আমরা একটু থামি, থেমে ভাবি...

এই করোনাকালে অস্থির এক লাগামহীনতা যেন চারপাশে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিদিনই হাজির হচ্ছে নতুন বিষয়। আর সেই বিষয়গুলোকে কেন্দ্র করে মেতে উঠছি আমরা। কিন্তু করোনাকাল তো নিজেকে উপলব্ধি করারও সময়। আমরা কি একটু থামব না?

আমরা একটু থামি, থেমে ভাবি। এমনিতেই প্রযুক্তির লাগামহীন অবশ্যম্ভাবী প্রতাপ আর প্রতিদিনের খারাপ খবরের আগ্রাসনে ধরাশায়ী হওয়ার জোগাড়, তার মধ্যে যদি সামাজিক গণমাধ্যমের মন্তব্যের ঘরে অসহনশীল ও দায়িত্বহীন শব্দচয়ন বারবার চোখে পড়ে, তখন মনে হয়, আমরা দিশেহারা হয়ে গেলাম কি?

সহমর্মিতা, যুক্তিবোধ, জীবনবোধ-শিল্পবোধ, নৈতিকতা জনপদভেদে ভিন্ন হলেও এগুলো তো মানুষের দ্বারাই অর্জিত সভ্য গুণ বা জ্ঞান। সেটাই যদি ভুলে যাই, তাহলে তো মানবতা নামক মূল ধর্মটাই হারিয়ে গেল, আর হেরে গেলাম আমরা। পরিপ্রেক্ষিত-ভাবনা, ব্যক্তিক ও সামষ্টিক মূল্যবোধ মানুষের এক দিনে তৈরি হয়নি। তাই হঠাৎ কোনো দুর্যোগে সৃষ্ট অসহমর্মিতায় মানুষ তাকে হারিয়েও হয়তো ফেলবে না। তবু শঙ্কা হয়। মনে হয়, আমাদের থামতে হবে, থেমে ভাবতে হবে। যুদ্ধে তো কৌশল থাকেই। আমাদের বোধ হয় খেয়াল করা দরকার যে এবারের যুদ্ধটা শুধু অণুজীবের বিরুদ্ধে নয়। অণুজীব পরিপ্রেক্ষিত এনেছে কেবল, যুদ্ধটা আমাদের সঙ্গে আমাদের কিংবা সময়ের।

কথাগুলো লিখতে লিখতে অনেক কথাই মনে পড়ে যায়। হয়তো এই সময়টা ‘অনেক সময় হাতে’ বলে অনেক কথা মনে পড়বার অবকাশও পায়।

এ মুহূর্তে আমার শিক্ষক সেলিম আল দীনের একটা কথা খুব মনে পড়ছে। তখন তিনি ‘ধাবমান’ নাটকটি হাতে লেখা শেষ করেছেন মাত্র। প্রায় তিন ঘণ্টা নিজে পাঠ করে একা আমাকে শোনানোর পর জিজ্ঞেস করলেন, ‘বুঝতে পারলি?’ এমনিতেই আমি সাহিত্যের খুব বুঝদার পাঠক নই। পড়ি, পড়তে ভালো লাগে, অনেকগুলো অনুভব এসে হয়তো কিছু অভিজ্ঞতা দেয়, ভালো লাগে। সাহিত্যের পাঠক হিসেবে আমি এই পর্যন্তই। তাই স্যারকে বললাম, বুঝিনি, কিন্তু ভালো লেগেছে। যখনকার কথা বলছি, তখন আমি জাপানে পিএইচডি করছিলাম, ফিল্ডওয়ার্কে এসেছিলাম বাংলাদেশে। স্যার বললেন, ‘চিত্রকল্পটা ভেবে দেখ। একটা মহিষ ছুটে চলেছে, ওকে থামানো যাচ্ছে না, লাগামহীন, আমাদের সভ্যতার মতো।’ স্যারের ওই কথাটা এই সময়ে এসে বেশ কয়েকবার মনে পড়ল। বেকেটের এস্ট্রাগন-ভ্লাদিমিরকে হাড়ে হাড়ে বুঝে নিয়েছি এই থমকে থাকা সময়েই। গডোর জন্য প্রতীক্ষা তো আমরা করছিই, যে যার জায়গা থেকে। আবার জীবনানন্দের সঙ্গে বসবাস হলো তাঁর কবিতার গানময়তাকে আবিষ্কার করতে গিয়ে:

