হুমায়ূন আহমেদের অজানা পাঁচ

হুমায়ূন আহমেদ যখন অন্য রূপে, ১৯৯৬। ছবি: লেখকের সৌজন্যে
হুমায়ূন আহমেদ যখন অন্য রূপে, ১৯৯৬। ছবি: লেখকের সৌজন্যে

নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে আমার পরিচয় এক উজ্জ্বল সকালে। তখন আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি আর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। সে সময় সবে আমি আমার প্রথম উপন্যাসটি লিখেছি, কিন্তু কোনোভাবেই সেটি প্রকাশ করতে পারছি না। অগত্যা এক সকালে হুমায়ূন আহমেদের হাতিরপুলের সাততলা বাড়ির সামনে হাজির হই। উদ্দেশ্য, তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং বই প্রকাশের ব্যাপারে তাঁর সাহায্য প্রার্থনা।

সেদিন স্যারের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। সেই গল্প অন্যত্র বলব। এখানে শুধু এটুকু বলে রাখি, সে সময় মাস্টার্সপড়ুয়া আমাকে স্যার বই প্রকাশের ব্যাপারে সাহায্য করেছিলেন। কেবল সাহায্য করেছিলেন বললে ভুল হবে। বলা যায়, তাঁর আগ্রহেই বেরিয়েছিল আমার প্রথম উপন্যাস। শুধু তা-ই নয়, আমার বইয়ের প্রথম পাঠক ও ক্রেতাও তিনি, ৫০০ টাকা দিয়ে তিনি আমার বই কিনেছিলেন।

পরে মাস্টার্স পরীক্ষা শেষে স্যারকে বললাম, আপনার সঙ্গে কাজ করতে চাই।

তিনি বললেন, কাজ করবে? কাজের কী জানো?

কিছুই জানি না।

তাহলে থাকো আমার সঙ্গে।

স্যারের সহকারী হিসেবে নুহাশ চলচ্চিত্রে কাজ শুরু করলাম আমি। এরপর হুমায়ূন আহমেদের সাহচর্যে কেটে গেছে অনেক বছর।

পরিচয়ের প্রথম দিনেই আমাকে কিছু উপদেশ দিয়েছিলেন তিনি: নিজের সব কাজকেই বাণিজ্যিক মূল্যসম্পন্ন করার চেষ্টা করবে। সৎপথে ধনী হওয়ার চেষ্টা করবে। শিল্প-সাহিত্য গরিব লোকের কাজ নয়। শিল্পসাহিত্য তারাই করবে, যারা ধনের দিক দিয়ে এবং মনের দিক দিয়ে বাদশাহ।

হুমায়ূন আহমেদ রাজা-বাদশাহ স্বভাবরে মানুষ ছিলেন। তিনি নিজেই তাঁর সম্পর্কে বিস্তর লিখে গেছেন। অন্যরাও হুমায়ূন সম্পর্কে লিখেছেন। আমি স্যারের সান্নিধ্যে থেকে তাঁকে যতটা জেনেছি, তার আলোকে এই মানুষটির কয়েকটি অজানা বিষয় সবার সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই।

১. ভূতে বিশ্বাস করতেন

‘কুহক’ শব্দটি হুমায়ূন আহমেদের খুব প্রিয় ছিল। তিনি বলতেন, আমাদের জীবনটা সত্য নয়। এটা একটা মিস্ট্রি বা কুহক। বলতেন, আমরা শুধু আমাদের চোখের সামনের জগৎ নিয়ে ভাবি, অদেখা আরও কত জগৎ রয়েছে, সে সম্পর্কে ভাবনা নেই। আমাদের দেখা জগতে যেমন প্রাণী আছে, অদেখা জগতেও অদৃশ্য প্রাণী আছে।

তাহলে কি স্যার সেটাই ভূত?

