ফারুক আহমেদের কবিতা

শহর একটি মায়া

সে চলে যাচ্ছে

চলে যাচ্ছে ঢালু উপত্যকার পথ বেয়ে একা
মেশিনে সকালকে সে সন্ধ্যার সঙ্গে সেলাই করত,
সে দিনভর অনেক রং মাথা গুঁজে সেলাই করত;
সাইকেলের পেছনে একটি গানকে বসিয়ে পৌঁছে
দিত তোমাদের দরজায়।
সে কাপের পর কাপ আনন্দ বানিয়ে হাতে তুলে দিত;
আর চোখজোড়া ভরে থাকত এক দূর গ্রামের ছায়ায়।
উপত্যকার ভাঁজে যে পথ, সে পথ ধরে সে চলে যাচ্ছে।

এ শহরে মাইলের পর মাইল বৃষ্টি হেঁটে সে যাবে
তার প্রেমিকার কাছে, কথার পুডিং নিয়ে
একটা মুহূর্ত ভাগাভাগি করে খাবে বলে;
অথচ তাকে চলে যেতে হচ্ছে উপত্যকা ধরে।
সে জ্যোৎস্না কেটে কেটে বানাত সরোবর
প্রেমিকযুগল যেত যেখানে প্রগলভতায় ভেসে।
সে রিকশা ভরে পৌঁছে দিত লাল-নীল শব্দের তোড়া
তোমরা তা পেয়ে সাজাতে প্রেমিকাকে।
সে শেখাত কীভাবে অরণ্যকে বিলি কেটে
ঢুকে পড়তে হয় গহিনে, স্যাঁতসেঁতে পাতার
নিচে কীভাবে একটি প্রজাপতির বর্ণিলতা
দেয় বেঁচে থাকার রসদ।
শহরের ক্রোধ চেপে ধরে তার হাতে ঘা হয়েছে
তোমাদের আরাম সেলাই করতে করতে তার
হাত দুটা মরা নদীর মতো পক্ষাঘাতগ্রস্ত।
তোমাদের যৌনতার দংশনে সে তার সংসারকে
বেহুলার ভেলার মতো ভাসিয়ে দিয়েছে জলে;
তার হাতে ঘা, তার চোখে গুমোট চাহনি
সে একটি হাবসি ক্রীতদাসের মতো দূরে দাঁড়িয়ে
অপেক্ষা করে করে ক্ষুধা, বিষাদ পকেটে নিয়ে
আস্তে আস্তে উপত্যকার পথে রওনা হয়ে গেল।

যেতে যেতে পথে ফুলের সঙ্গে পাখির সঙ্গে
বাতাসের সঙ্গে বলে গেল, তার সেলাইয়ের গল্প।
সে পৌঁছে দিত বাবার হাতে সন্তানের যে আহ্লাদ;
ঘষে ঘষে সকাল পরিষ্কার করে দেওয়ার যে স্মৃতি;
তাও বলে বলে গুমোট একজোড়া চোখ নিয়ে
চলে যাচ্ছে, বিষাদ মুখ, অভিযোগ নেই তবু।
কিন্তু দেখো বাতাস জেনে গেল
ফুল জেনে গেল, পাখি জেনে গেল।
এই শহর একটি ভোগের থালা নিয়ে বসে আছে;
তারপর আর কিছু নাই, মায়া, প্রেম কিছু নাই।
এই শহর যত বড়, তার দেহখানিও তত বড়;
শুধু হৃদয় শুকিয়ে হারিয়ে যাওয়া শহরের খাল।
সে চলে যাচ্ছে উপত্যকার পথ বেয়ে একা;
থাকছে শহরের পিঠজুড়ে বসে থাকা দালান
শহরের পিঠজুড়ে ছড়িয়ে পড়া পথের নদী;
ক্যাফে, ফুটপাত, থাকছে লোভের ঢেউ;
সে চলে যাচ্ছে ঢালু উপত্যকার পথ বেয়ে একা।
আমরা ক্রিট, ব্যাবিলন, পেত্রা এমন নগরের কথা জানি
হয়তো পিঠভরা দালান নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা
এ শহর লোভের থালায় স্থলতার ভাগাড় নিয়ে বসে থাকবে।

