যে তুমি হরণ কর

আবুল হাসানের জন্মদিন আজ। কবির জন্মদিনে তাঁকে নিয়ে সেলিম জাহানের স্মৃতিচারণা। এই স্মৃতিতর্পণের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে আবুল হাসানের অন্য এক অবয়ব।

না, তাঁর সঙ্গে আমার সখ্য ছিল না, হওয়ার কথাও নয়। বয়সের তেমন তারতম্য অবশ্য ছিল না। আমার বছর পাঁচেকের বড় তিনি। দুজনেই ছাত্র ছিলাম বরিশাল বিএম কলেজের। দুজনেই ঢাকায় সলিমুল্লাহ হলে থাকতাম। বেশ কিছু বন্ধু ছিল তাঁর, যাঁদের সঙ্গে সখ্য ছিল আমারও। এত সব জিনিস অভিন্ন হলে সখ্যের একটা সম্ভাবনা থেকে যায় বৈকি। কিন্তু তা হয়নি আমাদের দুজনের মধ্যে, কারণ দূরত্ব ছিল মূল জায়গায়, তাঁর আর আমার জগৎ আলাদা। তবু সখ্য না থাকলেও একটা হৃদ্যতা ছিল কবি আবুল হাসান আর আমার মধ্যে।

আজ ৪ আগস্ট হাসান ভাইয়ের জন্মদিন। জন্মেছিলেন ১৯৪৭ সালে। বেঁচে থাকলে তিনি ৭০ পেরিয়ে যেতেন। ভাবা যায়? আমার মনে তাঁর তরুণ অবয়বটিই স্থির হয়ে আছে। আমরা সময়ের রেখা ধরে বয়সী হয়েছি, কিন্তু হাসান ভাই সেই ২৯ বছরের যুবকই রয়ে গেলেন।

কত ছোটখাটো কথা মনে হয়। সলিমুল্লাহ হলে তাঁর কক্ষ থেকে স্নান করার জন্য দীর্ঘ বারান্দা ধরে হেঁটে আমার ৩৩ নম্বর কক্ষের সামনে দিয়ে স্নানাগারে যেতে হতো। প্রায়ই হাসান ভাই তোয়ালে নিতে ভুলে যেতেন। আমার ঘর থেকে তোয়ালে নিয়ে স্নান সেরে তাঁর কোঁকড়া চুল মুছতে মুছতে আমার ঘরে আসতেন। হাত বাড়িয়ে বলতেন, ‘দিন।’ বিনা বাক্যব্যয়ে তুলে দিতাম তাঁর হাতে। না, তেমন কোনো মহার্ঘ বস্তু নয়, স্রেফ কয়েটি নিউজপ্রিন্টের পাতা। ধোবিখানা থেকে আমাদের জামা-প্যান্ট ধুয়ে এসে তার ভাঁজে ভাঁজে দস্তরখানের মতো নিউজপ্রিন্টের পরত পুরে দেওয়া হতো। সেগুলোয় ডট কলম দিয়ে কবিতা লিখতে বেশ মজা পেতেন হাসান ভাই। হয়তো তাঁর অনেক নামীদামি কবিতা আমার কাগজের নামাবলি পরেই জন্মলাভ করেছে, কে জানে?

