ব্যথা পুষ্পবাগান হয়ে ফুটে আছে

‘ডার্ক টাইম’, শিল্পী: মাহমুদুর রহমান

হয়তোবা করোনা মহামারির এই সময়কে একটি নামকরণে আনতে চাইলেন শিল্পী। তাই হয়তো প্রদর্শনীর নাম রেখেছেন ‘ডার্ক টাইম’। অন্ধকার সময়। মানুষ ঘরে বন্দী, মেলামেশা আইন করেই বন্ধ, চারদিকে আতঙ্ক, ভয়। মানুষ আতঙ্ক নামের ব্যাধিতে আক্রান্ত। গণমাধ্যমে শুধু মৃত্যুর খবর। এমন নজিরবিহীন অস্থিরতার অভিজ্ঞতার মধ্যে পড়ে গিয়ে যে যাঁর মতো সামাজিক দূরত্বে অবস্থান করছেন। সেই বাস্তবতাকে পুঁজি করে চারকোলে ছবি এঁকেছেন মাহমুদুর রহমান। দীপন নামেই সবার কাছে পরিচিত তিনি—মাহমুদুর রহমান দীপন। নিকটজনদের কাছে তিনি ভালো শিল্পী হিসেবে পরিচিত হলেও গ্যালারি বাজারে তাঁর অনুপস্থিতি ছিল বা আছে। জলরঙে সিদ্ধি আছে তাঁর। অ্যাক্রিলিকে তিনি গুণী শিল্পীদেরও মুগ্ধ করে দেন। মাহমুদুর রহমানের হাতের ড্রয়িংই তাঁর কাজের শক্তির ভিত্তি রচনা করে দেয়। চারকোলে আঁকা তাঁর কাজের প্রদর্শনী নিয়ে আলাপ তোলার আগে এ শিল্পীর আরেকটি কাজের কথা বলি। সেই কাজের নাম ‘ত্রিভু’। তিনটি ছোট্ট শিশু—এটি একটি ভাস্কর্য, বসানো আছে ঢাকা চারুকলা অনুষদের ছোট্ট বৃত্তাকার জলপুকুরের ভেতরে। যেনবা তিনটি দেবশিশু খেলা করছে জলের ওপরে। ভাস্কর্য মাহমুদুর রহমানের একাডেমিক জীবনে ছিল সাবসিডিয়ারি, কিন্তু ‘ত্রিভু’কে দেখে কে বলবে, এই ভাস্কর মূলত একজন চিত্রী। রেখা তাঁর হাতে বাঙ্​ময় হয়, নেচে ওঠে। তো ‘ডার্ক টাইম’কে তিনি ধরেছেন চারকোলে। মাধ্যম হিসেবে চারকোলে কাজ করেন আমাদের দেশের শিল্পীরা, কিন্তু একটি প্রদর্শনীর ৭৩টি কাজ সবই চারকোলে করা, এটি সচরাচর নয়।

পিপাসা নিয়ে মানুষেরা খুঁজে ফেরেন আলোর অপেরা। আলোই তাঁর গন্তব্য। আলো দূরকে দেখতে সাহায্য করে। অন্ধকার তাই কিছুতেই কাম্য নয়। তারপরও অন্ধকার আসে, অসহায় হয়ে পড়েন মানুষ। অন্ধকারের গল্প বলতে বলতে ‘ডার্ক টাইম’-এ মাহমুদুর রহমান চিত্রিত করেছেন চরম এক অস্থিরতার খণ্ড খণ্ড ইমেজ। উদ্বেগ, নিঃসঙ্গতা, মায়াকাতরতা, ভয়; ভয় থেকে পালানোর প্রবৃত্তি, তবে এই পলায়নপরতাও কিন্তু অন্ধকারের দিকে! নিজের ক্ষতবিক্ষত মুখটি শিল্পী আপন মমতা দিয়ে ধরেছেন—সাদা কাগজের ওপর কালো কয়লায় আঁকা মুখটি। সেই মুখ শিল্পীর মুখ। প্রচলিত ছন্দের বাইরে যে দীর্ঘ জীবন মাহমুদুর রহমান যাপন করছেন, সেই নিঃসঙ্গতাও প্রস্ফুটিত হয় তাঁর কাজে। হয়তো নিজের কুঁকড়ে যাওয়া পাঁজর তিনি আঁকেন চারকোলে, কাগজের ওপর। শিল্প যেসব শিল্পীর জীবনকেই ভোগ হিসেবে নিয়ে থাকে, হয়তো এই শিল্পী সেই দলের। ফলে ডার্ক টাইম বা অন্ধকার সময়ের ভেতর দিয়েই তাঁর যাত্রাপথ। তখন করোনা আসেনি, পৃথিবী তখনো ঝলমলেই ছিল, রঙিন ছিল, কিন্তু ‘ডার্ক টাইম’-এর অন্ধকারের সঙ্গে হয়তো তখনই দেখা হয়ে গেছে এই শিল্পীর। অর্থাৎ অনেক দিনের দেখা ও চেনা পরিব্যাপ্ত অন্ধকার তিনি দেখেছেন, এখন সেই ছবি এঁকে আমাদের দেখাচ্ছেন। সমকালীন বাজার–বাণিজ্যের গ্যালারির দেয়ালে এ রকম শিল্পীদের সহজে জায়গা হয় না। কিন্তু মাহমুদুর রহমানের কাজ নিজে শক্তিশালী হওয়ায় তাকে সমীহ না করে যাওয়ার ক্ষমতা কোনো দর্শক বা কলারসিকের থাকে? এইখানেই শিল্পীর জয়, শিল্পেরও জয়; মাহমুদুর রহমানের গতিময় ড্রইং, মায়াবী টোন, আলো–ছায়ার খাঁজ ও ভাঁজ—সব মিলিয়ে ফুটিয়ে তোলা চিত্রের জয়। অদ্ভুত মায়া তৈরি করেন তিনি পটে, দেখে যেতে যেতে তাঁর ছবি পেছন ফিরেও দেখতে হবে—এমন টান সৃষ্টি করে। ভালো শিল্পীর কাজই এমন।

‘ডার্ক টাইম’, শিল্পী: মাহমুদুর রহমান

খ্যাতি ও বাণিজ্যের বাজার থেকে দূরে একধরনের আত্মগোপনে ডুব দিয়ে থাকা মাহমুদুর রহমান প্রায় ২২ বছর পর দ্বিতীয় একক প্রদর্শনী করছেন গ্যালারি কায়াতে। সেখানে গিয়ে দেখলাম, এর মধ্যেই প্রচুর ছবি বিক্রি হয়ে গেছে। এটি একান্তই শিল্পীর কাজের শক্তি। তুচ্ছাতিতুচ্ছকে বিষয় করে তিনি আঁকেন এমন এক শৈলীতে, সেটি তখন সংগ্রহযোগ্য দুর্লভ চিত্র হয়ে ওঠে। অনেক অন্ধকার পাড়ি দিয়ে যখন আলো আসে, আমাদের ভালো লাগে, আমরা স্বস্তি পাই। আনন্দের শিহরণ লাগে। মনে হয়, ব্যথা পুষ্পবাগান হয়ে ফুটে আছে ক্যানভাসে, পাঁজরেও। আর ক্ষত ছড়িয়ে পড়েছে রেখায় ও টোনে। প্রদর্শনীটি চলবে ২৫ মে পর্যন্ত।