শিল্পী সুলতান, পুরো নাম শেখ মোহাম্মদ সুলতান, ডাক নাম লালমিয়া। জন্ম ১৯২৪ সালের ১০ আগস্ট নড়াইলের মাছিমদিয়া গ্রামে। পিতামাতার একমাত্র সন্তান। বাবা শেখ মেসের আলী। তাঁর পেশা ছিল রাজমিস্ত্রী, ওস্তাগার। কৃষিকাজও করতেন। অভাব অনটনের জীবন ছিল তাদের। সংসারে রোজগারের জন্য সুলতানও বাবাকে সাহায্য করতেন। স্কুলে পড়াশোনা করলেও বেশি দূর অগ্রসর হতে পারেননি। শৈশবকাল থেকেই সুলতানের মধ্যে আঁকাআঁকির দিকে ঝোঁক দেখা গিয়েছিল। গত বছরের জুলাইতে ছিল সুলতানের জন্ম–শতবার্ষিকী। সেটা যথাযথভাবে পালিত হয়নি। এ বছর যে কিছু হচ্ছে এর পেছনে নাসির আলী মামুনের ভূমিকাই সর্বাগ্রে।
১৯৩৮ সালে নড়াইলের জমিদারের সহায়তায় কলকাতা চলে যান সুলতান। সে সময় উপমহাদেশের একজন সেরা শিল্প সমালোচক শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর সাহায্যে ১৯৪১ সালে কলকাতা আর্ট কলেজে ভর্তি হতে পেরেছিলেন। তখন সেখানে সুলতানের অন্য সতীর্থদের মধ্যে ছিলেন জয়নুল আবেদীন, আনোয়ারুল হক, কামরুল হাসান প্রমুখ। কিন্তু তিন বছর পর শিক্ষা অসমাপ্ত রেখেই আগ্রা, দিল্লিসহ নানা স্থানে ঘুরেফিরে কাশ্মীরে থাকেন প্রায় দু বছর, সিমলায় আয়োজন করেছেন নিজের শিল্প–প্রদর্শনীর। যেখানে গেছেন ছবি এঁকেছেন। ছবি এঁকে জীবনধারণ করেছেন। দেশ ভাগ হয়ে যাওয়ার পর ১৯৪৭ সালে চলে যান লাহোরে। ১৯৪৮ সালে প্রদর্শনী করেন।
১৯৫১ সালে সুলতান মার্কিন সরকারের আমন্ত্রণে পাকিস্তান সরকারের প্রতিনিধি হয়ে সে দেশে যান শিক্ষা বিষয়ে আলোচনায় যোগ দিতে। বেশ কিছুদিন সে দেশে থেকে লন্ডন আসেন। সেখান থেকে যান প্যারিসে। সেই ভবঘুরে বোহেমিয়ান জীবন। ছবি আঁকেন, প্রদর্শনী করেন। কিছু আয় করেন।
১৯৪৯ সালে যান করাচি। সেখানেও প্রদর্শনী করেন। করাচিতে সে সময়ে বাঙালি লেখক শিল্পীদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেখানে নাটক নিয়েও কিছুদিন মেতে ছিলেন। খান আতাউর রহমানের সঙ্গে সিরাজদ্দৌলা নাটকে অভিনয় করেছিলেন মীরজাফর চরিত্রে।
