আঙুল আঙ্গুর কিংবা শুকনো পাতার বোমা আওয়াজ

তীর্থ যেদিন কাক পোষা শুরু করল, সেদিন থেকেই প্রতিবেশীদের আঙুল চোষার আরম্ভ। তীর্থের খাঁচায় কাকের সংখ্যা যত বাড়ে, প্রতিবেশীদের আঙুল চোষার গতিও তত ছুটতে থাকে। খাঁচার ভেতর চেনা পাখি হিসেবে কাকের দল ক্রা ক্রা করে; আর অচেনা অভ্যাসে আশপাশে চুকচুক করে সবাই যে যার মতো নিজের আঙুল চুষতে থাকে।

পাশের বাড়ির আঙ্গুর খালাম্মা সেদিন মনের ভুলে একটা আঙুল হাত থেকে ছুটিয়ে টপ করে গিলেই ফেললেন। তারপর থপ থপ থপ ভারী পা ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। ঘটনায় শাপেবর হলো তাঁর, লালা মাখা হাতের ৯ আঙুল সামনে মেলে ধরলেই তিনি এমন এক দৃশ্য দেখতে পান, যা আর কারও নজরে আসে না। আঙ্গুর খালা তখন মিটিমিটি হাসেন, তীর্থের খাঁচায় কাকের দল ক্রা ক্রা করে আর বাকিরা সব তাদের নজর খুলে চপ চপ করে আঙুল চোষে।

হঠাৎ সামনে মেলে ধরা নয় আঙুলে কেচ্ছা দেখতে দেখতে আঙ্গুর খালা চিৎকার করে বলতে শুরু করলেন, কলাগাছ কলাগাছ, কলাগাছ। শুনে মহাব্যস্ত হয়ে সবাই ব্যাপকভাবে কলাগাছ রোপণ শুরু করে দেয়। জাতীয়ভাবে, সামগ্রিক আলোচনা ও নানান উদ্যোগে কলাগাছ হয়ে ওঠে সবার প্রিয় বিশেষ বিষয়। আণ্ডা-বাচ্চা থেকে শুরু করে প্রায়মৃত থুত্থুড়ে বুড়ো পর্যন্ত সবাই আকণ্ঠ আগ্রহে সকাল-বিকেল-সন্ধে ‘কলা কলা কলা’ জপ করতে শুরু করল চিৎকার করে। কলার প্রকার ও প্রকৃতি নিয়ে অজস্র গবেষণা, প্রকাশনা ঘুড্ডির মতো ওড়াউড়ি করতে লাগল।

এই কলাযুগের আচ্ছন্ন সময়ে আবারও একদিন আঙ্গুর খালা লালা মাখা ৯ আঙুল মেলে ধরে বলতে শুরু করলেন, কলাপাতা কলাপাতা কলাপাতা...। তখন দেখা গেল সবাই বেশ অবাক হয়ে চোখ গোল গোল করে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে পথেঘাটে যে যেখানে পারে, সমানে কলা পাতা বিছিয়ে বসে থাকতে শুরু করল।

দিন যায় রাত যায়, রাত যায় দিন যায়। আকাশের মেঘগুলো সব গভীর হয়, গম্ভীর হয়। একদিন কাঁচা ভোরে ঝমঝমঝম বৃষ্টি শুরু হলে আঙ্গুর খালার ভাত ভাত ভাত চিৎকার সবার ঘুম ভাঙিয়ে দেন। সবাই দেখবে সেই সব পেতে রাখা কলা পাতায় তাজা ভাত পড়ে আছে। হতবাক সবাই কিছুক্ষণ চুপ থেকে গোগ্রাসে ভাত গিলতে শুরু করে এবং এই অলৌকিক ভাত খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকেই তখন ভাতযুগের সূচনা হয়।

সামনে কলাপাতা পেতে রাখে সবাই। তেল দেয় আঙ্গুর খালাকে, তারপর ভাত পেয়েই গিলে নেয় চোখের পলকে। ভালোই চলছিল সব, সমস্যা হলো এই ভাত থেকেই একসময় জাত বিচার শুরু করার তাগিদ শুরু হয়। হাত চিনতে চিনতে, জাত চিনতে চিনতে এমন এক পরিস্থিতি শুরু হয়, যখন সাতসকালে সবার পেতে রাখা কলাপাতায় ভাত পড়ে থাকে না। যারা পায় তারা গেলে, যারা পায় না তারা দর্শনচর্চা করে বা কবিতা লেখে নিয়মিত। আঙ্গুর খালা গলা ছেড়ে গান ধরেন।

ভাতের পেটে জাতের খাতা
কলাপাতা কলাপাতা,
ক্ষিদার চোটে বাঁশের বাতা
কলাপাতা কলাপাতা !

আশপাশে যারা, তারা গান গায় সবাই। ফাঁকা পাকস্থলীতে সুর নাকি বেশ জমজমাট হয়। বিষয়টা বুঝে মহানন্দে আঙ্গুর খালা আবার গান ধরলেন।

অবহেলার ঠ্যালা নুনে
তৃষ্ণা মিটায় বুঝেশুনে
আসল নকল ধকল নিয়ে
মনের খায়েশ ভাজে ঘিয়ে!

ভুলের গ্লাসে বিষের পানি
আহালাদের টানাটানি
হেসে খেলে আজন্মঘোর
প্রকাশ্য যে চোর!
তোর ত্যাগে ক্যানো জোর
তোর ত্যাগে ক্যানো জোর!

এই গানটা শুনতে শুনতে পৃথিবীজুড়ে তখন কালো পর্দা নেমে আসে। অন্ধকারে হারিয়ে যায় ইতিহাসের সব সাক্ষী মহাসাক্ষী। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের সমীকরণে যে যার মতো বিচ্ছিন্নতার অভ্যাসে মগ্ন হয়ে পড়ে। শুরু হয় মহাবিচ্ছিন্নতার যুগ, হয়তো সে কারণেই চারপাশের নীরবতা অনুভব করা যায়। যখন গাছের শুকনো পাতাটা ঝরে পড়লেও তার আওয়াজ বোমার মতোন প্রচণ্ড প্রকাশ্য হয়!