বিদ্বান

আনিসুজ্জামান। ফাইল ছবি
আনিসুজ্জামান। ফাইল ছবি
>সাতচল্লিশোত্তর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের উত্তম ছাত্র ছিলেন সম্প্রতি প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শততম জন্মদিনে তাঁকে নিয়ে লিখেছেন আহমদ কবির।

বাংলাদেশের বুদ্ধিবাদীদের ভুবনে আনিসুজ্জামান, দীর্ঘকাল ব্যেপে নিঃসন্দেহে জনপ্রিয় ও সুখ্যাত ব্যক্তিপুরুষ। বিদ্যা প্রতিষ্ঠানে ও সংস্কৃতি মণ্ডলে তিনি ছিলেন খুব প্রাধান্য শীল। বাংলা বিদ্যা তাঁর প্রতিষ্ঠার ভিত্তি করে দিয়েছিল বহু আগে, যখন তিনি নির্ধারণ করে নিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা পড়বেন এবং পড়লেনও, তরুণ বয়স থেকে, গবেষক ও শিক্ষক হিসেবে খ্যাতিও লাভ করলেন। সাত-চল্লিশোত্তর বাংলা বিভাগের উত্তম ছাত্র তিনি। তাঁর সমসাময়িকদের কিংবা আগের-পরের কারোর কারোর পরীক্ষার ফল তাঁর চেয়ে হয়তো ভালো ছিল, কিন্তু তিনি সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন তাঁর মেধার কারণে। সেই সময়স্তরে যখন মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের নেতৃত্বে নতুন রূপে বাংলা বিভাগ গড়ে উঠছিল এবং বিকশিত হচ্ছিল বিপুল সম্ভাবনা নিয়ে, আনিসুজ্জামান ছিলেন তার উজ্জ্বল ফসল। আনিসুজ্জামানের গবেষণার বিষয় ছিল সময় উপযোগী ও তাৎপর্যপূর্ণ। মুহম্মদ আবদুল হাই-ই তাঁর গবেষণার বিষয় স্থির করে দিয়েছিলেন, যেমন তিনি আরও অনেক গবেষকের ক্ষেত্রেও করেছিলেন। বাঙালি মুসলমানের আত্ম-অনুসন্ধানের কাজ। যে মুসলমান ইংরেজ আমলে শিক্ষা-দীক্ষায় অনগ্রসর, পিছিয়ে পড়া, দেরিতে হলেও তারা আধুনিক শিক্ষার সঙ্গে পরিচিত হয়েছে সময় প্রবাহে এবং লেখাপড়ায় ও চাকরি বৃত্তিতে যুক্ত হয়েছে, সেই মধ্যবিত্ত মুসলমানেরই মানস রূপ ও রূপান্তর কীভাবে ও কোন কোন উপায়ে ঘটেছিল, সামাজিক, সাহিত্যিক সাংস্কৃতিক, আধ্যাত্মিক, অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক জীবনাবহে কোন প্রতিক্রিয়াগুলো ক্রমান্বয়ে সমীকৃত হয়েছিল; তার অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ ওই বয়সে আনিসুজ্জামান নিপুণভাবে করতে পেরেছিলেন। বাঙালি মুসলমানের মানসবিষয়ক প্রাসঙ্গিক লেখালেখি ও গবেষণা আনিসুজ্জামানের আগে কিংবা পরে আরও কেউ কেউ করেছেন, কিন্তু আনিসুজ্জামানের কাজ এই জাতীয় গবেষণার মডেল হিসেবে স্বীকৃত হয়েছিল। সাতচল্লিশোত্তর বাংলা বিভাগের পিএইচডি ডিগ্রি-লক্ষ্য প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণার প্রথম গুরুতর কাজ এটি। সাহিত্যের নান্দনিক অভিপ্রায়ের বা রূপরীতির গবেষণার মূল্য অবশ্যই রয়েছে, কিন্তু মানুষ ও সমাজ নিয়ে ব্যাপক প্রেক্ষাপটে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের তাৎপর্য আলাদা। এই কারণে সেই সমাজের বিদ্বৎমণ্ডলে এবং এ কালেও আনিসুজ্জামানের গবেষণা প্রশংসাধন্য।

মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের প্রিয় ছাত্র আনিসুজ্জামান। হাই প্রবর্তিত বাংলা বিভাগের সুখ্যাত গবেষণা-পত্রিকা ‘সাহিত্য-পত্রিকা’র সহ-সম্পাদকও ছিলেন তিনি। এই পত্রিকায় প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধের তালিকা প্রস্তুতও করে দিয়েছিলেন তিনি। এবং মুসলিম-মানস গবেষণার উপজাত হিসেবে তাঁর ‘মুসলিম বাংলা সাময়িক পত্র’ নামের বৃহৎ আকর-গ্রন্থটিও এই সঙ্গে স্মর্তব্য। এসব গুরুতর কাজ ও বিদ্যা প্রকাশের সুবাদে, ওই বয়সে আনিসুজ্জামান তাঁর শিক্ষকদের পঙ্‌ক্তিতে ঠাঁই পেলেন। সেসব স্বনামধন্য শিক্ষক—মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, মুহম্মদ আবদুল হাই, মুনীর চৌধুরী, আহমদ শরীফ, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, নীলিমা ইব্রাহিম, যাঁরা ছিলেন বয়সে তাঁর অনেক বড়, তাঁদের সারিতে। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, বাঙালির অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক সম্প্রীতির এলাকাগুলো বারবার আক্রান্ত হচ্ছিল। স্বভাবতই বাংলা বিভাগ এর বিরুদ্ধের প্রতিবাদ প্রতিক্রিয়ায় সর্বাগ্রে সাড়া দিয়েছিল, সেই ভাষা আন্দোলনের ক্ষণ থেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য বিভাগের সচেতন শিক্ষকেরা ছাড়াও রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কর্মীরা, প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীরাও এই প্রতিক্রিয়া-প্রতিবাদে যুক্ত হয়েছিলেন। বাংলা ভাষা সংস্কারের নামে অপতৎপরতা এবং রবীন্দ্রসাহিত্য, বিশেষ করে, রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে যে বিধিনিষেধ আরোপিত হয়েছিল, তার প্রতিবাদে বাংলা বিভাগ এগিয়ে এল অগ্রভাগে। মুহম্মদ আবদুল হাই ছিলেন প্রবল রবীন্দ্রানুরাগী। বাংলা বিভাগের অনার্স ও এমএ শ্রেণির পাঠ্য বিষয় হিসেবে রবীন্দ্রনাথের ব্যাপক পঠন-পাঠনের ব্যবস্থা হয়েছিল মুহম্মদ আবদুল হাইয়েরই নেতৃত্বে। তাঁর সহকর্মীদের মধ্যে মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী ছিলেন শান্তিনিকেতনের পড়ুয়া, আনোয়ার পাশা রবীন্দ্র ছোটগল্পের আলোচক, আহমদ শরীফ যিনি সেই সময়ে রবীন্দ্রনাথের মধ্যে দেখেছিলেন বাঙালি রেনেসাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ প্রকাশ, এবং উঠতি তরুণ গবেষকেরা, যাঁরা হাই স্যারের নির্দেশনায় গড়ে উঠছিলেন; এবং অবশ্যই আনিসুজ্জামান, যিনি রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যের নানা দিক নিয়ে প্রবন্ধের দরকারি সংকলন করছিলেন, সবাই বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ শিল্পী এবং শ্রেষ্ঠ বাঙালি রবীন্দ্রনাথের পক্ষে সেদিন শক্ত অবস্থান নিয়েছিলেন। এসব বৃত্তান্ত এ কালের শিক্ষার্থীরা সংস্কৃতিকর্মীরা এবং দলীয় সুযোগ-সুবিধাপ্রাপ্ত বুদ্ধিজীবীরা কতখানি জানেন, সে প্রসঙ্গ তুলতে চাই না। একালের তরুণেরা ইতিহাস পড়েন না, তাঁদের ইতিহাস পড়তে দেওয়া হয় না। বৃত্তান্ত জানলে মূল্যায়ন ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন হবে, ভক্তিগীতি দিয়ে নয়।