১৯৫১ সালে মার্কিন সরকারের আমন্ত্রণে পাকিস্তান সরকারের প্রতিনিধি হয়ে সে দেশে যান শিক্ষা বিষয়ে আলোচনায় যোগ দিতে। বেশ কিছুদিন সে দেশে থেকে লন্ডন আসেন। সেখান থেকে যান প্যারিসে। সেই ভবঘুরে বোহেমিয়ান জীবন। ছবি আঁকেন, প্রদর্শনী করেন। কিছু আয় করেন। এভাবে চলতে চলতে ১৯৫৩ সালের প্রথম দিকে ফিরে আসেন করাচিতে। তারপর ওই বছরের শেষ দিকে ঢাকায় চলে আসেন। আবার হঠাৎ উধাও হয়ে যান সুলতান। দৌলতপুর, খুলনা, যশোর ইত্যাদি হয়ে যশোরের নড়াইলের চিত্রা নদীর পাড়ে মাছিমদিয়া গ্রামে গড়ে তোলেন এক বিচিত্র আবাসস্থল। সেখানে এক ভাঙা জমিদার বাড়িতে বসবাস করেন—পাখি, বেজি, বিড়ালসহ নানা ধরনের জন্তু, সাপ ইত্যাদির সঙ্গে। পানি নেই, বিদ্যুৎ নেই, দরোজা–জানালা সব ভাঙা। নিয়মিত খাবারের ব্যবস্থাও নেই।
১৯৭৬ সালে শিল্পকলা একাডেমিতে সুলতানের একক বৃহৎ প্রদর্শনীর মাধ্যমে ঢাকার বৃহত্তর নাগরিক সমাজে শিল্পী সুলতানের পুনরুত্থান ঘটল। তিনি নতুন করে দেশের মানুষের কাছে আবির্ভূত হলেন। শিল্প–বোদ্ধা সমাজ অবাক বিস্মিত হলেন তাঁর বড় বড় শিল্পকর্ম দেখে—যেখানে শোভা পাচ্ছে আবহমানকালের বাংলার কিষাণ–কিষাণীর শক্তিশালী পেশিবহুল দৃশ্যাবলি, তাদের অসীম শক্তির অধিকারী বিদ্রোহী জীবন।
১৯৭৬ সালে শিল্পকলা একাডেমিতে সুলতানের একক বৃহৎ প্রদর্শনীর মাধ্যমে ঢাকার বৃহত্তর নাগরিক সমাজে শিল্পী সুলতানের পুনরুত্থান ঘটল। তিনি নতুন করে দেশের মানুষের কাছে আবির্ভূত হলেন। শিল্প–বোদ্ধা সমাজ অবাক বিস্মিত হলেন তাঁর বড় বড় শিল্পকর্ম দেখে।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পর ষাটের দশকের জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সময়ে কামরুল হাসান, রশীদ চৌধুরী, কাইয়ুম চৌধুরী, নিতুন কুন্ডু, রফিকুননবীর মতো আধুনিক শিল্পীদের প্রভাব ও তাঁদের অনেকের সঙ্গে আমাদের সম্পৃক্ততা ছিল। সে সময়ের ঢাকার বুদ্ধিজীবী সমাজে সুলতানের নাম আলোচিত ছিল না। আমরাও তেমন কিছু জানতাম না। হয়তো সব কিছু মিলিয়ে একধরনের নাগরিক–উন্নাসিকতাও কাজ করেছে। সত্তর দশকের আগে সুলতানের শিল্পকর্ম সংগ্রহের তেমন আগ্রহও দেখা যায়নি সংগ্রাহক মহলে। ১৯৭৬ সালে প্রদর্শনীর পর সুলতানকে নিয়ে আগ্রহ ও উৎসাহ বেড়ে যায় এবং তারপর তিনি এক কিংবদন্তীতে পরিণত হন।
দুই.