হাসান ভাইয়ের সঙ্গে বেশির ভাগ সময়েই দেখা হতো আমাদের তীর্থস্থানে, শরীফ মিয়ার ক্যানটিনে। আমাদের হৃদ্যতার ঘনীভবনও সেখানেই। একদিন খাঁ খাঁ গরমের মধ্যে সেথায় গেছি। তৃষ্ণায় বুক ফেটে যাচ্ছে। এক গেলাশ জল চাইলাম রমজান ভাইয়ের কাছে। দেখি এক টেবিলে হাসান ভাই শরীফ মিয়ার সেই বিখ্যাত এক টাকা দামের পুরো প্লেট বিরিয়ানি খাচ্ছেন। কোনার এক টেবিলে শাহনূর খান, সাজ্জাদ কাদির, রফিক নওশাদ এবং আরও কয়েকজন মিলে জোর আড্ডা দিচ্ছেন। আমাকে দেখে হাসান ভাই বললেন, ‘কী, খাবেন না?’ ঠোঁট উল্টে বললাম, ‘পয়সা নেই।’ আমাদের কথাবার্তা শরীফ মিয়ার কানে গেছে। ‘আমনে খামাখাই খালি প্যাঁচাল পাড়েন। পয়সার কতা ক্যাডা জিগাইছে আমনেরে?’ ধমকে উঠলেন শরীফ ভাই, ‘বিরতর্ক (শরীফ মিয়া বিতর্ক বলতে পারতেন না) কইরা কইরা প্যাঁচাল পাড়নের অইভ্যাস হইছে আমনের’...ভারী বিরক্ত তিনি আমার ওপর। ‘এই রমজাইন্না, একডা ফুল পেলেট বিরিয়ানি লামাইয়া দে ছলিম সাবের ছামনে’...আমার নামটাও শরীফ ভাই ঠিকমতো উচ্চারণ করতে পারতেন না। তাকিয়ে দেখি, হাতে জলের গেলাশ তুলতে তুলতে মুচকি মুচকি হাসছেন তিনি। ভাবখানা এমন, ‘বেশ হয়েছে।’ এত বছর বাদেও গোঁফের ফাঁকে হাসান ভাইয়ের সে দুষ্টু হাসিটি এখনো দেখতে পাই।

সেই সঙ্গে এখনো শুনতে পাই ওই কথা কটি, ভালো লাগছে একটু এখন? বহুদূর থেকে কথা কটি যেন ভেসে এসেছিল। আস্তে করে চোখ মেলতেই যেন কুয়াশার ভেতর থেকে আবছা একটা মুখ দেখতে পেয়েছিলাম। ওই একমুহূর্তে তিনটা জিনিস ঠাহর করতে পেরেছিলাম, জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে, একটা ঘোরের মধ্যে আছি এবং ওই মুখটি হাসান ভাইয়ের। কতকাল আগের কথা, প্রায় ৫০ বছর, তবু এখনো মনে আছে স্বচ্ছভাবে।

আমার ঘর থেকে তোয়ালে নিয়ে স্নান সেরে তাঁর কোঁকড়া চুল মুছতে মুছতে আমার ঘরে আসতেন। হাত বাড়িয়ে বলতেন, ‘দিন।’ বিনা বাক্যব্যয়ে তুলে দিতাম তাঁর হাতে। না, তেমন কোনো মহার্ঘ বস্তু নয়, স্রেফ কয়েটি নিউজপ্রিন্টের পাতা। ধোবিখানা থেকে আমাদের জামা-প্যান্ট ধুয়ে এসে তার ভাঁজে ভাঁজে দস্তরখানের মতো নিউজপ্রিন্টের পরত পুরে দেওয়া হতো। সেগুলোয় ডট কলম দিয়ে কবিতা লিখতে বেশ মজা পেতেন হাসান ভাই।

খুব সম্ভবত ১৯৭০ সালের কথা। কোনো এক ঈদে মা-বাবার কাছে যাচ্ছি বরিশালে। সকাল থেকেই গায়ে জ্বর ছিল, কিন্তু মনে হলো কিছু হবে না, সেরে যাবে। বিকেলে সদরঘাটে গিয়ে যা দেখলাম, তাতে মনে হলো, ওই অবস্থায় সুস্থ লোকেরও জ্বর চলে আসবে। চারদিকে শুধু মানুষ আর মানুষ, ঠেলাঠেলি, হাতাহাতি—লঞ্চ, স্টিমারে ওঠার জন্য মরণপণ লড়াই। তার মধ্যেই দেখি হাসান ভাই, আমাকে দেখে এগিয়ে এলেন। বহুদিন পরে তিনি বরিশাল যাচ্ছেন, ছোট বোনটিকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে, লাজুক চোখে জানালেন তিনি। হাসান ভাইয়ের লাজুক চোখ ও রাগী মুখ, দুটোর সঙ্গেই ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল আমার। ততক্ষণে আমার জ্বর চড়চড় করে বেড়ে যাচ্ছে এবং একপর্যায়ে আমি সংজ্ঞা হারালাম।