আনিসুজ্জামান তরুণ বয়স থেকেই তাঁর সব কাজে শৃঙ্খলা, পারিপাট্য ও সুরুচির পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর লেখা পড়লে এবং তাঁর কাজের ধরন দেখলে সেটি সহজেই বোঝা যায়। এটার একটা কারণ তাঁর সংগঠন-অভিজ্ঞতা। ছাত্রত্বের কালে, তারুণ্যে এবং পরেও তিনি সমাজতান্ত্রিক চিন্তায় আস্থাশীল ছিলেন। সে জন্য সাংগঠনিক কাজে, বিবৃতি তৈরিতে, মুসাবিদায়, স্বাক্ষর সংগ্রহে তাঁর দায় ও দায়িত্ব এসে পড়ত। এ দায়িত্ব তিনি পালন করেছেন সারা জীবন। যখন তিনি বামচিন্তা থেকে সরে এসে তাঁর শিক্ষক মুনীর চৌধুরীর মতো জীবনের মোহে চলে এসেছিলেন, তখনো। অবশ্য এ রূপান্তর ঘটেছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার অনেক পরে, আস্তে আস্তে নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে।

যে আনিসুজ্জামানের অপরিহার্যতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ সব সময় অনুভব করত, সেই তিনিই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করলেন উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের পরে। শিক্ষা ও সংস্কৃতির বৃহৎ ক্ষেত্র ঢাকা ছেড়ে তিনি যে বন-জঙ্গলে সদ্য প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে যোগ দিলেন, তার মুখ্য কারণ উঁচু পদ প্রাপ্তি, গৌণ কারণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অগ্নিধূমের আভাস। দেরি হলো না, অচিরেই অগ্নিপ্রজ্বলিত হলো। বিভাগের কর্ণধার মুহম্মদ আবদুল হাই দুর্ঘটনাজনিত কারণে মারা গেলেন। এই শোকাবহ ঘটনায় আনিসুজ্জামান আচ্ছন্ন ছিলেন; নিজেও দুর্ঘটনাকবলিত হলেন।

বন-পাহাড়ের বিশ্ববিদ্যালয় বটে, কিন্তু চট্টগ্রাম শহর তখন সাহিত্যচর্চা ও সংস্কৃতিকেন্দ্র হিসেবে কোনো অংশে কম নয়। তখন বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের কাল। এ আন্দোলনে আনিসুজ্জামান উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করবেন, তা স্বাভাবিক। বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ তো শুরু হলো চট্টগ্রাম থেকেই। পাকিস্তানি ঘাতক বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আনিসুজ্জামান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের সঙ্গে সপরিবার আগরতলা হয়ে কলকাতায় চলে গেলেন এবং প্রবাসী সরকারের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত হলেন। তত দিনে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ গভীরভাবে শুরু হয়ে গেছে। আনিসুজ্জামান প্রবাসী সরকারের পরিকল্পনা সেলে যুক্ত হলেন এবং মুক্তিযুদ্ধের ন্যায্যতা বোঝানোর জন্য সারা ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ও সভা-সমিতিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করলেন।

এরপর ষোলোই ডিসেম্বরে বিজয় লাভের পরে দেশে ফিরে এসে দেখেন তাঁর প্রিয় শিক্ষক মুনীর চৌধুরী এবং আরও অনেকেই নেই। কর্মস্থল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে গেলেন তিনি। ঢাকার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজের সংযোগ তো ছিলই, তার ওপর দায়িত্ব পড়ল শিক্ষা কমিশনের সদস্য হিসেবে বাংলাদেশের সংবিধানের বাংলা তরজমা তৈরির কাজের। এসব কাজ জাতীয় কর্তব্যের অংশ। সে জন্য তাঁকে আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরিয়ে আনার প্রস্তাব করা হলো। কিন্তু যে বিভাগে পাকিস্তানি আমলে তিনি ছিলেন আদরণীয়, সেই বিভাগের সহকর্মী যাঁরা রাজনৈতিক পরিবর্তনে হঠাৎ প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিলেন, তাঁরা বাংলাদেশের সম্মুখ সারির এই মুক্তিযোদ্ধা ও বিদ্বান শিক্ষকের বিভাগে ফিরে আসার পথে কাঁটা বিছিয়ে দিলেন। এবং অভিমানাহত আনিসুজ্জামানও সংবৃত হয়ে গেলেন। রয়ে গেলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে, দীর্ঘদিন, আরও প্রায় দেড় দশক।