ধর্মীয় শুদ্ধতার বাইরেও ‘পবিত্র’ শব্দটি আমাদের মনে অনেক গভীর ভাবনা ও অনুভূতির জন্ম দেয়। সামাজিক অনিশ্চয়তা আর অস্থিরতার এই সময়ের বিপরীতে শিল্পী মলয় বালার একক প্রদর্শনী ‘পবিত্র সৌন্দর্যের সন্ধানে: মলয় বালার ভক্তিমূলক শিল্প’ নামকরণে এক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে। যা আমাদের আবার আদিম প্রকৃতির কাছে নিয়ে যায়, মানসিক শান্তি এনে দেয়।
পৃথিবীতে নানা মত ও অসংখ্য পথ থাকলেও সবার লক্ষ্য এক—ঈশ্বরের বা তাঁর পবিত্র সৌন্দর্যের সন্ধান। সেই সন্ধানে যিনি শিল্প-আলোর মন্দিরে আশ্রয় নিয়ে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে সঁপে দেন, তিনিই প্রকৃত শিল্পী। সম্প্রতি শুরু হওয়া শিল্পী মলয় বালার প্রদর্শনীতে নন্দনতত্ত্ব, প্রাচ্যকলার স্বকীয় সৌন্দর্য ও আধ্যাত্মিকতার এক মেলবন্ধন ঘটেছে, যার সঙ্গে লোকজ সুর ও সংগীতের আবহে মুখর হয় পুরো গ্যালারি। বাংলাদেশের প্রাচ্যশিল্প ধারায় ধারাবাহিকভাবে কাজ করছেন এবং এ বিষয়ে গবেষণায় নিয়োজিত রয়েছেন মলয় বালা।
আমাদের অনেকের মধ্যেই এমন এক সীমাবদ্ধতা রয়েছে—আমরা কোনো ছবি বা শিল্পকর্মের দিকে তাকাই, কিন্তু সত্যিকারে তাকে দেখতে পারি না। তাকানো ও দেখার মধ্যে যে মৌলিক পার্থক্য আছে, তা-ই আসলে শিল্পবোধের সূচনা। একটি ছবি দেখা মানে কেবল চোখে দেখা নয়, বরং একধরনের অভিজ্ঞতা অর্জন—যা চিন্তার উত্তরণ ঘটায়, তা চটজলদি গড়ে ওঠে না। তাই নিয়মিত ছবি দেখার অভ্যাস থাকা জরুরি। সেই দর্শন-চর্চারই প্রতিফলন ঘটে শিল্পী মলয় বালার চিত্রপ্রদর্শনীতে।
তাঁর চিত্রগুলো দর্শককে কখনো নিয়ে যায় ধ্যানমগ্ন বৌদ্ধের নিকটে, কখনো কৃষ্ণ কিংবা দেবী দুর্গার আধ্যাত্মিক উপস্থিতির অনুভবে। শিল্পীর বিশ্বাস, ঈশ্বরের সৃষ্ট প্রতিটি উপাদানই তাঁরই অংশ, আর সেই সৃষ্টির সৌন্দর্যকে বন্দনা করাই ঈশ্বরকে উপলব্ধির একটি উপায়। মলয় বালা তাঁর জীবন ও শিল্পচর্চায় সেই উপলব্ধিরই প্রকাশ ঘটিয়ে চলেছেন। হিন্দু পুরাণ ও উপাখ্যানের বিস্তৃত ভুবনে থাকা সর্বজনীন চরিত্র ও উপাদানগুলোকে তিনি তাঁর জলরঙে নতুনভাবে প্রাণবন্ত করে তুলেছেন।
ধর্মীয় দর্শনের নির্যাসকে ধারণ করে তিনি প্রকৃতি ও মানুষের সৌন্দর্যকে নান্দনিকভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। তাঁর নিজের ভাষায়, তিনি আঁকেন ঈশ্বরের সান্নিধ্য খুঁজে পেতে, ধ্যান করতে ও তাঁর আরও কাছাকাছি যেতে।