আবার বছর কুড়ি পরে, তার সাথে দেখা হয় যদি।

আবার বছর কুড়ি পরে—

হয়তো ধানের ছড়ার পাশে—

কার্তিকের মাসে

তখন সন্ধ্যার কাক ঘরে ফেরে—তখন হলুদ নদী

নরম নরম হয় শর কাশ হোগলায়—মাঠের ভিতরে।

সত্যি কথা বলতে এই ‘সময়’ ব্যাপারটা অদ্ভুত একটি ধারণা। বিজ্ঞানীদের কাছে যে রকম, হয়তো কবিদের কাছে অন্য রকম। বস্তুবাদী পার্থিব মানুষ কিংবা অবস্তুবাদী আমার আত্মীয়টি যে অতশত বোঝে না; সংসার-সন্তান-ইহকাল-পরকাল আর সাদা-কালো ‘উচিত-অনুচিত’ দিয়ে চলে, তার কাছে আবার আরেক রকম।

এমনিতেই প্রযুক্তির লাগামহীন অবশ্যম্ভাবী প্রতাপ আর প্রতিদিনের খারাপ খবরের আগ্রাসনে ধরাশায়ী হওয়ার জোগাড়, তার মধ্যে যদি সামাজিক গণমাধ্যমের মন্তব্যের ঘরে অসহনশীল ও দায়িত্বহীন শব্দচয়ন বারবার চোখে পড়ে, তখন মনে হয়, আমরা দিশেহারা হয়ে গেলাম কি?

