সাহিত্যের নন্দনতত্ত্ব ও সমাজপ্রগতি

আজ বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান কবি আল মাহমুদের ৮৫তম জন্মদিন। ১৯৮৩ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাহিত্য একাডেমির ব্রাহ্মণবাড়িয়া তৃতীয় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে একটি বক্তৃতা দেন। এর শিরোনাম ছিল ‘সাহিত্যের নন্দনতত্ত্ব ও সমাজপ্রগতি’। মূলত, এই একই বিষয়ের ওপর আল মাহমুদ ছাড়াও প্রাবন্ধিক আবুল কাসেম ফজলুল হকও বক্তব্য দেন। এ ছাড়া আলোচক হিসেবে বক্তব্য দেন গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ।

আল মাহমুদের অভিভাষণটি ধারণযন্ত্র থেকে শ্রুতিলিখন করে পরে প্রকাশিত হয় জয়দুল হোসেন সম্পাদিত এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে প্রকাশিত ‘সাহিত্য একাডেমি পত্রিকা’র ষষ্ঠ সংখ্যায় (জানুয়ারি-মার্চ ১৯৮৭)। পত্রিকাটির সহযোগী সম্পাদক ছিলেন প্রয়াত মাহবুব পিয়াল ও আহমদ আল মামুন। ৩২ বছর আগে প্রকাশিত মূল্যবান এ রচনায় কবিতা, দর্শন ও নিজ শিল্পবিশ্বাস নিয়ে আল মাহমুদের চিন্তারেখা চিত্রিত হয়েছে। তবে এটি এখনো কবির কোনো গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। অগ্রন্থিত অভিভাষণটি তাঁর জন্মদিনে আজ প্রকাশিত হলো।

আজকের সভার সম্মানিত সভাপতি, মঞ্চে উপবিষ্ট আমার ধীমান বন্ধুগণ। সাহিত্য একাডেমির কর্মীবৃন্দ, সুধী ও তরুণ। আমি অবশ্যই প্রথমে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি যে আমার শত ব্যস্ততার মধ্যেও, দুর্ভাগ্যজনক ব্যস্ততার মধ্যেও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাহিত্য একাডেমি তাদের এই অনুষ্ঠানে আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। আমি খুব জরুরি কাজ ফেলে অসুস্থ শরীর নিয়েও এখানে উপস্থিত হয়েছি। হয়েছি এই কারণে যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যেমন সাহিত্য-সংস্কৃতির দিক দিয়ে আমার জন্মস্থান, তেমনি আমার পিতৃকুল ও মাতৃকুলের শিকড়ও এখানেই প্রোথিত। সে কারণেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ডাক অস্বীকার করা আমার পক্ষে একটু দুরূহ কাজ। আজকে এখানে যারা শ্রোতা, তাদের মধ্যে অধিকাংশই তরুণ, হয়তো তাদের বাবা বা ভ্রাতাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল। কাজেই আজকে আমাকে যা বলতে হবে, তা অত্যন্ত সতর্কভাবেই বলা উচিত।

