বাবার হাতের উষ্ণ চা

বাবা দিবসের কথা যখন মনে হয়, আসলে এত চমৎকার সব স্মৃতির কথা মনে হয়, কোনটা বাদ দিয়ে কোনটা বলব। আমার বাবা অনেকটা সেই সিনেমা, গল্পের উপন্যাসে লেখা বাবাদের মতো। যে বাবা আসলেই তেমনভাবে রাগ করেন না। অবশ্য তাঁর রাগ না করার কারণও আছে, আমাদের মা বাসায় একাধারে আইনপ্রণেতা, বিচারক এবং সর্বশেষে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা হিসেবে কাজ করতেন, কাজেই আমাদের বাবার কাজ ছিল বিরোধী দলের নেতার মতো আমাদের দুই ভাই নামক জনগণের পাশে থাকা, সান্ত্বনা এবং আশার বাণী দেওয়া। বেশির ভাগ অপরাধের বিচার দেখা যেত আব্বু অফিস থেকে আসার আগেই শেষ। তাই আমরা দুই ভাই তো মজা করে প্রায়ই বলি, দেশে দ্রুত বিচার আইন চালু হওয়ার আগেই আমাদের বাসায় দ্রুত বিচার আইন অনেক আগে থেকে চালু ছিল!

হয়তো আমি বড় ছেলে দেখে আমার প্রতি বাবার একটা আলাদা টান রয়েছে। মনে আছে, তখন নার্সারিতে পড়ি, নতুন লিখতে শিখেছি। আম বানান করে লিখতে পারি। বাবা সরকারি ব্যাংকের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন। আর আম আমার সব সময়ই একটা প্রিয় ফল। ছোট্ট এক টুকরা কাগজে লিখে ফেলি আম। বাবার কোটের সাইড পকেটে সেই কাগজটা দিয়ে রাখি। মনে মনে চিন্তা করি, বাবা যেন সেটা দেখে আমার জন্য আম নিয়ে আসেন। আসলেই কাগজটা বাবার চোখে পড়ে, সন্ধ্যায় বাড়ি আসার পরে বাবা আমও নিয়ে আসেন আর আম্মুকে দেখান, আমার লেখা আম লেখা ছোট্ট ফর্দ। এখন যখন মাঝেধ্যে এই দূর দেশে বসে আমের দিকে চোখ যায়, তখন মনে পড়ে ছোটবেলার সেই আমের কথা আর বাবার কথা। এখনো আমের সিজনে আমার বাবা আম কিনে ডিপ ফ্রিজে রেখে দেন, যদি আমি দেশে কোন আকস্মিক ছুটিতে যেতে পারি তখন যেন আম খেতে পারি, এই ভেবে। এখন প্রতিদিন ফোন করলে বলেন, বাবু, তোমার জন্য আম কিনে রেখেছি। আর কদিন পরে রংপুরের হাড়িভাঙ্গা আম পাওয়া যাবে, সেটাও কিনে রাখব। এবার যদি সময় করে আসতে পারো, তাহলে আম খাওয়া যাবে।

বাবা গত বছর ফেসবুক আকাউন্ট খুলেছেন। এখন তাঁর ট্যাবে ফেসবুক ব্যবহার করতে অনেক ভালো লাগে। আমার সঙ্গে ফোনে কথা হলেই বলেন, বাবু, তোমার সব ছবিতে লাভ রিঅ্যাক্ট দিয়ে দিয়েছি।

খুব ছোটবেলায় আমার বাবা তাঁর বাবা-মাকে হারিয়েছেন, নানাবাড়িতে তাঁর বেড়ে ওঠা। এই কারণে বাবা, আমাদের দুই ভাইকে সব সময় বেশি ভালবাসেন। আমাদের প্রতি যে কী রকম দুর্বলতা তাঁর, সেটা নিয়ে আরেকটা ঘটনা না বললেই নয়।

আমার ছোট ভাই তখন সদ্য স্কুলে যাবে। কিন্তু স্কুলে গিয়ে একা বসে থাকতে তার বেজায় অনীহা। ফলে সে শুরু করে দিল বিশাল কান্নাকাটি। কোনোমতেই তাকে বোঝানো যাচ্ছে না। তো ওই বয়সেই আমার ছোট ভাই বাবাকে বলছে, আমি আর স্কুলে থাকতে পারব না, কারণ আমার বুকের বাঁ দিকে ব্যথা করছে...

আমাদের পরিবারে অনেকেরই উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা ছিল, যার কারণে বুকের বাঁ দিকে ব্যথা হওয়াটা যে একটা সিরিয়াস বিষয়, আমার সদ্য ওয়ানে পড়া ভাই সে কথা জানত এবং এটাকেই সে কাজে লাগায়।

বাবা কিন্তু ওর সেই মিথ্যে পেইনকে গুরুত্ব দিয়ে ঠিকই সেই দিন ওর স্কুল মওকুফ করে দিয়েছিলেন। এই হচ্ছেন আমাদের বাবা।

বাবা আমাদের দুই ভাইয়ের সঙ্গে সব সময় বন্ধুর মতো। এখনো প্রতিদিন কাজের ফাঁকে বাবার সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে কথা না বললে আমার দিনই ভালো যায় না।

আমার বাবার বয়স এখন ৬৫-এর ওপরে। তবুও বাসায় সকালের চা নিজের হাতে বানান। আর দেশে থাকতে আমি সকালবেলায় চা খেতে পছন্দ করতাম। এ কারণে আমার জন্য বাবা পড়ার টেবিলে চা নিয়ে আসতেন। সকালবেলায় সেই স্নিগ্ধ আলোয় বাবার হাসিমাখা মুখ, ধূমায়িত সেই চায়ের ঘ্রাণ আমি এখনো অনুভব করি।

দেশ থেকে সাড়ে ছয় হাজার কিলোমিটার দূরের উত্তর মেরুর কাছের দেশ সুইডেনে থাকি। ছুটির দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হয় না, তারপরও যখন সকাল সকাল উঠি, তখন আমিও বাবার যত্ন করে পাঠানো চায়ের প্যাকেটটা কাপবোর্ড থেকে হাতড়ে বের করি। উষ্ণ চায়ের গন্ধ যখন এই হিম হিম ঠান্ডা সকালে ছড়িয়ে পড়ে, যেন খুঁজে পাই আমার চিরচেনা বাবার হাতে বানানো সেই চায়ের স্বাদ।

বাবাকে ভালোবাসতে এই রকম কোনো বিশেষ দিন লাগে না। আমার কাছে প্রতিটি দিনই বাবা দিবস। মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে সব সময় প্রার্থনা করি, তিনি যেন আমার বাবাকে সব সময় সুস্থ রাখেন। বাবা, তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসি!

গবেষক,
পানি সম্পদ প্রকৌশল, কালমার, সুইডেন।

অন্য আলো অনলাইনে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]