আমার মামা আনিসুজ্জামান

>
জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান

সদ্য প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের যে অবয়বটি আমাদের চোখে ভাসে, সেটি এক বিদ্বানের, একজন অবিচল মানুষের। তবে পারিবারিক আবহে তিনি ছিলেন অন্য রকম। এই লেখায় অজানা সেসব গল্প জানাচ্ছেন আনিসুজ্জামানের জ্যেষ্ঠ ভাগনে, ম্যাক্সিলোফেশিয়াল সার্জন অধ্যাপক ডা. আল মামুন ফেরদৌসী।

জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান কিছুদিন আগে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। কর্মজীবনে তিনি বহু মানুষের সংস্পর্শে এসেছিলেন। অনেকেই তাঁর গুণগ্রাহী। তিনি ছিলেন আমার মামা। মামাকে আমি যেভাবে দেখেছি, তা এক অনন্য অভিজ্ঞতা।

আমাদের তখন অনেক কম বয়স। বোধ হয় স্কুলে পড়ি। মামা লিখলেন:

টেলিগ্রাফের তারে এক সারি কাক

হঠাৎ শুনতে পেল প্রকৃতির ডাক

সেই ডাকে যেই তারা দিতে গেল সাড়া

নিচে সব লোকজন ছিল বসে খাড়া

টেলিগ্রাফ তারগুলো শুধু পেল নাড়া।

‘নিচে সব লোকজন ছিল বসে খাড়া’র পরে স্পষ্ট করে তিনি লেখেননি টেলিগ্রাফের তার কেন নাড়া পেয়েছিল। পড়ুয়ারাই বুঝে নিন। খেলাচ্ছলে লেখা এসব পঙ্‌ক্তি থেকে তাঁর রসবোধ আন্দাজ করা যায়।

আমরা তখন বরিশালে। আব্বার সরকারি কর্মস্থল। সাল ১৯৫২। ভাষা আন্দোলন চলছে। মনে পড়ে, আম্মা খুবই অস্থির আর চিন্তিত ছিলেন মামাকে নিয়ে। আমি তখন ছোট। বুঝতেই পারছিলাম না, আম্মা এত অস্থির কেন। একুশে ফেব্রুয়ারি রেডিওতে ছাত্রদের ওপর গুলি আর ছাত্রদের মৃত্যুর খবরে আম্মার অস্থিরতা আরও বেড়ে গিয়েছিল। পরে মামার কিছু হয়নি জেনে আম্মা কিছুটা আশ্বস্ত হন।এরপর জানতে পেরেছি, ভাষা আন্দোলনে মামা শামিল ছিলেন।

বরিশাল থেকে অল্প দিনের জন্য ঢাকাতে এসে পরপরই আব্বার আবার বদলি হলো রংপুরে। মামা রংপুরে আমাদের কাছে বেড়াতে এসেছিলেন। সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন আমাদের আরেক আত্মীয়, মামার ঘনিষ্ঠ বন্ধু আহমদ মামাকে। খুবই আনন্দে কাটল কয়েকটা দিন। সেই স্মৃতি ভোলার নয়। অনেক জায়গাতেই ঘুরে বেড়িয়েছিলেন দুজনে মিলে। আমাদের বাড়িতে তাঁদের রংপুরের বন্ধুদের আনাগোনা আমাদের ও সমস্ত পাড়াপড়শিদের আনন্দ মাতিয়ে রেখেছিল।

মামার স্বভাবসুলভ ব্যক্তিত্ব এবং কথা বলে মানুষকে আপন করে নেওয়ার ক্ষমতা ছিল অপরিসীম। বন্ধুরা বলত, ‘মনেই হচ্ছে না যে তোর মামা। মনে হচ্ছে আমাদেরও মামা।’ আমাদের সেসব পড়শির অনেকের সঙ্গেই মামার যোগাযোগ দীর্ঘদিন টিকে ছিল।

