মাইরা ফালান, মাইরা ফালান...

মুগদা জেনারেল হাসপাতালে ক্যানসারে আক্রান্ত মাকে নিয়ে করোনা পরীক্ষা করাতে আসেন ছেলে শাওন। পরীক্ষা তো করাতে পারেননি, উল্টো আনসার সদস্যদের মারধরের শিকার হয়েছেন তিনি। ছবি: সংগৃহীত
মুগদা জেনারেল হাসপাতালে ক্যানসারে আক্রান্ত মাকে নিয়ে করোনা পরীক্ষা করাতে আসেন ছেলে শাওন। পরীক্ষা তো করাতে পারেননি, উল্টো আনসার সদস্যদের মারধরের শিকার হয়েছেন তিনি। ছবি: সংগৃহীত

‘মাইরা ফালান, মাইরা ফালান, ছারপোকাগুলারে মাইরা ফালান...’

বাসার বারান্দায় বসে শুনছিলাম মাইকে এই তারস্বরে ডাক। করোনার এই দিনে যে কোনো ঘোষণাই কেমন জানি আতঙ্ক সৃষ্টি করে। দূর থেকে ভেসে আসা মাইকের বক্তব্য তো আরও। এই আশপাশের এলাকা লকডাউন হলো কি না বা সরকারি কোনো জরুরি ঘোষণা এল কি না—এই সবই ঘোরে মাথায়। উদ্‌গ্রীব হয়ে কান পেতে শুনি মাইকের ভরাট গলা। কিন্তু এবার আশঙ্কা মিলল না। বরং কিছুটা স্বস্তি পেল মন। প্রশ্ন জাগল—কারও বাসাবাড়িতে কি এখনো ছারপোকার অত্যাচার আছে?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় দীর্ঘজীবন হলে কেটেছে। এখনো মনে আছে প্রথম রাত্রিযাপনের স্মৃতি। শরীরের নানা স্থানে ছিল ছারপোকাদের ভোজনের চিহ্ন। ছোট ছোট লাল দাগ। ভেবেছিলাম, রক্ত কি সব শুষেই নিল নাকি?

না, রক্ত সব শেষ হয়নি। হলের বাকিটা জীবন ছারপোকাদের সঙ্গে সংগ্রাম করে ভালোই কেটেছে। একসময় ছারপোকারা ছাড়ও দিয়েছিল। উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ায় খুব বেশি আর কাছে ঘেঁষেনি।

কিন্তু জীবন বড়ই কঠিন। এই কঠিন সত্যকে ভালোবেসেই দিনযাপন করছি। তবে দিন কিংবা রাত কাটানোটা আরও কঠিন করে দিল একটি ছবি। একজন সন্তান তাঁর মাকে নিয়ে গিয়েছিলেন করোনা শনাক্তের পরীক্ষা করাতে। পরীক্ষা তো করাতে পারেনইনি, উল্টো বেদম মার খেয়েছেন। সেই মারধরের ছবি তুলতে গিয়ে নিগৃহীত হয়েছেন সাংবাদিকেরাও। আহা, কী দারুণ!

আচ্ছা, মারধর কোথা থেকে আসে? প্রাথমিকভাবে আসে রাগ থেকে। সেই রাগ বানায় কে? ক্ষমতা? এ ক্ষেত্রে উত্তর, হ্যাঁ। ক্ষমতা বড়ই অদ্ভুত জিনিস। এটি দিয়ে মাকে বাঁচানোর আশায় পাগলপারা সন্তানকে গ্লাভস পরা হাতে চড়-থাপ্পড় মারা যায়। সেই হাত সাংবাদিকের দিকেও এগিয়ে যায়। কারণ, ওই হাত জানে, তার ক্ষমতা হয়তো বাঁধনহারা, হয়তো কোনো জবাবদিহিই নেই!

