চে গুয়েভারার রোমাঞ্চকর জীবন ও ভয়ংকর মৃত্যু

>আর্নেস্তো চে গুয়েভারা। বিপ্লবের প্রতিচ্ছবি তিনি। আজ এই মহান বিপ্লবীর জন্মদিন। ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে কিউবায় বিপ্লব সফল করার পর চে বেরিয়ে পড়েছিলেন মূলত বিপ্লবের নেশায়। আদতে তাঁর জীবন ছিল গল্পের মতো রোমাঞ্চকর। এমনকি মৃত্যুর পরও তাঁকে নিয়ে ঘনঘটা কম হয়নি। দুবার সমাহিত হয়েছিলেন তিনি। তবে মৃত্যুতেই থেমে যাননি চে। বরং মৃত্যুর পরই ছড়িয়ে পড়েছেন দেশ থেকে দেশান্তরে। চে গুয়েভারার রোমাঞ্চকর জীবন আর মৃত্যু এবং মৃত্যু-পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে ছোট্ট কিন্তু তথ্যসমৃদ্ধ এই লেখাটি ছাপা হয়েছিল ‘নিউইয়র্ক টাইমস’-এ, ২০১৭ সালের ৯ অক্টোবর। চে গুয়েভারার জন্মদিনের আয়োজনে বাঙালি পাঠকদের জন্য অনুবাদ করে এখানে প্রকাশিত হলো সেই লেখাটি। অনুবাদ করেছেন হুমায়ূন শফিক

৫০ বছর আগে একটি খবর সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে: আবার চে গুয়েভারার মৃত্যু হয়েছে এবং সত্যিই তাই ঘটেছে বলে মনে করে সবাই।

তবুও, সংবাদ সংস্থাগুলো সতর্ক ছিল। একটি গ্রাম্য স্কুলহাইজে বলিভিয়ান সৈন্যরা তাঁকে গুলি করার পরের দিন ‘নিউইয়র্ক টাইমস’-এ একটি নিবন্ধের তৃতীয় লাইনটি ছিল এমন, ‘৩৯ বছর বয়সী মি. গুয়েভারা এর আগেও মারা গিয়েছিলেন বা বন্দী হয়েছিলেন বলে জানা গিয়েছিল।’

তাঁকে নিয়ে সতর্ক হওয়ার জন্য ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল। গুয়েভারার প্রতীকবাদ আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল এবং তিনি কিংবদন্তিতুল্য মূল্যায়ন পাচ্ছিলেন সবার কাছ থেকে। তাঁকে অনেকেই বামপন্থী আন্দোলনের প্রতীক হিসেবে স্বীকার না করে উল্টো তাঁকে ‘মার্কেটিং টুল’ বা ব্যবসার উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করেছে। তাঁর মৃত্যুর পরে অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করেছেন, কীভাবে বামপন্থী আন্দোলন বুর্জোয়াদের জন্য কাজ করে।

কিউবার বিদ্রোহ

এই সবকিছুর আগে, একজন মানুষ যাঁর জন্ম হয়েছিল আর্জেন্টিনায়। প্রথমবারের মতো কিউবায় আসেন। কিউবাতে তখন বিদ্রোহ চলছিল। লোকটি ছিলেন চিকিৎসক। পরবর্তী সময়ে তিনি ফিদেল ও রাউল কাস্ত্রোর সবচেয়ে বিশ্বস্ত কমরেডে পরিণত হন।

টাইমস রিপোর্ট অনুয়ায়ী, ১৯৫৯ সালের জানুয়ারিতে বিদ্রোহ যখন শেষ পর্যায়ে এবং যখন প্রেসিডেন্ট ফুলগেনসিও বাতিস্তা পালিয়েছেন, তখন গুয়েভারার নেতৃত্বে বিদ্রোহীরা হাভানায় প্রবেশ করে। সে সময় মাত্রই তাঁর ভাঙা বাহু ঠিক হয়েছে। তবে চূড়ান্ত যুদ্ধে অবশ্য তিনি নেতৃত্ব দিতে পারেননি।

‘খুবই সহজ আদেশ দিয়েছেন সৈন্যদের’, নিবন্ধে বলা আছে, ‘যাও এবং আক্রমণ করো।’

বিদ্রোহীরা যখন অলস সময় কাটাচ্ছেন, তখন এক সাংবাদিক গুয়েভারাকে তাঁর পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা ফিদেলের জন্য অপেক্ষা করছি।’

এর পরের মাস এবং বছরগুলোতে গুয়েভারা শীর্ষ পর্যায়ের অর্থনৈতিক মন্ত্রী ও কূটনীতিক হওয়ার আগে লা কাবানায় কারাগারে মৃত্যুদণ্ডের তদারকি করছিলেন এবং বিশ্ব ভ্রমণ করছিলেন কিউবার আদর্শ প্রচারের উদ্দেশ্যে।

