৪০০ বছরের পাশবিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে এ প্রতিবাদ: নোয়াম চমস্কি

জর্জ ফ্লয়েড হত্যার প্রতিবাদে ন্যায়বিচার চেয়ে আমেরিকা এখন উত্তাল
জর্জ ফ্লয়েড হত্যার প্রতিবাদে ন্যায়বিচার চেয়ে আমেরিকা এখন উত্তাল
>জর্জ ফ্লয়েড হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে আমেরিকায় বর্তমানে চলমান বিক্ষোভ নিয়ে মার্কিন বুদ্ধিজীবী নোয়াম চমস্কির এই সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ভ্যালেন্টিনা নিকোলাই। এ সাক্ষাৎকারে চমস্কি বলেছেন, এই বিক্ষোভ সাময়িক ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ নয়, বরং ৪০০ বছর ধরে চলতে থাকা আমেরিকান সমাজ ও রাষ্ট্রের বর্ণবাদী আচরণের প্রতিবাদ। ২ জুন ইতালিয়ান দৈনিক ‘ইল মেনিফেস্তো’তে সাক্ষাৎকারটি প্রথম প্রকাশিত হয়। পরদিন ওই পত্রিকা আন্তর্জাতিক সংস্করণে ইংরেজিতে আবার প্রকাশিত হয় সাক্ষাৎকারটি। বর্তমান অনুবাদটি করা হয়েছে ওই ইংরেজি সংস্করণ থেকে। অনুবাদ করেছেন তানভীর আকন্দ

যুক্তরাষ্ট্র জ্বলছে। কালো ও সাদারা একযোগে রাস্তায় নেমে এসে বিক্ষোভ করছে, থামার কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। একাধিক শহরে জারি করা হয়েছে কারফিউ।

করোনা সংকট, বেকারত্ব ও সামাজিক বৈষম্যের কারণে ইতিমধ্যেই ক্ষুব্ধ জনগণের সঙ্গে আপস করার কোনো আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না মার্কিন সরকারের।

আমেরিকার এই প্রতিবাদের ঐতিহাসিক ও সামাজিক কারণ বোঝার জন্য আমরা অধ্যাপক নোয়াম চমস্কিকে কয়েকটি প্রশ্ন করেছিলাম। দুনিয়াজুড়ে আমেরিকার রাজনীতি ও সমাজ বিষয়ে প্রসিদ্ধ পণ্ডিতদের মধ্যে একজন তিনি।


প্রশ্ন: জর্জ ফ্লয়েড হত্যাকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভ পরিণত হয়েছে দাঙ্গায়, যা মিনিয়াপোলিস শহর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি শহরে ছড়িয়ে পড়েছে। এদিকে পেন্টাগন সামরিক পুলিশকে মাঠে নামার নির্দেশ দিয়েছে। অধ্যাপক চমস্কি, যুক্তরাষ্ট্রে আসলে কী ঘটছে? বর্ণবাদ ও শ্বেতাঙ্গ পুলিশ সদস্যের ক্ষমতার অপব্যবহারের বাইরে আরও গভীর কিছু কি রয়েছে এই বিক্ষোভের পেছনে?

নোয়াম চমস্কি: গভীরে যা আছে তা হলো ৪০০ বছরের নির্মম অত্যাচার। প্রথমত, মানব ইতিহাসে দাসত্ব সবচেয়ে জঘন্যতম ব্যবস্থা, যা কিনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের (এবং যুক্তরাষ্ট্রেরও) অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের মূল ভিত্তি। এরপর ১০ বছরের জন্য আসে স্বাধীনতা, যেখানে কালোরা সমাজে প্রবেশ করার অধিকার পায়, অসাধারণ সাফল্যের সঙ্গে তারা সেটা করেছিলও। তারপর উত্তর ও দক্ষিণের মধ্যে হয় চুক্তি, যার ফলে সাবেক দাসরাষ্ট্রগুলো নিজের মতো করে চলার অনুমতি পায়। কালো মানুষদের অপরাধী হিসেবে তুলে ধরতে তারা যা করেছিল তা হলো, ‘ভিন্ন নামে দাসপ্রথা’ প্রতিষ্ঠা করা।