দুই
সমুদ্রকে ডেকে আনো
হাতে গোলাপ ধরিয়ে বলো পাশে বসতে;
নিসর্গকে ডেকে আনো;
বিসমিল্লাহ খাঁর সানাই ধরিয়ে বলো পাশে বসতে।
বকুল ফুলকে ডেকে আনো
হাতে ধরিয়ে দাও মাহমুদের ‘সোনালি কাবিন’।
মাধবীলতাকে ডেকে এনে বলো
‘ছিন্নপত্র’ গাইতে, যেন নদী, যেন গ্রাম, যেন মায়া।
তারপর শহরকে ডাকো, বল মুখোমুখি বসতে;
সে বসে আবৃত্তি করুক জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’,
তার বুকে বুলেটের মতো বিঁধে যাক শব্দ, উপমা;
সে একটি গলিত মোমের মতো একাকার হয়ে
কান্নায় ভেঙে পড়ুক, কান্নার মাতমে অভাবনীয়
এক করুণ দৃশ্যের অবতারণা হোক, যাতে অংশ নেবে
ফুল পাখি মানুষ—সর্বোপরি পৃথিবীর সন্তানেরা।
বাষ্পরুদ্ধ দুচোখে কেঁদে কেঁদে চলে যাওয়া
পৃথিবীর সন্তানদের মুখ মনে করে শহর এক
আশ্চর্য অনুশোচনায় সেজদা দিয়ে পড়ে থাকুক।
তারপর উঠে লাইনে দাঁড়াক
হারিয়ে যাওয়া অবয়বকে ফিরিয়ে আনতে।


যে মুখ হারিয়ে ফেলেছে শহর;
যে শহর অবয়বহীন একটি শরীর নিয়ে
দিন কাটাচ্ছে ভাগাড়, বিষ্ঠা, লোভ আর স্বার্থপরতায়,
তার তলপেটে নিসর্গের উপমা ঢুকিয়ে দাও,
তার স্কুলে স্কুলে পাঠাও কোমলমতী নদীগুলোকে,
তাকে বলো রবীন্দ্রনাথে সমর্পিত হতে...
তাকে বলো সুলতানে মাথা নত করে পড়ে থাকতে।
এভাবে তাকে নিসর্গে, কবিতায়, চিত্রকলায়
খুন করো, সে খুন হোক, ভেঙে পড়ুক, তছনছ হোক
তারপর একটু একটু করে দাঁড়াক, একটু একটু করে
বুঝুক, কেন কবিকে স্যালুট করবে, কেন শিল্পীর হাতে
চুমু দিয়ে সকাল শুরু করতে হবে।
এভাবে সে ঠিক জেনে যাবে
একটা সুর কীভাবে তাকে পৃথিবীর করে দেবে;
কীভাবে জ্ঞান, বোধ তাকে মানবিক হওয়া শেখাবে।
কীভাবে পিঠজুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা দালানগুলো
একেকটি মায়ার জংশন হয়ে উঠতে পারে।


তিন
শহরকে ভেঙে পড়তে দিতে হবে;
তাতে নিসর্গের ছুরি তার তলপেটে ঢুকে
একটি মোহময় মৃত্যু এবং জেগে
ওঠার স্তবক রচনা করবে, তার নিয়তিতে।
শহরকে আমরা ভালোবাসি
শহরকে আমরা তীব্রভাবে ঘৃণা করি
শহর একটি মায়া, শহর একটি খুনির হাত
শহর কফিশপে কাপে চুমুক দিতে দিতে
হাজার হাজার সন্ধ্যাকে হত্যা করে;
শহর একটি ক্ষুধার্ত শিশুকে ফুটপাতে বসিয়ে
যৌন সুড়সুড়ি পেতে চলে যায় ক্ষমতার পকেটে।
আর শিশুটি, আর শিশুটি...বাষ্পরুদ্ধ, ঝাপসা...
শহরের তলপেটে আস্ত একটি নদী ঢুকিয়ে দাও
শহরের তলপেটে ঢুকিয়ে দাও বিত্তহীন মায়াময়
একটি সংসার।
শহর দেখুক প্রেম কী, শহর দেখুক
মানুষ আসলে কংক্রিট আর মেশিন না।
মানুষ আসলে ভালোবাসার একটি রত্নভান্ডার
মানুষ আসলে ভালোবাসায় তাকিয়ে থাকা একজোড়া চোখ।

শহরকে শেষ পর্যন্ত আমরা ভালোবাসি
শহর এই দীর্ঘ অসুখ এবং খুনের শুশ্রূষা পেয়ে
ফিরে আসুক, কান্নায় ভেঙে পড়ে বলুক—
ফুটপাতের শিশুটি আমার মা
শিশুটির মাও আমার মা...

অন্য আলোতে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]