আমরা মনে হয়, এবার অগাধ সময় পেলাম সময়টাকে দেখবার। দেখবার চশমাগুলোকেও দেখা হলো। আমাদের একজন সর্বজনমান্য শিক্ষক বলেছিলেন, ‘শিক্ষা’ হলো সেই চশমা। একেক বিষয়ে স্নাতক একেক চশমা দিয়ে জীবন ও পৃথিবীকে দেখে। তাই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সর্বোচ্চ পীঠ বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থীই কমবেশি জীবনটাকে দেখবে ও উপলব্ধি করবে, অন্তত জাতির তো এইটুকু চাওয়া থাকেই ‘শিক্ষিতজনের’ কাছে। কিন্তু যাদের প্রাতিষ্ঠানিকতা নেই? তথাকথিত ‘অশিক্ষিত’ কৃষক-মজুর-শ্রমিক কিংবা বাউল বা লোককবিগণ, তাঁরাও তো দেখেন। আসলে দেখার জন্য এই চশমাটা বোধ করি মূল্যবোধ, যা মানুষ তার পরিবার ও পারিপার্শ্বিকতা থেকে পায়। পরিবার-স্বজন-বন্ধুবান্ধব কিংবা আজকের ভাষায় ‘ফ্রেন্ড সার্কেল’ ব্যক্তিকে একটি মূল্যবোধ দেয়, যার অন্তঃস্রোতে নৈতিকতা ও সৌন্দর্যবোধ বহমান। এদের অস্তিত্ব টের পাওয়া যায় সেই ব্যক্তির ক্রিয়া-অভিক্রিয়ায়, অন্দরে ও বাহিরে। স্কুলজীবনে, মনে পড়ে আমাদের সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক পাঠ্যপুস্তকের অধ্যায়ের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কহীন কেবল এই ‘মূল্যবোধ’ ধারণাটি নিয়ে ১০-১১টি ক্লাস নিয়েছিলেন। তাঁর কথাও মনে পড়ে। যদিও এখন জানি, এই ধারণাও ভূগোল-নৃতত্ত্বনিরপেক্ষ নয়। কিন্তু তারপরও বুঝে নিতে পারি, এই আপেক্ষিকতার বাস্তবতাকে মেনে নিয়েও ‘মানুষ’ নামে এক সর্বজনীন সাইকো-ফিজিক্যাল অস্তিত্ব আছে। এই অস্তিত্বের একটি মৌল ধর্ম আছে, যাকে ‘মানবতা’ বললে কেউ আপত্তি করবেন না। সেই জায়গা থেকে যদি সময়টাকে দেখি, তাহলে কী দেখি? একটু ‘থেমে’ দেখলে আমরা দেখি: প্রতিদিন আমরা কেবলই যুক্ত হচ্ছি কম্পনজাত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে একটি দ্বিমাত্রিক মায়ার স্ক্রিনে অথচ বিযুক্ত হচ্ছি মানবিক রসায়নের অভিজ্ঞতা থেকে। তথ্যের চাকচিক্য থেকে আমবা বইয়ের অভিজ্ঞতাকে স্মৃতিচারণায় পরিণত করেছি অথচ তথ্য যে কেবলই জ্ঞান পর্যন্ত পৌঁছানোর বাহকমাত্র, সেটা ভোলাতেই যেন সময়ের এত আয়োজন। মোদ্দা কথা হলো এই যে আমরা প্রযুক্তিগত যুক্ততার মায়ায় হয়তো সত্যিকার মানবিক যোগাযোগকে ভুলতে বসেছি। অজুহাত হিসেবে রয়েছে অতিমারি। পাশের মানুষটির অভিব্যক্তির সূক্ষ্মতা দেখা-বোঝা, যেখানেই আসলে সত্যিকার মানবিকতার বসবাস, সেটার কোনো প্রয়োজনই যেন নেই। তাই পাশের মানুষটির সঙ্গে বসবাসের অভিজ্ঞতার চেয়ে তার সঙ্গে ‘প্রয়োজনীয় যোগাযোগ’-এর প্রতি মনোযোগ কেবলই বাড়ছে। তাই একটু হাসি, একটু সম্ভাষণ, একটু অভিমান, একটু সহানুভূতির অভিব্যক্তি আমাদের কাছে ‘অপ্রয়োজনীয়’ বলে ঠেকছে; আর খুব গোপনে সহমর্মিতা নামক মানবিক মূলবোধটি দম বন্ধ হয়ে মরে যাচ্ছে অন্ধকারে।

অন্তত সামাজিক গণমাধ্যমে মন্তব্যের ঘরে কোনো কোনো শব্দচয়নের প্রাচুর্য দেখে এ রকম অনুভূতি সত্যিই হয়।

আবার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নামক গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি অনুধাবনও একধরনের সংস্কৃতিচর্চা। কেন জানি মনে হয়, দুই ছটাক সংগীত, তিন ছটাক নৃত্য, একটু আবৃত্তি, খানিকটা উপন্যাস-কবিতা পড়ে দেখা, নাটক দেখার জন্য একটু সময় বের করাকেই বোধ হয় আমরা সংস্কৃতিচর্চা বলে ভুল করছি। কোনো একজন মানুষ, তিনি যেমনই হোন, তিনি একজন মানুষ। এলিয়েনর রুজভেল্টের ‘নো ওয়ান ইন দ্য ওয়াল্ড ইজ এন্টায়ারলি ব্যাড অর এন্টায়ারলি গুড...’—কথাটা স্মরণে রেখে যদি ভাবি, তাহলে কোনো মানুষের শুভে অন্য মানুষের শুভ আর অশুভে ওই মানুষগুলোর সহানুভূতি—এটাই তো হওয়ার কথা। একইভাবে যে মানুষটি আপাতভাবে আমার বন্ধু নন, তাঁর মৃত্যুতেও আমার প্রতিক্রিয়া প্রথমত মানুষ হিসেবেই হওয়া প্রয়োজন। ধনাত্মক বা ঋণাত্মক যেকোনো অভিব্যক্তি প্রকাশের ভাষা সম্পর্কেও আমাদের সচেতন থাকাই সংস্কৃত হওয়া।