প্রকৃতপক্ষে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পর্যন্ত কার্যকর ছিল এটা, যখন দরকার ছিল শ্রমের। তারপর আপেক্ষিক স্বাধীনতার যুগ আসে। বর্ণবাদী আইনের দ্বারা এর পথ রুদ্ধ করা হয়। এটা এতটাই চরমপন্থী আইন ছিল যে নাৎসিরা পর্যন্ত একে খারিজ করে এবং ফেডারেল আইনের দ্বারা যুদ্ধের পর সরকারি অর্থায়নে তৈরি আবাসনে কালোদের আলাদা করে দেওয়া হয়। বিনা মূল্যে উচ্চশিক্ষার কর্মসূচি থেকেও কালোদের (এবং নারীদের) বাদ দেওয়া হয়। আর তারপর আসে কালোদের অপরাধীকরণের আরও একটা ধাপ।

এর ফলাফল সহজেই অনুমান করা যায়। বর্ণবাদ বহাল থাকে, যদিও আগের থেকে এর তীব্রতা কম। আর যখনই ফ্লয়েড হত্যার মাধ্যমে এই বর্ণবাদের প্রকাশ ঘটে, তখন স্বাভাবিকভাবেই বিস্ফোরণ ঘটে। শ্বেতাঙ্গদের একটা বড় অংশ এতে অংশগ্রহণ করেছে, যা জনগণের অন্তত কিছু অংশ যে এই জঘন্য অভিশাপ থেকে মুক্তি পেয়েছে, তারই প্রতিফলন।

প্রশ্ন: আপনার কি মনে হয় সাম্প্রতিক কালে ফুঁসে ওঠা এই বিক্ষোভে বৈশ্বিক মহামারির কোনো ভূমিকা আছে? এটা কি দেশের বৈষম্য ও সামাজিক ন্যায়বিচারের গভীর সংকটকেই সামনে তুলে আনছে? নাকি এটা কিছুদিন ধরে জমতে থাকা বারুদে আগুনের স্ফুলিঙ্গ ছুড়ে দিয়েছে মাত্র?

নোয়াম চমস্কি: বৈশ্বিক মহামারি কিছু সমস্যাকে সামনে নিয়ে এসেছে। যেমন করোনা সংক্রমণে কালোদের মৃত্যুহার শ্বেতাঙ্গদের তিন গুণ। ট্রাম্পের বদমায়েশির তো কোনো শেষ নেই, মহামারির সুযোগ নিয়ে তিনি বায়ুদূষণ-সংক্রান্ত নীতিমালাগুলো তুলে দিয়েছেন, যার বিধ্বংসী প্রভাব পড়েছে বর্তমান মহামারি পরিস্থিতিতে। বিজনেস প্রেসের হিসাব অনুযায়ী, ১০ হাজারের মতো মানুষের মৃত্যু হতে পারে এর ফলে। এদের মধ্যে কৃষ্ণাঙ্গদের সংখ্যাই বেশি, যারা মূলত সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোতে বাস করে। এই তথ্য জনমতকে কীভাবে প্রভাবিত করবে, সেটা নির্ভর করে তথ্যগুলো আসলে কতটুকু বর্ণবাদী যুক্তিতে আচ্ছন্ন, তার ওপর।

প্রশ্ন: কোনো পরিস্থিতিতেই কি ক্ষুব্ধ জনতার এ রকম সহিংস হয়ে ওঠা ন্যায়সংগত?

নোয়াম চমস্কি: এ প্রশ্নের উত্তর বেশ সহজেই অনুধাবন করা যায়। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, এটা খুব বুদ্ধিমানের কাজ নয়। স্বাভাবিকভাবেই এটা আরও কঠোর নিপীড়নের প্রতি জনসমর্থন তৈরি করে দেয়।

নোয়াম চমস্কি
নোয়াম চমস্কি

প্রশ্ন: বিক্ষোভের জবাবে ডোনাল্ড ট্রাম্প টুইট করেন, ‘লুটপাট শুরু তো, গুলিও শুরু’। পরে তিনি সেটা সরিয়ে ফেলেন, কিন্তু ততক্ষণে আগুনে যথেষ্ট পরিমাণ ঘি ঢালা হয়ে গেছে। বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতার উসকানির কথা বাদ দিলে আর ঠিক কী কারণে এই উক্তি আমেরিকান সমাজকে এত প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছে? সেটা যদি একটু ব্যাখ্যা করতেন। আপনি কি মনে করেন সেই ‘আদি পাপ, আমাদের জাতিকে আজও যা কলঙ্কিত করে রেখেছে’ (জো বাইডেনের উক্তি) ট্রাম্পের উপস্থিতিতে তার ভার বেড়ে গেছে আরও অনেক বেশি? তাঁর এই উত্তেজিত বাগাড়ম্বর কি তাঁকে পোলে এগিয়ে যেতেও সাহায্য করবে, এখন যেখানে বাইডেন এগিয়ে আছেন?