হতে পারে। ভূত থাকলে কি আমাদের কোনো সমস্যা আছে? আমাদের কেন এটাই প্রমাণ করতে হবে, ভূত বলতে কিছু নেই।

‘অদেখা ভুবন’ নামে একটা নাটক তিনি লিখেছিলেন। ওই নাটকের শুটিংয়ের সময় এসব কথা হতো। অভিনেতা সালেহ আহমেদ এ বিষয়ে স্যারকে চেপে ধরতেন। সালেহ ভাই জিনে বিশ্বাস করতেন।

হুমায়ূন স্যার বলতেন, জিন কি কেউ দেখেছে? জিন যদি থাকে তো ভূত থাকলে সমস্যা কী?

এই জগতে যেমন শরীরসর্বস্ব প্রাণী আছে, তেমনি অশরীরী প্রাণীও আছে। শরীরওয়ালা প্রাণীরা দিনের বেলায় কাজ করে, অশরীরী প্রাণীরা রাতের বলায় কাজ করে।

২. বেশি আবেগে কাঁদতেন

হুমায়ূন আহমেদ একা একা কাঁদতেন। আবেগপ্রবণ কোনো লেখা লিখতে গেলে তাঁর চোখ ভিজে উঠত। কোনো মানুষের করুণ পরিণতি স্যারের চোখে জল আনত। নির্জন রাতে তাঁকে একা উদাস বসে থাকতে দেখেছি, চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে।

এক রাতে শীতবস্ত্র বিতরণের জন্য স্যারের সঙ্গে আমরা কয়েকজন ঢাকার ফুটপাতে নামলাম। কিছুদূর গিয়ে স্যার বিরক্তভাবে বললেন, তোমরা যা পারো, দিয়ে এসো, আমি যাই।

স্যার একা একদিকে হাঁটতে শুরু করলেন। তাঁর নিরাপত্তার কথা ভেবে পিছু নিলাম। দেখি তিনি হাঁটছেন আর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। কারণ, এত বেশিসংখ্যক মানুষ শীতে কাঁপছে, সেখানে এই কয়েকটি কম্বল দিয়ে কী হবে, এই বেদনায় তাঁর বুক ফেটে যাচ্ছে।

শুটিংয়ের অবসরে ছেলে নুহাশ হুমায়ূনের সঙ্গে, ১৯৯৬
শুটিংয়ের অবসরে ছেলে নুহাশ হুমায়ূনের সঙ্গে, ১৯৯৬

৩. পরশ্রীকাতরতা ছিল না চরিত্রে

হুমায়ূন আহমেদ কারও প্রতি ক্ষোভ বা বিদ্বেষ প্রকাশ করতেন না। কেউ তাঁর বিরুদ্ধে কুৎসা করলে বা তাঁকে হেয় করে পরশ্রীকাতরতা প্রকাশ করলে তিনি তাকে মধুর শাস্তি দিতেন।

একবার এক বিখ্যাত সাহিত্যিক হুমায়ূন স্যারকে নিয়ে যাচ্ছেতাই কটূক্তি করলেন। এতে অনেকেই স্যারকে ফুঁসলে তুলতে চেষ্টা করল প্রতিবাদ করার জন্য। কিন্তু স্যার কিছুই বললেন না। এর কিছুদিন পর নুহাশ চলচ্চিত্রের এক অনুষ্ঠানে সেই সাহিত্যিককে তিনি অতিথি করলেন। তাঁকে খুব সম্মান করলেন এবং একটি খাম দিলেন। এতে ওই কটূক্তিকারক সাহিত্যিক সবার সামনে হুমায়ূন স্যারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে বক্তৃতা করলেন।

এমন অজস্র ঘটনা আছে। একবার এক ভদ্রলোক নুহাশ চলচ্চিত্রের কিছু টাকা মেরে দিল। আমরা তার বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হলাম। স্যার নিজের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে সেই প্রতারককে দাওয়াত করে কার্ড পাঠালেন। প্রতারক লজ্জায় এল না।

আরেকবার এক অভিনেতা সেটে ঝগড়া বাধিয়ে দিলেন। স্যারের উদ্দেশ্যে বিশ্রী শব্দ ব্যবহার করলেন। বিরক্ত হয়ে স্যার শুটিং বন্ধ করে দিলেন। এর কয়েক দিন পর সেই অভিনেতাকে ডেকে ভালো একটা চরিত্র আর একটা খাম দিলেন স্যার। তারপর থেকে অনেক দিন পর্যন্ত লজ্জায় ওই অভিনেতা স্যারের সামনে আর আগের মতো স্বাভাবিকই হতে পারেননি।

