মৃত্যু এসে মুছে দেয় নাম

একদিন বার্তাকক্ষগুলো মুছে যাবে
আমরা উপসর্গ দেখে বুঝে নেব
কে কোথায় কেমন আছে
ফুলগুলো ফোটার আগেই
ঝরে যাবে প্রাণের সুবাস
নদীর কণ্ঠে ভেসে যাবে
মেঘের গর্জন
মাঠে মাঠে ফসল কাটার গানে
মুখরিত হবে নক্ষত্রের রাত
সারি সারি কবরের দৃশ্য দেখে বুঝে নেব
চেনা পৃথিবীর ঘাটে ঘাটে
প্রভাতেই সন্ধ্যা নেমেছে
নিবিড় পরিচর্যা শেষে ফিরেছে আকাশ।
শূন্য গ্যালারিতে বসে
গোল...গোল...গোল বলে চিৎকার করি
কোনো একদিন ঈশ্বরের হাত এসে
দিয়ে যাবে গোল—এ আশায়
চক্ষুষ্মান কালও অন্ধ হলো!

বিদায়ের সুর বাজে শূন্যতা সুদূরে...
দাঙ্গার পাঁচটি গল্পে
শান্তির বারতা বুনে যান
ক্ষুরধার বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর।

১৯৫৩–এর ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ সংকলনের
উৎসর্গ পাতা থেকে
পবিত্র হস্তাক্ষরগুলো চোখ মেলে—
গানস্যালুটের পর
পতাকায় আচ্ছাদিত পিতৃরূপ আনিসুজ্জামান
আমার সোনার বাংলায় মিশে যান;
ও আনন্দ,
মঙ্গলালোকে জানাই বিদায়
যে মাটিতে ঘুমিয়ে আছেন
শহীদ বরকত
সে মাটিতেই যেন বারবার জাগি।

‘নক্সীকাঁথার মাঠ’ থেকে স্বাধীন বাংলা
বেতার কেন্দ্র
শিল্পের শিখায় আর কল্লোলিত কণ্ঠে
ডাক দিয়ে যান
মুক্তিযোদ্ধা কামাল লোহানী
নিভৃত পাড়াগাঁ খান সনতলায় ফিরেছি প্রেমিক
প্রিয়তমা,
তুমিই আমার সম্প্রীতির বাংলাদেশ!

প্রিয় ভাই ডাক্তার মির্জা নাজিমউদ্দীন
কত রাত ভোর হলো আইসিইউর ভেতর
যে হাসপাতাল ছিল তোমার প্রার্থনাগৃহ
সেখানে নিথর এই নশ্বর শরীর;
মানুষের জন্য নিবেদিত আরও কত প্রাণ
মিশে যায় মৃত্যুর মিছিলে...

শেষ বিদায় বেলায়
কেউ কি এল, এল নাকি?
চিরচেনা পথ রেখে
সবুজ শস্যের মাঠে
বন্ধুর নিষ্প্রাণ দেহ কাঁধে নিয়ে
মায়াবী আলোয় মিশে যাচ্ছে
শৈশবের স্মৃতিময় দিন!

কত নাম মুছে যায় সংখ্যার গভীরে
অশ্রুসিক্ত চোখ নিয়ে জেগে থাকে দেশ
জেগে থাকে মানবতার অভিন্ন জননী
প্রিয় ভাই, প্রিয় বোন
ডাক্তার, নার্স, সাংবাদিক, পুলিশ, ব্যাংকারসহ
যাঁরা আজ সম্মুখসমরে—
এ যেন আরেক একাত্তর
এতকাল পর ফিরে এলে
‘মুক্তির মন্দির সোপান তলে’...

মৃত্যু এসে মুছে দেয় নাম
অগণন সংখ্যারা ভাসে
মৃত্যুর মিছিল নিয়ে
স্ক্রলগুলো ছুটে চলে রুদ্ধশ্বাসে...
ওয়াল স্ট্রিট, নাসডাক কিংবা ডিএসসির
সূচক দেখে
একদা প্রশান্ত হতো মন
একেকটি দেশের নামাঙ্কিত সংখ্যাগুলো আজ
রেসের ঘোড়ার মতো ছুটে চলে স্ক্রলে...স্ক্রলে...
শূন্য উপাসনাগৃহে প্রার্থনায় বসে
কেউ কি খোঁজে সেই আয়নামহল
খাঁচার ভিতর অচিন পাখি?
অগণন সংখ্যার গভীরে দেখি পিতার মুখ
স্নেহের পরশমাখা মায়ের হাত
ভাইয়ের আলিঙ্গন, বোনের মমতা
বন্ধুদের ভালোবাসা মুছে গেলে
সংখ্যার ভেতর কেবলই মানুষ খুঁজি
মানুষের ভেতর খুঁজি
কত আগে থেকে শুরু হয়েছিল
সামাজিক দূরত্বের বিষণ্ন বিস্তার!

যে পিতা ওল্ড হোমসে
এইমাত্র চোখ বুজলেন
কত দিন তিনি প্রিয় সন্তানের মুখ দেখেননি
যখন ঘুমের ভেতর বৃষ্টি নামে
আকাশ থেকে নেমে আসে
ঝাঁকে ঝাঁকে বোমারু বিমান
গুলির শব্দের সাথে মিশে যায়
আজানের ধ্বনি, গির্জার ঘণ্টা
সিরিয়ার রণাঙ্গনে মৃত্যু থামে না
লিবিয়ার ভাগ্যবিড়ম্বিত অভিবাসী ভাই
মিনেসোটার শ্বাসরুদ্ধ জর্জ ফ্লয়েড
পৃথিবীর দেশে দেশে জেগে ওঠে!
হিমাচলের পর্বতশৃঙ্গে
একটুকরো জমির জন্যে যুদ্ধ করি
এখনো কি প্রস্তরযুগের মানুষেরা
মাস্কের আড়ালে ঠাঁই খোঁজে আমার শরীরে!
‘আমি একদিন না দেখিলাম তারে।
বাড়ির কাছে আরশিনগর
সেথা এক পড়শি বসত করে।’