আমার জীবনের নক্ষত্র

বাবা, বাবা শব্দটি হয়তো হাজারো অপূর্ণতার সাক্ষী। বাবা শব্দটির সঙ্গে রাতজাগা কঠোর পরিশ্রমেরও একটা দারুণ সংযোগ আছে। বাবার সঙ্গে ছেলেদের স্মৃতি একটু বেশিই থাকে। কারণ, বাবার পায়ের পাশে ছোট পায়ে হাঁটার সুযোগ ছেলেরা একটু বেশিই পাই। কিন্তু এখানে বাবার প্রতি ভালোবাসাটাই অপ্রকাশিত থেকে যায়।

‘অপ্রকাশিত ভালোবাসা’ কথাটি উঠলে বাবার কথা সবার আগে মনে পড়াই স্বাভাবিক বলে বোধ হয় আমার। কারণ, অপ্রকাশিত শব্দটির সঙ্গে বাবা শব্দটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত অনেক আগ থেকেই। দিন শেষে অপ্রকাশিত কঠোর পরিশ্রম, বুকভরা কষ্ট আর মাথাভর্তি গিজগিজে চিন্তা নিয়ে মুখে একগাল হাসি ফোটানোতে সক্ষম হয় বারবারই একজন বাবা। আমার ছেলেরাও হয়তো ছোট থেকে এগুলো বাবার কাছ থেকেই শেখেনি। কারণ, দেখা যায় প্রত্যেক ছেলেই বাবা হওয়ার পর এই গুণগুলো পেয়ে যায়। এই রকম অপ্রকাশ করার ক্ষমতাগুলোকে কি গুণ বলে বিশেষায়িত করা উচিত হবে, তা আমার জানার সীমানা অতদূর পৌঁছাতে পারেনি।

ছোটবেলার আমার অনেক বেশি সময় বাবার সঙ্গে কেটেছে। একটু বেশিই চঞ্চল ছিলাম, যার কারণে আব্বুর কাছে বকা খাওয়ার তালিকাটা অনেক দীর্ঘ আমার। মনে পড়ে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির কথা, সেই সময়ে স্কুল ফাঁকি দিতে খুবই পটু ছিলাম। স্কুল থেকে যেভাবেই হোক বাসায় আসতে হবে আমাকে, এটাই ছিল মনোভাব। তবে খুব বেশি দিন বাবার সঙ্গে পেরে উঠেছিলাম না। মানুষটা স্কুলের পুরো সময়টা শ্রেণিকক্ষের বাইরের বেঞ্চিতে বসে থাকত। আমাদের সময়ে এগুলো কিছুটা অস্বাভাবিক দেখত। কারণ, তখন কারও বাবা, মায়েরা ছেলেমেয়েদের সঙ্গে স্কুল গিয়ে বসে থাকত না। তবে হয়তো বাবার এই শাসনগুলোর কারণে দ্বিতীয় শ্রেণির শেষে ফাইনাল পরীক্ষাতে আমি প্রথম হয়েছিলাম। কিন্তু এ জন্য আজও বাবাকে ধন্যবাদটা জানানো হয়নি।

>

খুব বেশি দিন বাবার সঙ্গে পেরে উঠেছিলাম না। মানুষটা স্কুলের পুরো সময়টা শ্রেণিকক্ষের বাইরের বেঞ্চিতে বসে থাকত। আমাদের সময়ে এগুলো কিছুটা অস্বাভাবিক দেখত। কারণ, তখন কারও বাবা, মায়েরা ছেলেমেয়েদের সঙ্গে স্কুল গিয়ে বসে থাকত না। তবে হয়তো বাবার এই শাসনগুলোর কারণে দ্বিতীয় শ্রেণির শেষে ফাইনাল পরীক্ষাতে আমি প্রথম হয়েছিলাম। কিন্তু এ জন্য আজও বাবাকে ধন্যবাদটা জানানো হয়নি।

এরপর সপ্তম শ্রেণিতে থাকা অবস্থায় একবার প্রাচীর থেকে পড়ে গিয়েছিলাম। আজও মনে পড়ে, তখন সবাই অস্থির হয়ে পড়েছিল আমার পা দিয়ে বের হওয়া রক্ত দেখে। বাবা তখনো আমাকে কঠোর শাসন করেছিল সবার সামনেই। আর এ জন্য বাবাকে সেদিন বারবার ওখান থেকে চলে যেতে বলছিল সবাই। কিন্তু বাবারা তো এমনই, তারা শাসন করেছে বলেই আমরা সুস্থ থাকার মানে বুঝেছি। কিন্তু দেখেন, এই সঠিক পথটা চেনাতে গিয়ে কতই না কথা শুনতে হয়েছে আমাদের এই বাবাকে। দিন শেষে আক্ষেপ থেকে যায়, এসবের জন্য সেই বাবার কাছে আজ পর্যন্ত ‘সরি’ শব্দটাও বলে উঠতে পারিনি। জন্ডিস হয়ে এক মাস অসুস্থ ছিলাম। এ সময় মা সারা রাত না ঘুমিয়ে আমার পাশে বসে থেকে, আমার সেবাযত্ন করেছিল। কিন্তু এটা দেখি না যে আমাদের চিকিৎসার টাকা জোগাড় করার জন্য দিনরাত শরীরের রক্ত পানি করে কতটা কষ্ট করেন মধ্যবিত্ত বাবাটি? সারাদিন কাজ শেষে পেটে প্রচণ্ড ক্ষুধা নিয়ে যখন বাড়ি ফেরার পথে কোনো দোকানের সামনে দিয়ে যায়, তখন দোকানে বাহারি রকমের খাবার দেখার পরও নিজে না খেয়ে আমাদের জন্য খাবার কিনে আনা মানুষটা আর কেউ নয়, আমাদের বাবা। পকেটে বাজার করার টাকা নেই, পুরো মাস কীভাবে চলবে সেই চিন্তা না করে আমাদের হাজার টাকার পরীক্ষার ফি, টিউশনের টাকা দেওয়া মানুষটা কিন্তু আর কেউ নয়, মানুষটা আমাদের বাবা।

বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে আমি আজ অবধি বাবার গায়ে দুটোই পাঞ্জাবি দেখে আসছি। অথচ আমাদের জন্য প্রতি ঈদে হাজার টাকার মার্কেট করে দেওয়া মানুষটা কিন্তু বাবা। শেষ কিছুদিন আগে কাছের এক বন্ধুর বাবা মারা যাওয়ার বিষয়টি নিজ চোখে দেখেছিলাম। চারটা দিন তার সঙ্গে ছিলাম। সে ক্ষেত্রে তার প্রতিটা চোখের জলের ফোঁটা অনুভব করেছি। বাবা হারানোর পর তার পায়ের নিচের মাটি সরে যাওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট ছিল। এগুলো যখন ভাবি, তখন নিজের এই বাবাটাও একদিন ছেঁড়ে চলে যাবে, এটা ভেবে চোখে জল গড়ায়। অনেক অনেক ভালোবাসি বাবা তোমায়। কিন্তু জানি না বাবা, কবে তোমায় সরাসরি বলতে পারব, তুমি, হ্যাঁ তুমিই আমার জীবনের জ্বলন্ত নক্ষত্র।

সবশেষে ধন্যবাদ প্রথম আলো এবং অন্য আলো। বাবাকে নিয়ে দু-কথা লেখার এত সুন্দর একটা সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। আর বন্ধুসভাকে ভালোবাসা জানাই।

যোগাযোগবিষয়ক সম্পাদক, মেহেরপুর বন্ধুসভা।

অন্য আলো অনলাইনে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]