১৯৭৬ সালে শিল্পকলা একাডেমির সুলতানের একক শিল্প প্রদর্শনীর সময় থেকেই সুলতানের জীবনে প্রবেশ করেন আলোকচিত্রশিল্পী, বিশিষ্ট প্রতিকৃতি–আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুন। এই প্রদর্শনী শুরুর আগে থেকেই তিনি কাছ থেকে দেখছেন সুলতানকে; কর্মরত অবস্থায়, প্রদর্শনীর সময় এবং প্রদর্শনীর পরও। এভাবে মামুন সুলতানের কাজ ও তাঁর নিজস্ব জীবন–যাপন পদ্ধতির ভক্ত হয়ে যান।
মামুন ১৯৭২ সালের শুরু থেকেই পোর্ট্রেট ফটোগ্রাফি শুরু করেন। দেশের সেরা কবি, লেখক, শিল্পী, বিজ্ঞানী এবং রাজনীতিবিদদের ছবি তুলতে থাকেন। এরই ধারাবাহিকতায় একসময় শিল্পী সুলতান তাঁর জীবনের এক প্রধান বিষয়ে পরিণত হন। ১৯৭৬ সালের প্রদর্শনীর সময় মামুন সাহস করে সুলতানের সঙ্গে পরিচিত হতে না পারলেও ১৯৭৭ সালে একদিন সুলতানকে আবিষ্কার করেন শিল্প একাডেমিতে। তাঁকে নিয়ে মামুন রমনা পার্কে চলে যান এবং বেশ কয়েকটি ছবি তোলেন।
১৯৭৮ সালে ছবি তুলতে মামুন চলে যান সুলতানের নড়াইলের সেই ভাঙা জমিদার বাড়িতে, যেখানে বিড়াল সাপ ও নানা পশুপাখির সঙ্গে তাঁর বিচিত্র জীবনযাপন। সেই চিত্রা নদীর পাড়ে নড়াইলের মাছিমদিয়া গ্রামে ভ্রমণ মামুনের জীবনের এক অদ্ভুত মূল্যবান অভিজ্ঞতা।
তারপরে ১৯৭৮ সালে ছবি তুলতে মামুন চলে যান সুলতানের নড়াইলের সেই ভাঙা জমিদার বাড়িতে, যেখানে বিড়াল সাপ ও নানা পশুপাখির সঙ্গে তাঁর বিচিত্র জীবনযাপন। সেই চিত্রা নদীর পাড়ে নড়াইলের মাছিমদিয়া গ্রামে ভ্রমণ মামুনের জীবনের এক অদ্ভুত মূল্যবান অভিজ্ঞতা। সে সব কথা মামুন তাঁর নানা লেখা ও আলোচনায় বলেছেন। তারপর দশ বছর ধরে মামুন সুলতানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছেন। নানা কাজে সাহায্য করেছেন, পাশে থেকেছেন এবং যত দেখেছেন তত তিনি অভিভূত হয়েছেন। সুলতান নিয়ে মামুনের ঘোর যেন কাটে না। সুলতানের কথা বলতে বলতে আবেগতাড়িত হয়ে তিনি বলতে থাকেন, ‘চলমান এক অশরীরী, রহস্যময় এক প্রাণ, কখনো ছায়া, কখনো কায়া। হঠাৎ চমকে দেওয়া প্রাগৈতিহাসিক যুগের পাথরে খোদাই মুখচ্ছবি, কালের ওপারে জেগে থাকা মহাকালের বাতিঘর।
অযুত আলোকবর্ষ পাড়ি দিয়ে আসা এক ভিনগ্রহের মানুষ যেন পৃথিবীর দরজায় এসে কড়া নাড়ছেন। নক্ষত্রসমান উজ্জ্বল্যে ভরা জানার অপার্থিব মুখ অন্ধকারে আলখেল্লা পরা এক গুহা মানব—এস এম সুলতান। মাটি ও নিসর্গের সঙ্গে মিশে থাকা এক মহিরূহ।’
নাসির আলী মামুন এক দশক ধরে ঘনিষ্ঠভাবে অনুসরণ করেছেন শিল্পী সুলতানকে। এ দশ বছর সুলতানের মেজাজ–মর্জিমাফিকই মামুনের ক্যামেরাকে সচল রাখতে হয়েছে। মামুন বলেছেন, সুলতানকে অনুসরণ করা ছিল অনেকটা ছায়ার মতো ছোটার শামিল। যেমন সেই উনিশ শতকের ইমপ্রেশনিস্ট শিল্পীদের ছবি তুলেছিলেন ফটোগ্রাফার ফেলিক্স নাদার। বিখ্যাত ফটোগ্রাফার ব্রাসি যেভাবে পাবলো পিকাসোকে অনুসরণ করে অনেক ছবি তুলেছেন। যেমন ফটোগ্রাফার মান রে বিংশ শতাব্দীর তিন–চার দশক ধরে সেই সময়ের সেরা কবি, লেখক ও শিল্পীদের ছবি তুলেছেন অনেক।
