনকে বেঁধে রাখা মুশকিল হয়ে পড়ে। আমি শুনতে পেয়েছিলাম, বলাকা ডাকছে, এসো।



দুই.
স্বর্গ কেউ দেখেনি, কিন্তু সবার মনের দেয়ালেই স্বর্গের কল্পরূপ বাঁধানো থাকে। সেই রূপ যেন সত্য হয়ে সামনে হাজির। 'দর্পচূর্ণ ' দেখার জন্য লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে। কাত হয়ে উঁকি দিলে সিনেমা হলের ভেতর মহল একটুখানি দেখা যায়। বুকের ঢিপঢিপ বাড়ছে। মনে হচ্ছিল স্বর্গ এ রকমেরই হওয়ার কথা। ভেতর থেকে ঘোর লাগানো হিম হিম সৌরভ ভেসে আসছে।

সাতক্ষীরার মিলনী সিনেমা হলের কথা মনে পড়ে যায়।

ছারপোকার কামড়, ঘামের গন্ধ আর বাদাম ভাঙার শব্দ ডিঙিয়ে আমি এসে পড়েছি স্বপ্নশহরে, যে শহর এই গ্রাম্যকে পরের মতো দেখছে না। অচেনা পথ চিনিয়ে এখানে নিয়ে এসেছে। নিয়ে এসেছে আনন্দ ও বিস্ময়ের সঙ্গে সম্পর্ক পাতিয়ে দিতে। যেনআগে থেকেই রাজধানী শহর আমার আগ্রহের বিষয়গুলো সম্পর্কে অবগত ছিল।

আফজাল হোসেন যখন আর্ট কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র। ছবি: লেখকের অ্যালবাম থেকে
আফজাল হোসেন যখন আর্ট কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র। ছবি: লেখকের অ্যালবাম থেকে

ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় পত্রিকা, খবরের কাগজ থেকে নায়ক-নায়িকাদের ছবি কেটে রাখতাম। একটা মোটা খাতার পাতায় পাতায় আঠা দিয়ে ছবিগুলো সেঁটে চলচ্চিত্র অ্যালবাম বানিয়ে নিয়েছিলাম। কড়া শাসনের হোস্টেলজীবনে তা লুকিয়েরাখতে হতো। জানত যারা, তাদের প্রবল আগ্রহের বিষয় ছিল সেই ছবির খাতা।

আমি স্বপ্নজগতে ঢুকে পড়েছি। অপরূপ দেয়ালে দেয়ালে চমৎকার আলোকিত কাচের বাক্স। আসিতেছে, চলিতেছে, নাউ শোয়িং আর কামিং সুন লেখা সেই সব ঝলমলে কাচবাক্সের ভেতর কত বিচিত্র নামের সিনেমার দৃশ্য ছবি হয়ে ঝুলে আছে। ভিড়জমিয়ে দর্শকেরা আগ্রহ নিয়ে দেখছে। একেকটা মুখে একেক রকমের অভিব্যক্তি। বাক্স থেকে বেরোনো আলোয় উজ্জ্বল মুখগুলো মুগ্ধ হয়ে দেখি। সিনেমার আগে তা মজাদার, মনোমুগ্ধকর আরেক সিনেমা।

গ্রাম ছেড়ে শহরে আসবার দীর্ঘ পথ আমাকে ক্লান্ত করেনি। প্রথম দিনের শেষটা যেন ঢাক-ঢোলের বিশদ বাজনায়, রঙিন আলোয়, বহু মানুষের আনন্দসভায় বিশেষ উদ্‌যাপন হতে চলেছে।

বাড়ির সমুদ্রনীল জানালায় আম্মার মুখখানা দেখতে পাই। আব্বা কী করছেন এখন? হয়তো উঠোনে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছেন। হয়তো গোলাঘরের গায়ে চুন দিয়ে যে নকশা এঁকেছিলাম, আজকে প্রথম মনোযোগ দিয়ে তা দেখছেন।

আম্মা হারিকেনের আলো বাড়িয়ে রেহেলের ওপর রাখা কোরআন শরিফে ডুবে আছেন। দুচোখ থেকে পানি গড়াচ্ছে। আজ সময়ের খেয়াল নেই। পড়া শেষ হলে পবিত্র গ্রন্থখানা বুকে জাপটে আরও কাঁদবেন।

ছোট ভাইটা হয়তো খানিক পরপর ঘরের দরজায় এসে দেখে যাচ্ছে, আম্মার শেষ হলো কি না। রাত অনেক হলো, তার নিশ্চয়ই খুব খিদে পেয়ে গেছে।

(চলবে)

অন্য আলো অনলাইনে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]