তারপরই প্রথম যে কথাটি শুনতে পেলাম, তা হচ্ছে ‘ভালো লাগছে একটু এখন?’ পাতলা-দুবলা হৃদ্‌রোগী হাসান ভাই কেমন করে সেই উন্মত্ত জনতার ব্যূহ পেরিয়ে আমাকে স্টিমারে তুলেছিলেন, কেমন করে প্রথম শ্রেণির খাবার ঘরের একটি বেঞ্চিতে শুইয়ে দিয়েছিলে, কেমন করে সারা রাত জেগে থেকে আমার মাথায় জলপট্টি দিয়েছিলেন, তা এখনো আমার কাছে এক রহস্য। শুধু চেতনার কোনো কোনা থেকে নিরন্তর শুনতে পাই, ‘ভালো লাগছে একটু এখন?’ ‘যে তুমি হরণ করো’র কবি আবুল হাসান সে রাতে আমার হৃদয় জয় করেছিলেন, কোনো কিছুই তাঁকে হরণ করতে হয়নি।

তাঁর সঙ্গে শেষ দেখার কথাও মনে আছে আমার। অসুস্থ তিনি তখন। ১৯৭৫ সালের মাঝামাঝির একটু পরের কথা। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছি। উচ্চশিক্ষার্থে আমার তখন কানাডা আসার কথাবার্তা হচ্ছে। কথাবার্তার কোনো এক ফাঁকে হাসান ভাই খুব উদাস চোখে বাইরে তাকালেন জানালার শার্সি গলিয়ে। তারপর খুব নরম গলায় বললেন, ‘ওখানকার তুষার কি পূর্ব জার্মানির মতো?’ আমি একটু হেসে বললাম, ‘আমি তো বলতে পারব না। আমি তো বরফ পড়া দেখিনি।’ অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলেন তিনি। তারপর প্রায় ফিসফিসিয়ে বললেন, ‘শুভ্র তুষার বড় সুন্দর, বড় পবিত্র।’

তারপর কতবার তুষারপাত দেখেছি পৃথিবীর কত জায়গায়। কত ভোরে উঠে বাইরে চেয়ে দেখেছি, বরফে বরফে ছেয়ে গেছে চারদিক। শ্বেতশুভ্র সে বরফ দেখে আমি সেই বরফের মধ্যে হাঁটতে বেরিয়েছি। পায়ের বুটের নিচে বরফ ভাঙার মচমচ শব্দ, কনকনে ঠান্ডা এড়াতে গরম কোটের কলারটা আমি তুলে দিয়েছি, গলার মাফলারটা আরও ভালো করে পেঁচিয়ে নিয়েছি, মাথার টুপিটা নামিয়েছি বেশ কিছুটা। তখনই আমার ঘাড়ের কাছে যেন ফিসফিসানি স্বরে শুনতে পেয়েছি, ‘শুভ্র তুষার বড় সুন্দর, বড় পবিত্র।’

মাঝেমধ্যেই হাসান ভাইয়ের কবিতার লাইন মনে পডে যায়। ‘ঝিনুক নীরবে সহো ঝিনুক নীরবে সহো, ঝিনুক নীরবে সহে যাও, ভিতরে বিষের বালি, মুখ বুজে মুক্তা ফলাও!’ কিংবা ‘আমি আমার আলো হবার স্বীকৃতি চাই, অন্ধকারের স্বীকৃতি চাই’। কিন্তু সবচেয়ে বেশি মনে হয়, ‘যতদূরে যাই, ফের দেখা হবে, কারণ মানুষ মূলত বিরহকামী, কিন্তু তার মিলনই মৌলিক।’

অন্য আলো অনলাইনে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]