রোহিঙ্গা সমস্যার আদ্যন্ত আখ্যান

রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে নানা বিষয়-বিশেষজ্ঞের লেখা দীর্ঘদিন ধরে পড়ে আসছি। কিন্তু এবারই প্রথম এ বিষয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ বই আমাদের হাতে তুলে দিয়েছে প্রথমা প্রকাশন। গবেষক না হয়েও একেবারে জাত গবেষকের মতো বইটি লিখেছেন মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম। পেশায় তিনি পদস্থ সামরিক কর্মকর্তা। এখন অবসরপ্রাপ্ত।

রোহিঙ্গাদের নিয়ে তাঁর লেখা এ বই সমস্যার গভীরতাকে স্পর্শ করতে পেরেছে এ কারণে যে ১৯৯৯ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত—এই চার বছর তিনি মিয়ানমারে ছিলেন। পালন করেছেন সেখানে বাংলাদেশ সরকারের কনস্যুলেট প্রধানের দায়িত্ব। ফলে রোহিঙ্গা সমস্যাকে দেখেছেন সরেজমিন, একেবারে কাছ থেকে। দেখেছেন তাদের ওপর পরিচালিত রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও সীমাহীন দুঃখ-দুর্দশার মুখে তাদের অকথিত অসহায়ত্বকে। আর তারই বিবরণ তুলে ধরেছেন অনুপুঙ্খভাবে। অতীত ও বর্তমান ইতিহাসের পাশাপাশি নানা তথ্যসূত্রেরও আশ্রয় নিয়েছেন লেখক। ফলে এ বই হয়ে উঠেছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সংকটজর্জরিত অতীত আর বর্তমানের এক প্রামাণ্য দলিলস্বরূপ।

বইয়ের ভূমিকায় এমদাদুল ইসলাম আমাদের জানান, ‘রোহিঙ্গারা পুরুষানুক্রমে তাদের মাতৃভূমি আরাকান (বর্তমানের রাখাইন) স্টেটে জীবন কাটিয়ে দিয়েছে কিন্তু তারা জীবনের অর্থ কী, তা বুঝে ওঠার কোনো সুযোগ পায়নি। রোহিঙ্গা জনপদে শিক্ষার আলো কখনো পড়েনি, অনেকটা গুহামানবের ক্ষেত্রে যেমন ঘটেছিল। তারা জানে না পৃথিবীতে সংবাদপত্র আছে, সেই সংবাদপত্রের মাধ্যমে তথ্যের অবাধ প্রবাহ ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। তারা জানে না ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে যেকোনো ঘটনা মানুষকে আলোড়িত করতে পারে। তারা জানে না সোশ্যাল মিডিয়া কী। এ হতদরিদ্র, নিপীড়িত মানুষগুলোর কাছে নিজ নিজ গ্রামই তাদের পৃথিবী।’ এই দীর্ঘ উদ্ধৃতিই আমাদের মনের গভীরে তেমন এক বোধের সঞ্চার করে, যে বোধ পাঠক হিসেবে আমাদের এ বই প্রায় একনিশ্বাসে পড়ে ফেলতে বাধ্য করে।

বর্তমান রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশের কাছে তো বটেই, সারা বিশ্বের কাছেই এক জ্বলন্ত সমস্যা হিসেবে বিদ্যমান। সাম্প্রতিক কালে যে ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা নিজেদের মাতৃভূমি ছেড়ে বাংলাদেশে আশ্রিত হয়েছে, তার মূলে ও নেপথ্যে রয়েছে ইতিহাসের এক দীর্ঘ ধারাক্রম। লেখক এসবই নিজের পঠনপাঠনের অভিজ্ঞতা ও কিছু ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে সরল ভাষাভঙ্গিসহকারে সবিস্তারে তুলে ধরেছেন।