আশির দশকে আল মাহমুদ। ছবি: সংগৃহীত
আশির দশকে আল মাহমুদ। ছবি: সংগৃহীত

আমি সাধারণত একজন কবিমাত্র। খুব একজন তাত্ত্বিকও নই। আজ যে বিষয় নির্বাচন করে এখানে আলোচনা হয়েছে, দয়া করে আমার তরুণ বন্ধু এবং লেখক শান্তনু কায়সার (উপস্থাপক) সেই গুরুভার বিষয় থেকে আমাকে রেহাই দিয়েছেন। তবু আমি দু-একটি কথা ওই বিষয়ের ওপরও বলব। কারণ, এই বিষয়টি নন্দনতত্ত্ব ও সমাজপ্রগতির সম্পর্ক ও সূত্রগুলো নিয়ে আলোচনা এবং দু-একটি কথা এই সভায় ইতিমধ্যেই হয়েছে এবং খুব মনোমুগ্ধকর আলোচনা হয়েছে, যদিও আমি নানান কারণেই এখন ভিন্নমত পোষণ করি। আমার মতপার্থক্যের জন্য এই যে একটি বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে, এই বিতর্ক ক্রমাগত ঢাকা থেকে আস্তে আস্তে কলকাতা, কলকাতা থেকে দিল্লি পর্যন্ত ছড়িয়ে গিয়েছে, যদিও আমি খুব ক্ষুদ্র মানুষ। কিন্তু বিষয়টি যেহেতু বিতর্ক, সে জন্য সেটি সর্বত্রই আলোচিত হয়েছে। কলকাতায় সমালোচনা হয়েছে, ঢাকায় সমালোচনা হয়েছে। আমার জন্য কোথাও শান্তির পথ ছিল না; সমালোচনার কঠিন ও কঠোর পথ সর্বত্রই আমার জন্য দ্বার খুলে দিয়েছে। কাজেই আমার বক্তব্য যেহেতু বিতর্কমূলক এবং সেই বিতর্ক খানিকটা যখন আপনারা জানেন, তখন আমি আর সে সম্পর্কে কিছু বলতে চাই না।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এমন একটি আনন্দদায়ক সভায় সেটা আমি করতেও চাই না। আর আমার সম্পর্কে সৃষ্ট ও বিতর্কের কারণ আমার গ্রন্থাদিতে, আমার বক্তব্যে, আমার সাম্প্রতিক রচনায় যেহেতু বিদ্যমান রয়েছে, যাঁদের সাহস রয়েছে, যাঁরা আমার প্রকৃত বন্ধু, তাঁরা আমার বিরোধিতা করে সাহিত্যিক জবাব দেবেন। আমিও মনে করি, আমি নিরস্ত্র ব্যক্তি হলেও আমার কলম এখনো শুকিয়ে যায়নি, কবজিতে খানিকটা শক্তি ধারণ করি; আমি সেভাবেই সেটা দিতে চাই।

আমার সম্পর্কে সৃষ্ট ও বিতর্কের কারণ আমার গ্রন্থাদিতে, আমার বক্তব্যে, আমার সাম্প্রতিক রচনায় যেহেতু বিদ্যমান রয়েছে, যাঁদের সাহস রয়েছে, যাঁরা আমার প্রকৃত বন্ধু, তাঁরা আমার বিরোধিতা করে সাহিত্যিক জবাব দেবেন। আমিও মনে করি, আমি নিরস্ত্র ব্যক্তি হলেও আমার কলম এখনো শুকিয়ে যায়নি, কবজিতে খানিকটা শক্তি ধারণ করি; আমি সেভাবেই সেটা দিতে চাই।

আপনাদের সঙ্গে আমার খুব যে একটা বিরোধ রয়েছে, সেটা আমি মনে করি না। আপনারা মানুষের প্রগতিতে বিশ্বাস করেন। আমিও মানুষের প্রগতিতে বিশ্বাস করি। আপনারা মানুষের সুখী সমাজে বিশ্বাস করেন। আমিও মানুষের সুখী সমাজে বিশ্বাস করি। পথ আমাদের ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু এক জায়গায়ই আমরা পৌঁছাতে চাই, যেখানে মানবসমাজ সুখী হবে। মূলত, আমি একজন মানবতাবাদী, যদিও আমি অসংখ্য মানুষের মতো ধর্মে বিশ্বাস করি। তবে মানুষের সুখ, মানুষের শান্তি, মানুষের এই গ্রহে বেঁচে থাকার অধিকার যে আজ হুমকির সম্মুখীন, আমি এর বিরোধিতা করি। মানুষকে যারা এই পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে চায়, আমি তাদের সমালোচক। যারা মানুষের উচ্ছেদকামী, আমি তাদের উচ্ছেদকামী। কারণ, যাঁরা প্রগতিশীল সমাজ নির্মাণ করতে চান, তাঁদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক শত্রুতামূলক নয়; সম্পর্কটি অত্যন্ত কাছাকাছি। আমি আগেও বলেছি, প্রায় একটি সুতার পার্থক্য মাত্র।