বর্তমান প্রদর্শনীতে মোট ৮০টি চিত্রকর্ম রয়েছে, যা চারটি ভাগে বিন্যস্ত—শকুন্তলা পর্ব, যেখানে পৌরাণিক চরিত্র ও শকুন্তলার গল্প উঠে এসেছে; ধর্মীয় পর্ব, যেখানে কৃষ্ণ, বুদ্ধ ও দুর্গার প্রতিচ্ছবি দেখা যায়; প্রকৃতি পর্ব, যেখানে প্রাণী, পাখি ও প্রাকৃতিক দৃশ্যচিত্র আছে; এবং নারী পর্ব, যেখানে নারীর নান্দনিক ও রূপক ফিগারেটিভ রূপ ফুটে উঠেছে। একজন সংবেদনশীল মানুষ হিসেবে শিল্পীর জীবনও সময়ের প্রবাহে নানা বাঁকে মোড় নেয়, ঠিক নদীর মতো।
জলরঙে কাগজ, জল ও রঙের মিশেল এক সূক্ষ্ম খেলায় পরিণত হয়েছে। সেই খেলায় ধীরে ধীরে ফুটে উঠেছে চিত্রকলার ষড়ঙ্গ—অর্থাৎ শিল্পের ছয়টি মৌলিক গুণ। শিল্পীর ভাষায়, ‘রূপভেদ, প্রমাণ, ভাব, লালিত্য, সাদৃশ্য ও বর্ণযোজন—এই ছয় গুণই প্রাচীন শিল্পের ভিত্তি, যা একটি চিত্রকে সম্পূর্ণতা দেয়।’
মলয় বালার কাজে বারবার ওয়াশের ব্যবহার ও একাধিক স্তর তৈরির ফলে ছবির পটভূমিতে সৃষ্টি হয়েছে এক কোমল, আবছা ও নমনীয় আবহ—তা যেন ঈশ্বরের চিরন্তন রহস্যের প্রতীক। প্রদর্শনীতে মূলত প্রাচ্যধারার কাজ থাকলেও কিছু গোয়াশ, টেম্পেরা ও অ্যাক্রিলিক মাধ্যমের চিত্রও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
প্রতিটি ছবিতেই একধরনের মায়াময় আবছায়া ভাসে—আলো ও ছায়ার কোমল মিশেলে যেন গড়ে ওঠে এক স্বপ্নিল জগৎ, সেখানে বৃক্ষের ছায়ায় পাওয়া যায় প্রশান্তির আশ্রয়, আর হৃদয়ে জেগে ওঠে এক অলৌকিক অনুভব।
অনেক জায়গায় গাঢ় রঙের ব্যবহার ও সবুজ-নীল আভা মিশে তৈরি করেছে রহস্যময় এক দ্যোতনা। শিল্পী ঈশ্বরের সন্ধান করতে করতে যেন তাঁরই সৃষ্টিশক্তির একটি ক্ষুদ্র অংশে রূপান্তরিত হয়েছেন। রং ও তুলির জাদুতে তিনি সৃষ্টি করেছেন এক মায়াবী জগৎ—এটাই তাঁর শিল্পসাফল্যের প্রকৃত পরিচয়।
শিল্পকলার ইতিহাসে প্রাচ্যকলার ধারা অন্যান্য ধারার তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম পরিবর্তিত হয়েছে। আধুনিক সময়ে শিল্পচর্চায় বিষয়বস্তু ও উপস্থাপনার ধরনে নানা পরিবর্তন এলেও, এশিয়ার নিজস্ব এই প্রাচ্যকলার ধারা এখনো তার স্বকীয় রূপে অবিচল রয়েছে। বাংলাদেশেও এই ধারায় কাজ করা অনেক গুণী শিল্পী আছেন, তাঁদের মধ্যে মলয় বালা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
বর্তমান সময়ে শিল্পীর এই প্রয়াস মূলত অনুসন্ধানমূলক। আধ্যাত্মিকতাকে প্রাচীনভাবে একই ধরনের এই প্রকাশ আজও কতটা প্রাসঙ্গিক? এই প্রশ্নের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ—পবিত্র সৌন্দর্যের সান্নিধ্যে থাকার গভীর তাৎপর্য ও মাহাত্ম্যকে এই সময়ের মোহগ্রস্ত মানুষের কাছে তুলে ধরা।
মানুষের অশান্ত মনকে হয়তো স্থিরতার দুয়ারে পৌঁছে দেবে প্রদর্শনীটি। শিল্পীর এই তৃতীয় একক প্রদর্শনী ফ্রাসেঁস দ্য ঢাকার লা গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। চলবে (রবিবার ছাড়া) ২৯ অক্টোবর পর্যন্ত।