মামা আরেকবার রংপুরে এসেছিলেন। সেবার আমরা দার্জিলিংয়ে বেড়াতে যাই। সারাটা পথ মামা আমাদের নানা মজার মজার গল্প আর হাসির কথায় মাতিয়ে রেখেছিলেন। রংপুর থেকে চিলাহাটি-হলদিবাড়ি হয়ে শিলিগুড়ির রেলপথ যে কীভাবে পার হয়ে গেল, বুঝতেই পারিনি। শিলিগুড়ি থেকে ছিল মর্টিন রেল। ছোট সেই রেলওয়ে এখনো আছে। দার্জিলিংয়ের রেললাইনটা রাস্তা ঘেঁষে। পাশেই গাড়ি চলার পথ। ছোটবেলা থেকেই আমার গাড়ি দেখার শখ, কোনটা কী মডেল, কোন মেক—এই সব। দার্জিলিং যাওয়ার পথে ট্রেনের পাশের রাস্তায় নানা ধরনের ও মডেলের গাড়ি দেখতে আমি ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। বেশ কিছুক্ষণ পর মামা বললেন, ‘আরে, তুই তো দেখছি গাড়ি দেখতেই ব্যস্ত। এসব তো অন্য সময়েই দেখতে পাবি। এদিকে যে পাহাড়, ঝরনা আর ও পাহাড়ি ফুলের সৌন্দর্য সবই ফেলে এলি, ওগুলো আর দেখতে পাবি?’ সেই বয়সে পুরো উপলব্ধি না করতে পারলেও মামার কথার সত্যটা বুঝতে পেরেছিলাম।

আমরা যখন ছোট, আনিস মামা তখন একবার কলকাতা গেলেন। ফেরার সময় আমাদের জন্য নিয়ে এলেন চকলেট আর তিনটি বই—সুকুমার রায়ের ‘আবোল–তাবোল’, ‘হযবরল’, ‘পাগলা দাশু’। আমাদের দেখিয়ে দিয়েছিলেন, বইগুলো কীভাবে পড়লে আমরা আনন্দ পাব। এসব কথা সেই কবেকার। আমিই এখন ৭৬। কিন্তু এখনো সদ্যই উপহার পাওয়া সেই বইগুলো আমি মামার শেখানো ঢঙেই পড়ছি।

আমার পড়াশোনা ঢাকায়, নানাবাড়িতে থেকে। সেই বাড়িতে মামাকে আরও কাছ থেকে দেখলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ ক্লাসের ছাত্র। রোজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতেন। নম্র, সাবলীল ও পরিচ্ছন্ন। মানুষ হিসেবে উদার মনোভাবের সঙ্গে সংগত বিবেক ও নীতির অধিকারী। সবার প্রিয়পাত্র।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় মামাকে কখনোই পাড়ায় অযথা ঘোরাঘুরি করতে দেখিনি। তবে ছাত্র অবস্থা থেকেই তাঁর প্রতি পাড়ার সবার ছিল সম্ভ্রম। মামা নিজের পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। মিশতেন নিজেরই বন্ধুদের সঙ্গে, যাঁর বেশির ভাগই ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। পরে কেউ কেউ শিক্ষক হয়েছিলেন। মামার সূত্রে তাঁরা সবাই সম্পর্কে আমাদের মামা হয়ে উঠেছিলেন। আর আমি ছিলাম তাঁদের অত্যন্ত স্নেহভাজন।

ছোট একটা ঘটনা মনে পড়ছে। আমি তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজে বিডিএস কোর্সের প্রথম বর্ষের ছাত্র। নানা আর মামা একবার ঠিক করলেন, দুপুরে আমার কলেজ ক্যানটিনে খাওয়া চলবে না। আমাকে খেতে হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ক্লাবে, মামার কাছে গিয়ে। মামা তখন ওখানে পড়াচ্ছেন। দুপুরে খাওয়ার সেই নিয়ম চালু হলো। একদিন দুপুরে গিয়ে দেখি, মামা তখনো খেতে আসেননি। আমি ফিরে আসছি। সিঁড়িতে গিয়াস মামার (গিয়াসউদ্দীন আহমেদ, মুক্তিযুদ্ধে আলবদরদের হাতে শহীদ) সঙ্গে দেখা। জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোথায় যাচ্ছ? খাওয়া হয়েছে?’ মামা নেই, এ কথা জানাতেই তিনি হাসিমুখে বললেন, ‘চলো ওপরে। তোমার আরও মামা আছে। খেয়ে যাও।’ এসব সস্নেহ স্মৃতি কি ভোলা সম্ভব? মামার স্নেহের মর্যাদার কারণেই এখনো অমলিন তাঁদের সেই আদর–স্নেহ আমি পেয়েছিলাম।