৪. অনেক বিষয়ে ছিলেন স্ববিরোধী 

তিনি নগরে বাস করতেন, কিন্তু পছন্দ করতেন গ্রামীণ জীবন। 

ঘরসংসার পছন্দ করতেন, তবে সংসারী হতে চাইতেন না।

সাধারণ বাড়িঘর তাঁকে স্বস্তি দিত, কিন্তু বাস করতেন বহুতল ভবনে।

অতি সাধারণ জীবনযাপনে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন, তবে অর্থ উপার্জনে ছিলেন মরিয়া।

সহজ করে সরল বাক্যে লিখতে পছন্দ করতেন, কিন্তু নিজের জন্য পছন্দ করতেন উন্নত ক্ল্যাসিক সাহিত্য।

সুখী হতে চেষ্টা করতেন, তবে ভালোবাসতেন দুঃখ পেতে।

হইচই-আড্ডাবাজি ভালোবাসলেও পছন্দ করতেন নির্জনতা।

হিমু চরিত্র পছন্দ করতেন, কিন্তু কেউ হিমুর মতো হোক, এটা তিনি চাইতেন না।

জীবন নিয়ে নানা ধরনের এক্সপেরিমেন্ট পছন্দ করতেন হুমায়ূন স্যার, কিন্তু জীবন নিয়ে তাঁর কোনো আগ্রহ ছিল না।

৫. এবং নুহাশপল্লীর গল্প

নুহাশপল্লীতে শুটিংয়ের সময় হুমায়ূন আহমেদ
নুহাশপল্লীতে শুটিংয়ের সময় হুমায়ূন আহমেদ

নুহাশপল্লীর জন্য বেশ কয়েকটি জায়গা দেখা হলো। তবে হুমায়ূন স্যার পছন্দ করলেন না। বর্তমানে যেখানে নুহাশপল্লী, তাঁকে এই জায়গাটা দেখিয়েছিলেন ডা. এজাজ।

প্রথম যেদিন তাঁর সঙ্গে এই জায়গাটা দেখতে যাই, তখন দুপুর। স্তব্ধ গহিন শালবনের ভেতরে ছোট্ট একটুকরো ফাঁকা জমিন। ঢুকতেই সামনে পড়ে তিনটি লিচুগাছ, আমরা সেই গাছের নিচে দাঁড়ালাম। একটি গাছের গোড়ায় ছোট্ট উইঢিবি। স্যার তার ওপরে বসলেন। বললেন, বাহ্​! এমন জায়গায় মরেও শান্তি, আমি এই জায়গাটাই কিনব।

তারপর জায়গাটা কেনা হলো। শণ-কাঠের বাংলো বানানো হলো। সেই লিচুগাছে দোলনা বেঁধে স্যার দুলতেন।

ধীরে ধীরে এখানে অনেক কিছুই তৈরি হলো। কিন্তু স্যার সব সময় ওই লিচুতলাতেই বসতেন। কোনো কোনো দিন অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরত, তিনি লিচুতলায় দাঁড়িয়ে ভিজতেন। কখনো রাতে ভুবনভাসানো জোছনা নামলে স্যার লিচুতলায় বসে চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। লিচুতলার মায়া তাঁর আর ছাড়া হলো না। সেই লিচুতলাতেই এখন স্যারের সমাধি।

‘জানো, মৃত্যুর আগে পাখিরা মনের ভেতরে সাড়া পায়, তখন তারা দূর বনে চলে যায়। বনের গভীর থেকে গভীরে গিয়ে পাখিরা মৃত্যুকে ডাকে, আসো এইবার আমাকে নাও।’ কথাটি প্রায়ই তিনি বলতেন।

হুমায়ূন আহমেদ, আমার প্রিয় স্যার আজ নেই বটে, তবে না থেকেও তিনি আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি করে আছেন।