হায়! বাড়তি মাশুল

বেশ কয়েক দিন ধরেই একটু ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব। পরিবেশ শীতল। এই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে, তো পরক্ষণেই দেখা যাচ্ছে সূর্যের হাসি। আবার আকাশ মেঘলা হয়ে ভয় দেখাতেও সময় নিচ্ছে না। এমন দিনে কোথায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান শুনতে শুনতে নস্টালজিক হয়ে যাব, তা না করে বসতে হলো হিসাবের খাতা নিয়ে!

সদ্যই আগামী অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করা হলো। এ দেশের সাধারণ নাগরিক হিসেবে কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা না থাকলেও, কিঞ্চিৎ আশা ছিল: যদি এই মারির নিদারুণ কালে কিছুটা স্বস্তি মেলে আরকি! কিন্তু হলো উল্টো ফল। বিলাসদ্রব্যের বিষয়ে কোনোকালেই আগ্রহ নেই। তাই ওই খাতে কর বাড়লেই কী, আর কমলেই–বা কী! ঠিকই ভাবছেন, আসলে সংগতিই নেই। কিন্তু নিত্যদিনের খরচেও যদি বাড়তি টাকা গুনতে হয়, তবে কোথায় যাব বলুন?

সরকারের বাজেটে লাখ লাখ, কোটি কোটি—হাজার কোটি টাকার ব্যাপার। ওদিকে আমাদের হিসাবের খাতায় হাজারের ঘর পেরোতেই জীবন জেরবার। সাধারণেরা ডানে গেলেও কর দিচ্ছেন, বাঁয়ে গেলেও দিচ্ছেন, হয় প্রত্যক্ষ নয় পরোক্ষ। কিন্তু সংকটকালে সব প্রণোদনাই বড়দের ঘরে যাচ্ছে। সাধারণদের আর কে মনে রাখে? এই বেলা ভেবেছিলাম, কিছু প্রণোদনা বুঝি আসবে। কিন্তু কিসের কী! গাড়িতে যাঁরা চড়ে, তাঁরা কি আর চাকার কষ্ট বোঝে!

বাজেট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নই বটে, তবে যতটুকু বুঝলাম, করোনার কোপের মধ্যেই সাধারণ করদাতাদের ওপর চাপ কিছুটা বাড়বে। মোবাইলে ১০০ টাকা ব্যবহার করলে ২৫ টাকাই দিতে হবে সরকারকে। ব্যক্তিশ্রেণির আয়করে কিছু ছাড় আছে অবশ্য। তবে সিপিডি (সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ) বলছে, ব্যক্তিশ্রেণির আয়করের ক্ষেত্রে সরকার যে ছাড় দিয়েছে, তাতে একজন নিম্নবিত্তের কর কমবে ৫ হাজার টাকা। আর অতিধনীর কমবে ২ কোটি ৩৮ লাখ টাকা পর্যন্ত। ব্যবধানটা বিশাল। সিপিডি তাই ধনীদের কেন করছাড় দেওয়া হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।

অর্থাৎ আমাদের মতো সাধারণ মানুষদের এবার কর বেশিই দিতে হচ্ছে। বাড়তি ব্যয় প্রসঙ্গে জানালার ঘোলা কাচে ভাসে বনফুলের মুখ। বনফুল ওরফে বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের লেখা ‘বাড়তি মাশুল’ নামের একটি গল্প আছে। সেই গল্পে একজন সাদামাটা চাকুরে মেলায় হারিয়ে যাওয়া নিজের ছেলেকে খুঁজে পাওয়ার আশায় ছিল। সেই ছেলের মুখ দেখেছে মনে করে ওই ব্যক্তি উঠে বসে অন্য গন্তব্যের ট্রেনে। কিন্তু ঈপ্সিত চেহারাতে খুঁজে পাওয়া যায় না হারিয়ে যাওয়া ছেলেকে। তখন আরেকজন বাবা লোকটির ভুল ভাঙিয়ে দেয়। এরপর ছাপোষা ওই চাকরিজীবীকে নামতে হয় ভুল স্টেশনে। চোখের জলের সঙ্গে সঙ্গে কপালে জোটে ট্রেন ভাড়ার বাড়তি মাশুল।