নোয়াম চমস্কি: ৫০ বছর আগে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের জবাবে ফ্লোরিডার এক মেয়রের কথারই পুনরাবৃত্তি করেছেন ট্রাম্প। এর মানে বেশ স্পষ্ট, যদিও ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়লে ট্রাম্প এ নিয়ে মিথ্যা সাফাই গাওয়া শুরু করেন। দাবি করেন যে তিনি আসলে বোঝাতে চেয়েছেন, লুটপাটকারীরাই গুলি ছুড়বে। ট্রাম্প আসলে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছেন, শ্বেতাঙ্গদের শ্রেষ্ঠত্বের দাবিগুলো টেনে এনে ট্রাম্প এই ‘কলঙ্কের দাগ’ আরও বড় করছেন, এটা তাঁর নির্বাচনের ভিত্তি। তবে জনমতে এর প্রভাব অনুমান করা আসলে কঠিন।

প্রশ্ন: উদারনৈতিকদের প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারে আপনার কী মত? সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো থেকে উদারনৈতিক ও বাইডেনের শিক্ষা নেওয়ার মতো কি কিছু আছে?

নোয়াম চমস্কি: শিক্ষা নেওয়া উচিত। তবে নেবে কি নেবে না, সেটা দেখার বিষয়।

প্রশ্ন: শেষ আরেকটি প্রশ্ন। আপনি ‘কালো মানুষদের অপরাধীকরণ’-এর কথা বলেছেন, আপনার বইগুলোতে প্রায়ই এটা নিয়ে বলে থাকেন আপনি। সংক্ষেপে একটু ব্যাখ্যা করবেন কি, আমেরিকার সমাজ ও অর্থনীতিতে এটা কীভাবে কাজ করেছে?

নোয়াম চমস্কি: এই বাক্যাংশের কৃতিত্ব আমার নয়। আমেরিকার সমাজ নিয়ে আলোচনাগুলোতে এটা বেশ পরিচিত। উনিশ শতকের শেষাংশে সাবেক দাসরাষ্ট্রগুলোতে এটি বেশ সুচিন্তিত পরিকল্পনার অংশ ছিল। কোনো কালো মানুষ রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকলে ভবঘুরে অভিযোগে তাকে বন্দী করা হতো; এমন একটা জরিমানা ধরিয়ে দেওয়া হতো, যা তার পক্ষে পরিশোধ করা সম্ভব ছিল না। তাকে সোজা জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হতো। যেখানে নানা কাজে তাকে শ্রমিক হিসেবে কাজে লাগানো যাবে, এমন শ্রমিকের কোনো বিকল্প হয় না যে কিনা নিয়মনিষ্ঠ, কোনো প্রতিবাদ করবে না আর সস্তায় তাকে দিয়ে কাজও করানো যাবে। সেই সময়ের বিপ্লব প্রতিষ্ঠা ও কৃষি ব্যবসার পেছনে একটা বড় ভূমিকা হিসেবে কাজ করেছিল এটা।

অপরাধীকরণের দ্বিতীয় ধাপ শুরু হয় রোনাল্ড রিগ্যানের আমলে। ১৯৮০ সালে তাঁর দায়িত্ব গ্রহণের সময় কারারোধের পরিমাণ ইউরোপের সমান ছিল। এরপরই বিস্ফোরণ ঘটে, ইউরোপকে ছাড়িয়ে সংখ্যাটা অনেক দূর এগিয়ে যায়। কারারুদ্ধদের মধ্যে কালোদের সংখ্যাটা ছিল আনুপাতিক হারে বেশি। এর পেছনে আংশিকভাবে দায়ী ছিল মাদকযুদ্ধের প্রভাব, বাকিটাকে কালোদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতার হার বেশি হওয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত করা যায়। দ্বিতীয় কারণটিকে প্রায়ই বর্ণবাদী যুক্তির পক্ষে প্রমাণ হিসেবে হাজির করা হয়। কিন্তু কালোদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা কেন বেশি, এই প্রশ্নকে আড়াল করা হয়। এটাই নিপীড়িত সমাজের বৈশিষ্ট্য। আর কৃষ্ণাঙ্গদের ক্ষেত্রে এটা তো আরও অনেক বেশি গুরুতর।

অন্য আলো অনলাইনে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]