চিরকালের দ্বন্দ্বের ভেতর পাঁজর ভাঙা সুর

সৈয়দ মহিউদ্দিন
সৈয়দ মহিউদ্দিন
>কয়েক বছর আগে ডিসি পাহাড়ে এক অনুষ্ঠানের পর মঞ্চ থেকে নামতে গিয়ে পা ভেঙেছে লোকগানের রূপকার সৈয়দ মহিউদ্দিনের। সেই থেকে প্রায় পঙ্গু নিঃসঙ্গ জীবন কাটাচ্ছেন। কদিন আগে প্রায় ২৩ দিন হাসপাতালে কাটিয়ে এখন আবার ঘরবন্দী। কিন্তু মন ভাঙেনি। তাঁর গানের জগৎ নিয়ে লিখেছেন ওমর কায়সার।

দেহ আর প্রাণ। একই সত্তার মধ্যে দুটোর অস্তিত্ব। দুটোর মধ্যে বিরোধ। তাদের শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই। দেহ বলে, ‘আমি তোকে আশ্রয় দিয়েছি।’ প্রাণ বলে, ‘আমি ছাড়া তুই অচল, যেদিন আমি উড়াল দেব, তোর ব্যবস্থা কই?’ দুয়ের দ্বন্দ্বের মধ্যে লেখক বলেন, ‘দুজনের মধ্যে আমি কার পক্ষে সায় দেব?’ দৃশ্যমান আর অদৃশ্যের এই দ্বন্দ্বে গীতিকার সৈয়দ মহিউদ্দিন ধন্দে পড়ে যান। আর ধন্দ যখন সহজ ভাষার ছন্দে লোকগানের সুরে উদ্ভাসিত হয়, তখন শ্রোতাকে টেনে নিয়ে যায় এক চিরায়ত ভাবের জগতে।

আমাদের প্রতিদিনকার চেনা-অচেনা জগতের সবখানেই এ রকম দ্বন্দ্ব চিরন্তন। বস্তু কিংবা ভাব, সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি, ব্যক্তি ও সমষ্টি সবখানেই নিরন্ত্র//// দ্বন্দ্ব। আর তাকেই সুরের আনুবীক্ষণিক দৃষ্টিতে আবিষ্কার করেন সৈয়দ মহিউদ্দিন। তাঁর গানে আমরা শুনি দ্বান্দ্বিক বাস্তবতার প্রতিফলন।

মানুষের প্রথম বাস্তবতা তার জন্ম। আর তার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মৃত্যু। জন্মকে যে প্রতিনিয়ত শাসন করছে। মহিউদ্দিন তাই জন্মকে আঙুল উঁচিয়ে বলেন, ‘আছে বলে পরান পাখি, গায়ের জোরে হাঁকাহাঁকি/ দমের হাওয়া অবিশ্বাসী/ পুট্টুস কইরা দেহ ছাড়ি ধাইতে কতক্ষণ।’

জন্ম-মৃত্যুর এই দোলাচলের মাঝখানে যে জীবন, সেটাও নিরন্ত্র লড়াইয়ে ভেতর চলে। মানুষ যেন এখনো সেই প্রাগৈতিহাসিক আমলের হোমোস্যাপিয়ানদের আমল থেকে এক পা-ও এগোতে পারেনি। তাকে তাড়িয়ে বেড়ায় সেই ক্ষুধা। মানুষ আক্রান্ত হয় জ্বরায়। নানা প্রকারে আর আকারে শ্রেণিভেদ মানুষে মানুষে, বিভেদ আর বিভক্তি আজও মানুষকে মানুষ থেকে আলাদা করে রাখে। যুদ্ধ, হিংসা, কান্না মানুষের ললাটে উল্কির মতো স্থায়ী হয়ে লেগে আছে। মানুষের গল্প এখনো ডিঙিয়ে যাওয়ার। মহিউদ্দিনের ভাষায়, ‘এক ডিঙালে দুইয়ের নাগাল, দুই ডিঙালে তিন/ গুনতে গুনতে কুল পাইবা না/ ডিঙাও যত দিন।’

