স্তিমিত আলো। দৃশ্যবস্তু তাতে অক্ষিপটে সাড়া জাগাতে সময় নেয়। প্রদর্শনকক্ষের কেন্দ্রে একটি হাড়পাঁজরা বের করা অতিকায় নৌকা। শূন্যে ভাসমান। পাটাতন নেই। নৌকার ঠিক নিচে, মেঝেতে, একই রেখায় হরফের প্রবাহ—যেন নদী। স্থাপনাশিল্পে এই নদী হাজির হয়েছে ওয়াকিলুর রহমানের পুরোনো চিত্রকর্ম থেকে। জীর্ণ নৌকাটি ভেসে আছে এই হরফের নদীটির ওপরে। নৌকাটি নিথর ভেসে আছে না পাড়ি দিচ্ছে, সেটি প্রশ্ন বটে।
মেঝেতে, নৌকার সমান্তরালে, চৌকো চৌকো মৃৎফলকে নদীবর্তী আর্দ্র মাটির একফালি প্রতিরূপ। তাতে পদচ্ছাপ, মাটির হাঁড়িকুঁড়ি, জলজ প্রাণের চিহ্ন।
কক্ষে আরও ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে নৌকার কাঠে গড়া টোটেম–সদৃশ কিছু উল্লম্ব কাঠামো। কয়েকটি সারিবদ্ধ বইঠা। নৌকা, অক্ষরমালা আর মৃৎফলকের সারির অনুভূমিকতার সঙ্গে এই কাঠামোগুলো এক বিপরীত টান রক্ষা করছে। নৌকার খোলের উত্তল কাঠ মুখোমুখি গেঁথে নির্মাণ করায় উল্লম্ব দৃশ্যবস্তুগুলোতে তৈরি হয়েছে রহস্যময় গহ্বর। কোনো কোনো কাঠামোয় শামুক বা গুগলির মতো জলজ প্রাণীর আকার। একটি কাঠামোর শীর্ষে তারহীন দোতারা স্থাপন করা।
প্রদর্শনীটি হয়ে ওঠে এই সময়ের বঙ্গভূমির সামনে মেলে ধরা একটি নির্মম দর্পণ।
সব শিল্পবস্তু কালো রঙে রঞ্জিত এবং প্রদর্শনকক্ষের দেয়াল একেবারেই শূন্য। দেয়ালে কোনো শিল্পকর্ম না ঝোলানোয় আলো–আঁধারি কক্ষে চোখ কোথাও আটকে যায় না। এ যেন নদীর অববাহিকার দিকচিহ্নহীন দিগন্তের অবভাস।
এই প্রদর্শনীকে নানাভাবে পাঠ করা সম্ভব—বঙ্গীয় জনজীবনের রূপান্তরের ইতিহাসের দিক থেকে যেমন, বাংলার ভাবের দিক থেকেও তেমনই। ওয়াকিলের দৃষ্টি কোনো গভীরতর সত্যের দিকে।
এর আগেও—১৯৯০–এর দশকের গোড়ায়—ওয়াকিলের একটি চিত্রকর্মে আমরা নৌকা দেখেছিলাম। পাশাপাশি দুটি বর্গাকারে বিচ্ছিন্ন চিত্রতলে বিভাজিত একটি নৌকা। নৌকাটি থেকে দূরে, দিগন্তরেখার ওপরে গাঢ় লালের মধ্যে, চিত্রতলের শীর্ষে পুঞ্জীভূত কালো।
নৌকা বাংলার নানা ভাবের প্রতীক। নদীর অপর পারে গিয়ে বৃহতের সঙ্গে মেলার যে তীব্র আকুতি বাংলার ভাবের মধ্যে আমরা দেখি, নৌকাই তা চরিতার্থ করতে পারে। কিন্তু কূল নাই–কিনার নাই এই নদীর ওপারে যে মেঘের ঘটা। মিলন, তাহলে আর, হবে কত দিনে? হাহাকারময় এই আত্মিক শূন্যতা চিত্রটির মধ্যে পাক খায়।
সেই নৌকা যেন ওয়াকিলের এই প্রদর্শনীর পূর্বলেখ।
ওয়াকিলের কল্পনায় এই জনপদের উত্থান, যাপন ও ভাবকল্পের বিকাশের সঙ্গে নদী ও নৌকার সপ্রাণ যোগ তাৎপর্যপূর্ণ। নদীসিক্ত সমতল বঙ্গীয় ভাবের উর্বরাক্ষেত্র। নদীপাড়ের এঁটেল মাটি জলজ জীবনের সুদীর্ঘকালের স্মৃতি ও বিস্মৃতির ছাপচিত্র। ওয়াকিলের মৃৎফলকে তারই প্রতিফলন।
তবে এত সব আয়োজনের মধ্য দিয়ে ওয়াকিল বলতে চান, এই জনপদের সঙ্গে তাঁর এত দিনের সুগভীর গাঙ্গেয় সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছে, তাঁর ভাবজগতে ভাঙন ধরেছে। তাঁর নৌকা ধ্বস্ত, সেসবের হাড়পাঁজর বেরোনো। তাঁর উল্লম্ব কাঠামোর শীর্ষে স্থাপিত দোতারা নরকঙ্কালের কোটরাগত মুখাবয়বের প্রতিভাস জাগায়। সব মিলিয়ে প্রদর্শনীটি নদীস্নাত বঙ্গীয় জনপদের ভাবসমেত এক মহাশ্মশানে পর্যবসিত হয়। প্রদর্শনীটি হয়ে ওঠে এই সময়ের বঙ্গভূমির সামনে মেলে ধরা একটি নির্মম দর্পণ।
‘মনন–খনন’ শিরোনামে ধানমন্ডির বেঙ্গল শিল্পালয়ে ওয়াকিলুর রহমানের এই দৃশ্যশিল্প প্রদর্শনী চলবে ১৪ সেপ্টেম্বর অব্দি।