মৃত্যুর পর বলিভিয়ায় চে গুয়েভারার মৃতদেহ এভাবে প্রদর্শন করা হয়েছিল, ১৯৬৭। ছবি: সংগৃহীত
মৃত্যুর পর বলিভিয়ায় চে গুয়েভারার মৃতদেহ এভাবে প্রদর্শন করা হয়েছিল, ১৯৬৭। ছবি: সংগৃহীত

প্রস্থান ও মৃত্যু

১৯৬৫ সালে অক্টোবরে ফিদেল কাস্ত্রোর চিন্তাভাবনা বেড়ে যায়: গুয়েভারা আরও রহস্যময় হয়ে গিয়েছিলেন এবং কিউবা ছেড়েছিলেন। কাস্ত্রোর কথা অনুয়ায়ী, একটি চিঠি তিনি পেয়েছিলেন গুয়েভারার কাছ থেকে। এরপর সেই চিঠি তিনি উচ্চ স্বরে পাঠ করলেন: ‘কিউবার বিদ্রোহ আমাকে যে কাজ দিয়েছিল, আমার মনে হচ্ছে তা শেষ করতে পেরেছি। আমি আপনাকে বিদায় জানাই।’

ফিদেল আরও পাঠ করলেন, ‘অন্যান্য জাতিকে এখন সাহায্য করার সময় হয়ে গেছে এবং অবশ্যই আপনাকে ছাড়তেই হবে।’

সেই সব জাতির মধ্যে অন্যতম কঙ্গো। যেখানে ছয় মাসের বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়েছিল। এবং তারপর বলিভিয়া, যেখানে তিনি সৈন্যদের থেকে পালিয়ে ছিলেন এবং তাদের সাহায্য করছিল সিআইএ।

গুয়েভারাকে বন্দী করে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁকে হত্যা করা হয়। এই সত্যের কাছাকাছি পৌঁছাতে বেশ কয়েক দিন লেগেছিল। ‘দ্য টাইমস’-এর প্রথম পাতায় একটি নিবন্ধে বলা হয়েছে, বলিভিয়ার সেনাবাহিনী প্রথমে ঘোষণা করেছিল যে তিনি সংঘর্ষে মারা গেছেন এবং তিনি স্বীকার করেছেন যে তিনি বলিভিয়ায় সাত মাসের গেরিলা প্রচারণা চালিয়েছেন এবং তাতে ব্যর্থ হয়েছেন।

পরের দিন তাঁর মৃত্যুর কারণ আরও স্পষ্ট হয়ে গেল: ‘টাইমস’ জানিয়েছে, ‘আজ একটি মেডিকেল প্রতিবেদনে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে রোবার আর্নেস্তো চে গুয়েভারা দক্ষিণ-পূর্ব জঙ্গলে ধরা পড়ার কমপক্ষে ২৪ ঘণ্টা পরে খুন হন।’

এরপর তাঁর মরদেহ নিয়েও রহস্যময় ঘটনা ঘটে। তাঁকে গোপনে একটি গণকবরে সমাধিস্থ করা হয়েছিল। (পরিচয় প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে তাঁর হাত কেটে ফর্মালডিহাইড দিয়ে সংরক্ষণ করা হয়েছিল।)

১৯৫৭ সালে কিউবায় গেরিলাযুদ্ধ চলাকালে কোনো এক মুহূর্তে (পেছনে বাঁ থেকে দ্বিতীয়) চে গুয়েভারা এবং দাঁড়িয়ে আছেন ফিদেল কাস্ত্রো। ছবি: সংগৃহীত
১৯৫৭ সালে কিউবায় গেরিলাযুদ্ধ চলাকালে কোনো এক মুহূর্তে (পেছনে বাঁ থেকে দ্বিতীয়) চে গুয়েভারা এবং দাঁড়িয়ে আছেন ফিদেল কাস্ত্রো। ছবি: সংগৃহীত

দ্বিতীয় দাফন

৩০ বছর পর, জন লি অ্যান্ডারসন যখন গুয়েভারার জীবনী লেখবেন বলে ঠিক করলেন, তাঁর কবরটি কোথায় সেটা জানা জরুরি হয়ে যায়। তখনই খুঁজে বের করা হয় তাঁর কবর এবং দ্বিতীয়বারের মতো কিউবায় পূর্ণ সম্মানের সঙ্গে তাঁর সমাহিতকরণের কাজ সম্পন্ন করা হয়।

‘টাইমস’ জানিয়েছে, ‘সেই উপলক্ষে, ১৯৯৭ সালের অক্টোবরে ফিদেল কাস্ত্রো তাঁকে বিপ্লবীদের দৃষ্টান্ত হিসেবে অভিহিত করেন এবং বলেন, তিনি সর্বত্রই প্রতিরক্ষার জন্য প্রস্তুত থাকতেন।’

অবসরপ্রাপ্ত রাউল বারোসা গঞ্জালেজ গুয়েভারার প্রশংসা করেছেন এমন অনেকের পক্ষ নিয়ে বলেছেন, ‘তিনি তো এখনো বেঁচে আছেন, অথচ আমরা সবাই দুশ্চিন্তা করছি।’

অন্য আলো অনলাইনে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]