একটুখানি আঁতুড়কথন

সারা জীবন আব্বাকে একটি পোশাকই পরতে দেখেছি। সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট। কাপড় কিনে বছরে একবারই সেলাই করতেন। দুটো শার্ট, একটি প্যান্ট। মা অনেক চেষ্টা করেও আব্বাকে রঙিন কিছু পরাতে পারেননি। রেগে গিয়ে মা আক্ষেপ করতেন, এমন ‘ঢিলা আস্তিনা’ লোক আমার কপালে জুটল! আমরাও বছরে একবারই নতুন জামাকাপড় পেতাম, তাতেই উচ্ছ্বাসে ভেসে যেতাম। এর বেশিও পাওয়া যায়, এই বোধই ছিল না। 

ভাইবোন সবাই ড্রয়িংরুমেই পড়াশোনা করতাম। পাশে গভীর মনোযোগে আব্বা পেপার পড়তেন। ফাঁকি দেওয়ার কোনো উপায় ছিল না। মুড ভালো থাকলে মা এসে মাঝেমধ্যে উদ্ধার করতেন। সারাক্ষণ কিসের পড়াশোনা! বিদ্যার জাহাজ হবেন একেকজন! অসহ্য লাগে! যা ঘুরে আয়! বিটিভিতে তখন হয়তো ‘দি আ টিম’, ‘ম্যাকগাইভার’ কিংবা ‘স্টিং রে’ চলছে। মা ছাড়া ছেলেমেয়ের মন কে বোঝে এমন!

কম্প্রোমাইজ শব্দটিই আব্বার ডিকশনারিতে ছিল না। সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলেছেন সব সময়। কোনো কষ্ট করতে হয়নি এ জন্য তাঁকে। জন্ম থেকে বিল্ট-ইনই ছিলেন হয়তো এভাবে। ‘জীবনের প্রয়োজনে মাঝেমধ্যে কম্প্রোমাইজ করতে হয়’ দুর্বলের এসব চটকদার কথা আমলে নেননি কখনো। যত দিন বেঁচে ছিলেন শিরদাঁড়া সোজা করেই বেঁচে ছিলেন।

আব্বার আদর্শ থেকে সরে গেছি অনেকখানি। প্রতি মুহূর্তে কম্প্রোমাইজ করি। বসের সঙ্গে একটু উঁচু গলায় বাহাস করলে বস মাইন্ড করলেন কি না, সে দুশ্চিন্তায় পরবর্তী কয়েক রাত ঘুমোতে পারি না ঠিকমতো। কল্পিত ঝড়ের ভয়ে কুঁকড়ে থাকি শামুকের মতো।

>

আব্বার আদর্শ থেকে সরে গেছি অনেকখানি। প্রতি মুহূর্তে কম্প্রোমাইজ করি। বসের সঙ্গে একটু উঁচু গলায় বাহাস করলে বস মাইন্ড করলেন কি না, সে দুশ্চিন্তায় পরবর্তী কয়েক রাত ঘুমোতে পারি না ঠিকমতো। কল্পিত ঝড়ের ভয়ে কুঁকড়ে থাকি শামুকের মতো।

প্রায়ই ভাবি, কেন যে আব্বার অসাধারণ ব্যক্তিত্বের কিছুই ধারণ করতে পারলাম না নিজের মধ্যে! হয়তো তাঁর প্রখর ব্যক্তিত্বের আড়ালে নিজের ব্যক্তিত্ব সেভাবে বিকশিত করার সুযোগ পাইনি।

আব্বার মতো আর হতে পারলাম না এ জীবনে...

বেঁচে থাকতে আব্বাকে কখনো বলাও হয়নি, আমি আজন্ম তাঁর মতো হওয়ার অক্ষম চেষ্টা করে গেছি...

৯ মার্চ ২০০৯ সালে আব্বা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। ১১ বছর পার হয়ে গেল! আল্লাহ, আব্বাকে বেহেশত নসিব করুন। 

অন্য আলো অনলাইনে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]