ছবি তুলতে গেলে ফটো সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হন এক আনসার সদস্য। ছবি: সংগৃহীত
ছবি তুলতে গেলে ফটো সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হন এক আনসার সদস্য। ছবি: সংগৃহীত

ইদানীং কী যেন হয়েছে। কিছু হলেই ভুক্তভোগীর জায়গায় নিজেকে বসিয়ে ফেলি। আমজনতার অংশ তো আমিও। তাই হয়তো অজান্তেই নিজের ‘সৌভাগ্য’ দর্শন হয়ে যায়। ছবিটা দেখে তাই প্রথমেই নিজের মায়ের কথা মনে হলো। তাঁর বয়স হয়েছে। জীবিকার তাগিদে আমাকে ঘরের বাইরে যেতেই হয়। আসা-যাওয়ার পুরো প্রক্রিয়ায় ভাবি, মায়ের জন্য বিপদ ডেকে আনছি না তো? মহামারির এই দিনে এমন ভাবনা তো স্বাভাবিক। এবার দুঃস্বপ্নে দেখি মাকে নিয়ে চিকিৎসা পাওয়ার আশায় গেছি কোথাও। আর চিকিৎসার বদলে পাচ্ছি বেদম মার। ব্যথায় ‘উহ্’ বলে উঠি, স্বপ্ন ভেঙে খানখান হয়ে যায়। বাস্তবে ফিরে আসি। কিন্তু মনে থেকে যায় মারের কালশিটে দাগ।

বুঝতে পারি, আমরা এখন হয়তো ছারপোকা হয়ে গেছি। হুট করে। কাফকার সেই গল্পের মতোই। ভিন্নতা কেবল, কাফকার গল্পটা শেষ হয় একসময়। কিন্তু বড়দের চোখে ছারপোকা হয়ে থাকার আমাদের এই জীবন চলতেই থাকে অনন্তকাল।

>ইদানীং কী যেন হয়েছে। কিছু হলেই ভুক্তভোগীর জায়গায় নিজেকে বসিয়ে ফেলি। আমজনতার অংশ তো আমিও। তাই হয়তো অজান্তেই নিজের ‘সৌভাগ্য’ দর্শন হয়ে যায়। ছবিটা দেখে তাই প্রথমেই নিজের মায়ের কথা মনে হলো।

তাই বলে আবার ভেবে বসবেন না, আমরা কারও রক্ত খাই! দাঁতই তো নেই! আমাদের রক্ত শুষে নেয় বড় বড় ছারপোকারা। আমরা তো বেঁচে থাকার লড়াই লড়তে লড়তেই শেষ। অন্যায়ের কৈফিয়ত চাইলে আবার বড়রাই হাত তুলে আমাদের পেটায়। পেটাতে পেটাতে শুইয়ে দেয় রাস্তায়, পিষে ফেলে। আর আমরা হাঁপাতে হাঁপাতে ভাবি, আমি কী ছারপোকা? নাকি অন্য কোনো পোকা? মারতে এত মরিয়া কেন?

অথচ বড়দের পেট ভরে আমাদের রক্তে। মার খেতে খেতে বুঝি, সেই রক্তের রং লাল। তাতে কি ভাইরাস থাকে? জানতে পারি না। জানতে চাইলেই যে আবার মার খেতে হবে! কাঁহাতক আর মার খাওয়া যায়? তাই মুখ বুজে সব সয়ে নিই। ভাবি, এতে যদি গ্লাভস পরা হাতগুলো একটু দয়া করে! তবে আমাদের আশার গুড়ে বালি ছিটাতে সব সময়ই তৎপর মহামান্যরা।

ওদিকে রাস্তায় সেলসম্যানের চিৎকার চলতেই থাকে। সে চিৎকার করে বলতে থাকে, ‘মাইরা ফালান, মাইরা ফালান, ছারপোকাগুলারে মাইরা ফালান...’।

আর কম্পিউটার স্ক্রিনে টাঙানো ছবির দিকে তাকিয়ে আমি অস্ফুটে বলতে থাকি, ‘মাইরা ফালান, মাইরা ফালান...।’

অন্য আলোতে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]