আমাদের অবস্থাও তেমনি হয়েছে। বাজেট আসার সময় হারিয়ে যাওয়া আপনজনকে খুঁজে পেয়েছি ভেবে আমরা আশাবাদী হয়ে উঠি। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই ভুল ভাঙে। তখন মনোবেদনার সঙ্গে সঙ্গে যুক্ত হয় অর্থক্ষয়।

>আমার কাছে তো কালোটাকা নেই একেবারেই। সাদা আছে যৎসামান্য। আমার মতো অনেকের অবস্থাই নিশ্চয়ই এমন। নিজের টানাপোড়েনের হিসাব কষতে গিয়ে ঠিক কালোটাকার প্রসঙ্গে এসেই পুরোপুরি হতাশ হয়ে গেলাম। বুঝলাম, আলোর আসলে মূল্য খুব একটা নেই। নিকষ অন্ধকারের এখানে খাতির বেশি।

প্রশ্ন আরও আছে। তা হলো কালো নিয়ে। নির্দিষ্ট করে বললে, কালোটাকা নিয়ে। সামনের অর্থবছরে আরও কতটা টানাটানির মধ্যে পড়তে হবে, সেই হিসাব কষতে গিয়েই কালোটাকার প্রসঙ্গে নজর গেল। দেখলাম সেখানে এন্তার সুবিধা। কালোটাকা সাদা করার দারুণ সুযোগ দেওয়া হয়েছে। প্রক্রিয়া অনুসরণ করলেই টাকার উৎস নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। ওই মেশিনে একদিকে কালো ঢুকলেই অন্য দিকে সাদা হয়ে বের হবে। তাই সুর মিলিয়ে গাইতে পারবেন, ‘সাদা, সাদা, আরও সাদা…’।

কিন্তু আমার কাছে তো কালোটাকা নেই একেবারেই। সাদা আছে যৎসামান্য। আমার মতো অনেকের অবস্থাই নিশ্চয়ই এমন। নিজের টানাপোড়েনের হিসাব কষতে গিয়ে ঠিক কালোটাকার প্রসঙ্গে এসেই পুরোপুরি হতাশ হয়ে গেলাম। বুঝলাম, আলোর আসলে মূল্য খুব একটা নেই। নিকষ অন্ধকারের এখানে খাতির বেশি।

এমন হতাশ মুহূর্তেই মনের কোণে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় গেয়ে উঠলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। ‘মেঘ কালো, আঁধার কালো, আর কলঙ্ক যে কালো…’। গানটা গুনগুন করতে করতেই মনটা বিষণ্ন হয়ে এল। একে তো মেঘলা দিন, তার ওপর হিসাবের খাতায় টর্নেডো, শেষ দিকে হতাশার বটিকা—নিদারুণ প্যাকেজ যাকে বলে! উপরি হিসেবে আছে উচ্চ প্রবৃদ্ধির ঝকঝকে অর্জনের ইঁদুরদৌড়ে শামিল হওয়ার চাপ।

তবে চাপমুক্ত হওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। বাজারে গেলে দর দেখা যায় আকাশমুখী। একটিবারও নিচের দিকে তাকায় না। কালোটাকা সাদা করনেওয়ালারা তো সবকিছুরই নাগাল পাবেন। শুভ্র সমুজ্জ্বল হওয়ার স্বীকৃতিও পাবেন। কিন্তু আগে থেকেই সাদা হয়ে থাকা হতভাগ্যদের কী হবে? অন্য কোনো রঙে রাঙানো হবে নাকি? নাকি কলুর বলদ হওয়ার স্বীকৃতি মিলবে?

স্বীকৃতির প্রসঙ্গে মনে পড়ে কবি আবুল হাসানের একটি কবিতা। ‘স্বীকৃতি চাই’ শিরোনামের শেষ কয়েকটি ছত্র বলা যাক—


‘…আমি আমার আলো হবার স্বীকৃতি চাই
স্বীকৃতি দে, স্বীকৃতি দে, স্বীকৃতি দে
অন্ধকারের স্বীকৃতি চাই
স্বীকৃতি দে, স্বীকৃতি দে, স্বীকৃতি দে।’

এ দেশে অন্ধকারের স্বীকৃতি মেলে। শুধু আলোরাই পড়েছে যত গ্যাঁড়াকলে!

অন্য আলো অনলাইনে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]