বইয়ের সূচিপত্রের দিকে চোখ বোলালেই পাঠক জেনে যাবেন, এর বিষয়ের গভীরতা কতখানি। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের প্রথম বসতি স্থাপনের কাল থেকে শুরু করে ব্রিটিশ ও ভারতের শাসনকালে তাদের জীবনগত গভীর টানাপোড়েন, শাসককুলের আনুকূল্য রহিত হওয়ার পর তাদের ওপর বর্বর নির্যাতন ও নিগ্রহ নেমে আসে, মুসলমান হওয়ার অপরাধে মিয়ানমারের অন্য ধর্মাবলম্বীদের কোপানলের শিকার হওয়াই শুধু নয়, কালে কালে যুগে যুগে গণহত্যার শিকার হওয়ার ঘটনার পর ঘটনা রোহিঙ্গাদের সে দেশে থিতু হওয়ার অবকাশই দেয়নি। বরাবর তারা ছিল এক তাড়িত জীবনের শিকার। বিশেষ করে ১৯৭০–৮০-এর দশকে সামরিক জান্তা স্বীয় স্বার্থে বৌদ্ধধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে গ্রহণ করার পর থেকে রোহিঙ্গাদের জীবন চরম থেকে চরতমতম নিগ্রহের শিকার হতে থাকে। একের পর এক গণহত্যা, বাস্তুচ্যুত, বসতবাড়ি আগুনে ভস্মীভূত করা ও ধর্ষণ নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় তাদের জীবনে। রোহিঙ্গারা যে বিদ্রোহ করেনি, তা নয়। করেছে, কিন্তু তাদের সেই বিদ্রোহকেও দমিয়ে দিয়ে হত্যা করা হয়েছে বিদ্রোহীদের। হেন নির্যাতন নেই, যা চালানো হয়নি তাদের ওপর। তাদের সার্বিক অধিকার হরণ করা হয় ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উহন ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে।

এ বইয়ে শুধু রোহিঙ্গাদের কথাই নেই, আছে মিয়ানমারে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সশস্ত্র আন্দোলনের বিবরণও। কেন এসব সশস্ত্র আন্দোলন, তুলে ধরা হয়েছে তারও সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।

>রোহিঙ্গা: নিঃসঙ্গ নিপীড়িত জাতিগোষ্ঠী
মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম
প্রচ্ছদ: এরফান উদ্দিন আহমেদ
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা
প্রকাশকাল: জানুয়ারি ২০২০
১৪৩ পৃষ্ঠা
দাম: ৩০০ টাকা।

বইয়টির ‘রোহিঙ্গা এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়’ ও ‘প্রতিবেশীদের স্বার্থ, আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও অন্যান্য’ শিরোনামের অধ্যায় দুটির পাঠ পাঠকের মনে এক বিরল অভিজ্ঞতা এনে দেবে। জানা যাবে রোহিঙ্গা সমস্যা বিষয়ে বিশ্ব সংস্থাগুলোর উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার কথা, সমস্যার সমাধানে তাদের উদ্যোগ ও প্রয়াসের কথা। পাশাপাশি জানা যাবে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে চীন ও ভারতের ভূমিকার কথাও। জানা যাবে, এ বিষয়ে তাদের ভূমিকা কেন সংকীর্ণ স্বার্থতাড়িত।

লেখক পরিশেষে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান বিষয়েও আলোকপাত করেছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর মতামত সত্যিই সুচিন্তিত।

‘প্রোফাইল’ শিরোনামের অধ্যায়টির সংযোজন বইটিকে নিশ্চিতই সমৃদ্ধ করেছে। ‘পরিশিষ্ট’ অধ্যায়ে ‘এ কেমন অংসান সু চি’ এবং ‘আর কখনো নয়’ শিরোনামের লেখা দুটির পাঠ পাঠককে নিশ্চিতই ভাবাবে ও উদ্বেলও করবে।

সার্বিক বিচারে ‘রোহিঙ্গা নিঃসঙ্গ নিপীড়িত জাতিগোষ্ঠী’ একটি গবেষণাসমৃদ্ধ বই। লেখক মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম প্রকৃত গবেষকের মতো এ বই রচনা করে রোহিঙ্গা সমস্যা সম্পর্কে আমাদের গভীর ভাবনার সঙ্গী করেছেন। তাঁকে অভিনন্দন।

অন্য আলোতে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]