বলা হয়নি অনেক কথা

যখন দুপুরের প্রচণ্ড রোদে কাজ শেষ করে এসে আবার গরুর পাল নিয়ে বিলের দিকে বেরিয়ে পড়ো, সেটা আমার চোখে পড়ে, বাবা। সকালে বের হয়ে দুপুরে ঘরে ফেরা, দুপুরে একটু খেয়ে আবার বের হয়ে বিকেলে ঘরে ফেরা, সেটাও আমার চোখে পড়ে। তোমার কষ্ট দেখে আমিও যে আড়ালে কাঁদি, সেটা হয়তো তোমার জানা নেই, বাবা।

বাবা, বিলের মধ্যে তীব্র রোদের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে সেখানে ধান ফলানো কী যে কষ্ট, সেটা আমি ওই দিনই বুঝতে পারি। আমি যেখানে দশ মিনিটের রোদ সহ্য না করতে পেরে অসুস্থ হয়ে পড়ি, সেখানে তুমি কীভাবে দিনের পর দিন ওই বিলে কাটিয়ে দাও, সেটা বুঝতে আমার কষ্ট হয় না। এত সব কষ্টকে পাত্তা না দিয়ে তোমার এই যে সবকিছুকে সহজ করে নেওয়া, তা হয়তো আমাদের মুখের দিকে তাকিয়েই। জীবনের সঙ্গে এত তীব্র সংগ্রামের পরও মাসের শুরুতে যখন তোমার কাছে মেসভাড়া চাই, তখন একটা শব্দও উচ্চারণ না করে চাওয়ার চাইতে বেশি টাকা পাঠিয়ে দাও। মাঝেমধ্যে ভাবি, পৃথিবীতে কি এ রকম মানুষও আছে, যে নিজের সব সুখ জলাঞ্জলি দিয়ে অন্যের জন্য সর্বস্ব বিলিয়ে দেয়? তোমাকে দেখেই মনে হয় পৃথিবীতে এ রকম মানুষ আছে, তোমাদের মতো বাবারাই সেই রকম মানুষ, যারা নিজে না খেতে পেরেও নিজেদের সন্তানদের জন্য ঠিক সময়ে টাকার ব্যবস্থা করে খরচের জন্য পাঠিয়ে দেয়।

বাবা, তোমার এত কষ্ট আমাকে ব্যথা দেয়, কিন্তু কখনো তোমাকে একটু সাহায্য করতে পারি না। দূর থেকে তোমাকে দেখে যাই, দেখি তোমার ত্যাগ। কি রোদ, কি বৃষ্টি, আমাদের কথা ভেবে তোমার কাছে সবকিছুই যেন নস্যি। অসুখে পড়েও তোমার চলন থামে না, হয়তো আমাদের পেট পুরিয়ে রাখার জন্যই তোমার মনন তোমার চলনকে আটকাতে পারে না।

তোমার ত্যাগের শত ছবি জমে গেছে হৃৎপটে। নিজে না খেয়ে যখন আমাকে খাওয়াও, তখন তোমার মুচকি হাসিটা আমি দেখি। নিজে না খেয়ে অন্যকে খাওয়ানোর কী যে আনন্দ, সেটা তোমাকে দেখে বুঝতে পারি। তুমি এ কোন মানব, বাবা? টাকা চাই কিংবা অন্য কিছু চাই, কোনো কিছু দিতেই তুমি একটুও কুণ্ঠাবোধ করো না। নিজের উপার্জনের যে কষ্টের টাকা, তা কাউকে এভাবে বিলিয়ে দিতে দেখিনি। টিউশনি থেকে পাওয়া টাকাগুলো কত হিসাব করে খরচ করি, শুধু নিজে কষ্ট করে উপার্জন করেছি বলে। কিন্তু তুমি যে দিনের পর দিন হিসাব ছাড়াই আমাকে টাকা দিয়ে যাচ্ছ, সেটা ভাবতেই অবাক লাগে।

>মাঝেমধ্যে ভাবি, পৃথিবীতে কি এ রকম মানুষও আছে, যে নিজের সব সুখ জলাঞ্জলি দিয়ে অন্যের জন্য সর্বস্ব বিলিয়ে দেয়? তোমাকে দেখেই মনে হয় পৃথিবীতে এ রকম মানুষ আছে, তোমাদের মতো বাবারাই সেই রকম মানুষ, যারা নিজে না খেতে পেরেও নিজেদের সন্তানদের জন্য ঠিক সময়ে টাকার ব্যবস্থা করে খরচের জন্য পাঠিয়ে দেয়।

বাবা, তোমার হাড়জিরজিরে শরীর দেখে অনেক ব্যথা পাই, শুধু বলতে পারি না, তোমাকে আর এখন থেকে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করা লাগবে না, তোমাকে আর পরিশ্রম করে ধান ফলাতে হবে না, গরু নিয়ে আর বিলে যেতে হবে না। বাবা, গোয়ালে যেমন করে তোমার গরু বাঁধা, তেমন করে আমিও যেন বাঁধা পড়ে আছি নিয়তির কাছে। গ্র্যাজুয়েশন কবে শেষ হবে, কবে একটা ভালো চাকরি জুটিয়ে তোমাকে এত সব কষ্ট থেকে অবসর দেব, সেটাই মাঝেমধ্যে আমার ভাবনার দুয়ারে করাঘাত করে।

তবে বাবা, সময় আর বেশি নেই, মাঝনদী পাড়ি দিয়ে কূলের অনেক কাছে চলে এসেছি। শিক্ষাজীবনের আর তিনটি বছর বাকি, আর একটু ধৈর্য ধরো, বাবা। যে স্বপ্ন নিয়ে আমার জন্য এত শ্রম দিয়ে যাচ্ছ, সে স্বপ্ন সত্য হওয়ার সময় এসে গেছে। তুমিই আমার কাছে সবচেয়ে বড় প্রেরণা। তোমার পরিশ্রম দেখেই তো আমি অনেক বেশি পরিশ্রমের সাহস পাই, তোমার স্বপ্ন থেকেই তো আমি অনেক দূরের পথ পাড়ি দেওয়ার স্বপ্ন দেখি।

বাবা, তোমাকে অনেক কথা বলার থাকলেও বলতে পারি না, দিনের সব পরিশ্রম শেষে তোমার কাছে বসতে চাইলেও বসতে পারি না। শুধু দূর থেকে দেখে যাই তোমার অমানুষিক পরিশ্রম আর ফেলে যাই চোখের কয়েক ফোঁটা জল। আমাকে ক্ষমা করো বাবা, তোমার ওই হাড়ভাঙা খাটুনির ইতি যাতে খুব তাড়াতাড়িই টানতে পারি, সে জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে আমার জন্য প্রার্থনা করো।

শিক্ষার্থী,
পরিসংখ্যান বিভাগ, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

অন্য আলো অনলাইনে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]