সহজ অথচ গভীর, অনুচ্চ কিন্তু জোরালো উচ্চারণে জগতের সবকিছুর মধ্যে এই দ্বন্দ্বকে চিহ্নিত করেছেন মহিউদ্দিন। এ এক আশ্চর্য দার্শনিক সমাজবীক্ষণ। প্রান্তিক সমাজ এবং এর মানুষগুলোই তাঁর কাব্যের বিষয়। তিনি সংসার বিরাগী মানুষ, কিন্তু জগৎসংসারের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছেন। সবার প্রতি তার তীক্ষ্ণ নজর। এখানকার মানুষকে তিনি ভালোবাসেন, তাদের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-উৎসবের সঙ্গে তিনি জড়িয়ে আছেন। গৃহস্থ তিনি নন, কিন্তু গার্হস্থ্য জীবনের সব রং তাঁর গানের চরণে চরণে। তাঁকে আমরা দেখি গৃহস্থের আঙিনায়, বিচরণ করতে:

‘ও বাড়ির উঠান ঘাটায়

ঝলির ঘেরা খুব

পাশ কাটিয়া আইতে যাইতে

ও আমার মন চোরা অসুখ হইল

প্রেম চোরা অসুখ।’

কাব্যের বিষয় যখন হয়ে ওঠে মানুষ, একটা জনপদ, তার সংস্কৃতি, সেখানকার মানুষের উৎসব আচরণ, তখন সেই সমাজের সঙ্গে মিশে যেতে হয় কবিকে। নইলে সমাজ তার প্রকৃত রূপ নিয়ে ধরা পড়ে না কবির শব্দজালে। মহিউদ্দিনের বিষয় বঙ্গোপসাগর, কর্ণফুলীর দুপাড়ের বিস্তীর্ণ জনপদ। তিনি সেই জনপদের মাটির সন্তান। তিনি এর শিরা-উপশিরা আর হৃৎস্পন্দনকে ধরতে পারেন, চিহ্নিত করতে পারেন এবং তা সহজাত কাব্যপ্রতিভায় সুরের মায়া দিয়ে তুলে আনতে পারেন। আর সেই তুলে আনার ভাষাটি অকৃত্রিম আর আন্তরিক। জটিল উপমা, উৎপ্রেক্ষা, উপমান-উপমিতের দ্বন্দ্বহীন এক সাবলীল সরাসরি উচ্চারণ, কিন্তু তা কখনো শিল্পকে ক্ষুণ্ন করে না। সুরকে লাইনচ্যুত করে না। ছন্দকে পতিত করে না। সহজ লোককবির এটাই প্রধান বৈশিষ্ট্য। যা দেখেন, ভাবেন, বোঝেন তাই তিনি অতি চেনা পরিচিত ঘরোয়া শব্দবন্ধে বিবৃত করেন। আর তাতে সুর মিশিয়ে দেন। লোকের মুখে যা প্রতিদিন উচ্চারিত হয়, লোকের অন্তরে যে বেদনা লুকিয়ে আছে, যে উল্লাস মানুষকে হাসায়, সেটিই তাঁর উপজীব্য বিষয়। এ জন্যই তাঁর রচনা লোকসাহিত্যের মর্যাদা পেয়ে যায়।

শুরুতে বলেছিলাম, মহিউদ্দিন নিয়তই সবকিছুতে এক নিরবচ্ছিন্ন দ্বন্দ্ব আবিষ্কার করেন। প্রকৃতিতে, সমাজ-রাষ্ট্রে, মানুষে মানুষে, শ্রেণিতে শ্রেণিতে যে অবিরাম দ্বন্দ্ব তার অনুপুঙ্খ বিবরণ আমরা দেখি। আমরা যারা সমাজের অংশ, সমাজের কোনো শ্রেণির একটি অংশ, পরিবারের সদস্য, আমরা যারা এর ভেতর লীন হয়ে আছি, তারা বুঝি না, অথবা পরখ করতে পারি না ওখানে দ্বন্দ্বটা কোথায়।