আল মাহমুদ। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম
আল মাহমুদ। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম

একটি কথা আমি বলতে চাই, মাও সে তুং বলেছেন, বিপ্লব একটি শুচিকর্ম নয়। এটা হলো একটা নিষ্ঠুরতার কাজ। কারণ, তাতে সমাজকে পাল্টে ফেলতে হয়। তাহলে শুচিকর্মটি কী? বিপ্লব যাঁরা করেন, তাঁরা কেমন মানুষ? একদল আত্মত্যাগী তরুণ কিংবা একটি আত্মত্যাগী শ্রেণি। তেমনি শিল্প যাঁরা সৃষ্টি করেন, তাঁরাও মানুষ। এই যে মাও সে তুং বললেন, বিপ্লব একটা শুচিকর্ম নয়, এটা একটা নিষ্ঠুরতার কাজ। সমাজপ্রগতি এই বিপ্লব ছাড়া সম্ভব নয়। এ কারণেই আমিও নন্দন-শিষ্টাচার-শিল্প প্রভৃতির পাশাপাশি চলে এসেছি। যে মানুষ বিপ্লব সাধন করেন, তিনি আবার গান শুনতেও ভালোবাসেন। তাহলে সম্পর্কটা বোঝা যায় যে এটি খুব কাছাকাছি মানুষেরই একটি গুণ। মানুষ যখন বিপ্লব করে, তখন তার মধ্যে কী জাগ্রত হয়? প্রতিহিংসা জাগ্রত হয়, ক্রোধ জাগ্রত হয়। শোষণের বিরুদ্ধে তার জেগে ওঠে এক মানবিক অভীপ্সা। আর যিনি কবিতা রচনা করেন, সেই বিপ্লবের মধ্যে তিনি কী দেখেন? তিনি এর মধ্যে দেখেন একটি আনন্দকে, একটি স্থিতিশীল সামাজিক গুণকে। এভাবেই মানবসমাজ টিকে আছে, এভাবেই আমরা চিরকাল বড় বড় নগর গড়ে তুলেছি, আমরা বেঁচেও আছি এভাবে। তাহলে একজন শিল্পীর সঙ্গে একজন বিপ্লবীর খুব একটা দূরত্ব সৃষ্টি না করে আমরা কি পারি না যে বিপ্লবী বিপ্লব করবে তাকে সেই শিক্ষায় শিক্ষিত করতে, যে শিক্ষা কবিতাকে ভালোবাসে; যে শিক্ষা শুধু হিংস্রতাকেই নয়, একই সঙ্গে পুষ্পকেও ভালোবাসে, নারীর হাসিকেও ভালোবাসে, সংগীতকেও ভালোবাসে। আমার মনে হয়, এটি আমরা করতে পারি। কারণ, এটি একটি সম্মিলিত রূপ। নিশ্চয়ই মহামানবে আমরা বিশ্বাস করি, সে অর্থে স্বীকার করি মাও সে তুংকেও। কিন্তু সমাজপ্রগতি শুধু এই ছবি নিয়েই বসে থাকেনি, চীনেও তা বসে থাকেনি। সেখানে মাও সে তুংকেও একসময় সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়। এটা হলো বিপ্লবের ধর্ম, মানবপ্রগতির ধর্ম। একসময় যা ছিল সবার প্রশংসার ব্যাপার, তারপরে তা নিন্দিত হয়। সে জন্যই তো দেখা যায়, এককালের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি, বিপ্লবী, পরবর্তীকালে অন্যের দ্বারা সমালোচিত হচ্ছেন, তাই নয় কি? তাহলে পণ্ডিতেরা তার বিচার করবেন।