আমাদের বোধ হয় খেয়াল করা দরকার যে এবারের যুদ্ধটা শুধু অণুজীবের বিরুদ্ধে নয়। অণুজীব পরিপ্রেক্ষিত এনেছে কেবল, যুদ্ধটা আমাদের সঙ্গে আমাদের কিংবা সময়ের।

কোনো একজন মানুষ সামাজিক মাধ্যমে ব্যক্তিক অনুভূতি বা মতামত তাঁর যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের আলোকেই প্রকাশ করেন। সেই প্রকাশভঙ্গিতেও দায়িত্বের প্রয়োজন আছে। কেননা, তথ্যপ্রযুক্তির প্রশ্রয়ে তা মুহূর্তেই সারা পৃথিবীর মানুষের মগ্নতায় কিছু কিছু ক্রিয়া করে। আবার প্রকাশিত মতামতের বিষয়ে আমাদের প্রতিক্রিয়ার অভিব্যক্তিতেও দায়িত্বের দায় বর্তায়। কারণ, আমরা নিজেদের মানুষ বলি যারা সভ্যতার জন্ম দিয়ে বিবর্তনের নানা পর্যায়ে তা থেকেই জ্ঞান, নৈতিকতা, ব্যক্তিকতা, নৈর্ব্যক্তিকতা ইত্যাদি নানা ফসল নিয়ে সমৃদ্ধ হয়েছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা মানে অসহনশীল, অসুন্দর ও দায়িত্বহীন শব্দপ্রয়োগের মাধ্যমে মানুষের হাজার বছরের অর্জিত মানবিক ধর্মকে অসম্মান জানানো নয়। এটা হলে আমরা হেরে যাই, মানুষ হেরে যায়। বাক্‌স্বাধীনতার চর্চাও যেমন গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি, তেমনি অপরের অস্তিত্ব ও চৈতন্যকে অনুধাবন করে সহনশীল-সহমর্মী হয়ে পাশাপাশি অবস্থানও সভ্যতারই পরিচায়ক।

এত কিছুর পরও কেবল মনে হয়, প্রতিদিনই মনে হয়, আমরা একটা যুদ্ধাবস্থা পার করছি। কোনো একটি অণুজীব এই যুদ্ধের প্রেক্ষাপট বা পটভূমি। এই পটভূমিতে দাঁড়িয়ে প্রতিদিনের জীবনপরিক্রমা আমাদের নতুন নতুন অনেক দৃষ্টিভঙ্গি ও উপলব্ধির শিক্ষা দিয়ে চলেছে। তাই যদি হয়, তাহলে এই সময়কেও আমরা ‘বন্ধ্যা সময়’ বলে অভিহিত করতে পারি না। বরং সে শিক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে অনেক পরিপ্রেক্ষিত আর অনেক দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে মানুষকে ফেলে দিয়ে যাচাই করে নিচ্ছে আমাদের। তবে কি সময় আমাদের পরীক্ষক? কী পরীক্ষা করে সে? যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধ-সম্পর্ককে, নাকি সময় দূর থেকে দাঁড়িয়ে হাসছে আর বলছে, ‘হে মানুষ, কেমন দেখছ আমাকে? কেমন দেখছ নিজেকে?’

আমি শুধু বলতে চাই, আমরা একটু থামি, থেমে তারপর একটু ভাবি।

 


অন্য আলোয় লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]