কিন্তু মহিউদ্দিন জগতের চিরসময়ের দ্বন্দ্বকে ধরতে পেরেছেন। তিনি সচেতনভাবেই শ্রেণি আর ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ। এক আশ্চর্য নিরপেক্ষ এবং নির্লিপ্ত অবস্থানে থাকার অসাধারণ যোগ্যতা আছে বলেই সমাজের দ্বান্দ্বিক বাস্তবতাকে প্রতিমুহূর্তে পর্যবেক্ষণ করেন তিনি। সাধারণ চোখে আমরা যা দেখি, যা ভাবি, তার উল্টো দিকে এক বিপরীত অবস্থান থেকে দেখে তিনি সত্যটাকে তুলে আনেন। ওখানেই প্রকাশিত হয় আসল দ্বন্দ্বটি।

বিশেষ করে শ্রেণিবিভক্ত সমাজের নির্মম দ্বান্দ্বিক যে চিত্র তাঁর গানে পাওয়া যায়, তা এখানকার অন্য কোনো আঞ্চলিক গানে পাওয়া যায় না।

‘মেজ্জান দিয়ি মেজ্জান দিয়ি ঐতারথ

গরিবুল্লাই মাইট্টা বচি, ডর মাইনসুল্লাই বাসনত

কী সুন্দইরগ্য বিছানত।

কেউরে হাবার ঢালিডুলি আর পারনি পুছর লইলু

...

হামগরনি প্লেট মাজনি মিন্নত গরি মইরল

হাইবার অত্তত তার পাতত আড্ডিউড্ডি ফইরল।’

এই গানে চট্টগ্রামের ঐতিহ্য মেজবানের এক অসাধারণ ছবি পাওয়া যায়। পাশাপাশি এখানে সমাজের উঁচু-নীচুর ব্যবধানটাও ধরা পড়ে। গানের কথায় পাওয়া যায়, মেজবানের কেউ কেউ খুব কদর পায়, আর কেউ অবহেলায় খেয়ে যায়। গরিবদের জন্য মাটির সানকি, আর বড় লোকদের জন্য চিনামাটির বাসন। এ গানের একেবারে শেষের লাইনে আছে, মেজবানে হাজার হাজার মানুষকে সারা দিন ধরে যারা খাওয়াল, যারা কষ্ট করল, তাদের খাবারের সময় একটা হাড়ও মেলে না।

প্রান্তিক মানুষ, নিরন্ন, দলিত মানুষেরাই তাঁর গানের চরিত্র:

‘আসকার ডির পুক পারে আঁর ভাঙাচোরা ঘর,

হলইদ মরিচ ম-মসলা বাডি হোটেলর

পাডা-উথার ঘডর ঘডর সই গেইয়ি আর মন,

অভাগির লডরফডর বই যাইরগুই জীবন,

হাতর তাউল্যাত হলদ্দ্য রং ন গরে লড়চড়।

আছিল আর ঘরর মানুষ আছি বেয়াগগিন

মদি (মেহেদী) বাডি হাতত দিতাম ফাইপরবরদিন

সেই সুখ বাঁধি ন হাঁদি আর দুখ বান্ধি আর হোয়ালত।’

এই গানটি এক শ্রমজীবী নারীর জীবনকে নিয়ে, যিনি মসলা বাটেন। এ রকম একজন মানুষকে নিয়ে কোনো রচনা বাংলা সাহিত্যেও আমার চোখে পড়েনি। মশলা বাটার শিল-পাথরের ঘষাঘষির মধ্যে নিষ্পেষিত একটা জীবনের অনুপুঙ্খ বর্ণনা আমাদের হৃদয়কে আর্দ্র করে দেয়।