মামুন বিগত পাঁচ দশকের অধিক সময় ধরে দেশ–বিদেশে আট হাজারের অধিক সেরা ব্যক্তিদের পোর্ট্রেট ছবি তুলেছেন। এদের মধ্যে চল্লিশ জনের বেশি নোবেল বিজয়ীর ছবি। তাঁদের মধ্যে আছেন লেখক অক্টাভিয়ো পাজ, গুন্টার গ্রাস, সল বেলো, ডেরেক ওবলিকট প্রমুখ। আছেন নেলসন ম্যান্ডেলা, মিখাইল গরবাচেভ, ডেসমন্ড টুটু, লেস ওয়ালেসসহ আরও অনেকে। মামুন ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ব্যক্তিগত ফটোগ্রাফার হিসেবে তাঁর সঙ্গে চল্লিশটি দেশ ভ্রমণ করেছেন।
নাসির আলী মামুনের সঙ্গে আমার পরিচয় প্রায় চার দশক হতে চলেছে। এক সময়ে প্রথম আলো ফটো বিভাগের প্রধান ছিলেন। এখনো আমাদের সঙ্গে যুক্ত আছেন। তাঁর আছে একটি সমৃদ্ধ ফটো আর্কাইভ—ফটোমিউজিয়াম। এটাই তাঁর স্বপ্ন। নিজের অর্থ আর পরিশ্রমে গড়ে তুলেছেন। এই মিউজিয়ামে ছবি ছাড়াও আছে অনেক বিখ্যাতজনদের হাতের লেখা, চিঠিপত্র, পাণ্ডুলিপি ও শিল্পকলার বড় সংগ্রহ।
মামুনের মিউজিয়ামে ছবি ছাড়াও আছে অনেক বিখ্যাতজনদের হাতের লেখা, চিঠিপত্র, পাণ্ডুলিপি ও শিল্পকলার বড় সংগ্রহ। তাঁর এই সংগ্রহশালা নিয়ে একটি বড় ফটোগ্রাফি জাদুঘর হতে পারে। তবে এ মহৎকাজ মামুন একা সম্পন্ন করতে পারবেন না। তাঁর সাহায্য লাগবে। এ কাজে রাষ্ট্র বা প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসতে হবে।
নাসির আলী মামুন নিজে এখন অনেক লেখালেখি করেন। সুলতানকে নিয়ে তাঁর একটি উপন্যাস আছে ‘যে জীবন যার’। আরও আছে অন্যান্য বই। তাঁর এই সংগ্রহশালা নিয়ে একটি বড় ফটোগ্রাফি জাদুঘর হতে পারে। ‘ফটোমিউজিয়াম’কে নিয়ে এমনই স্বপ্ন তাঁর। তবে এ মহৎকাজ মামুন একা সম্পন্ন করতে পারবেন না। তাঁর সাহায্য লাগবে। এ কাজে রাষ্ট্র বা প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসতে হবে, দাঁড়াতে হবে তাঁর পাশে। তবেই তাঁর স্বপ্ন পূরণে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জিত হবে।
নাসির আলী মামুনের সুলতানকে নিয়ে এই প্রদর্শনী—দেশের শিল্পকলা, শিল্পী সমাজ ও বিশেষতআলোকচিত্রশিল্পে এক অসাধারণ সংযোজন। শিল্প সমালোচক মঈনউদ্দিন খালেদ যথার্থই লিখেছেন, ‘সুলতান কৃষককূলের প্রতি চিত্রাঞ্জলি দিয়েছেন আর কৃষকের পূজারী শিল্পীকে আলোর শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেছেন মামুন।’
এস এম সুলতানকে নিয়ে এই প্রদর্শনীর উদ্যোগের জন্য নাসির আলী মামুনকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। বিদ্রোহী বাউল সুলতানের জন্য ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা। অভিনন্দন জানাই হংকং–সাংহাই ব্যাংক ও তার প্রধান কর্ণধার মাহবুবুর রহমানকে। বেঙ্গল ফাউন্ডেশনকে জানাই শুভেচ্ছা।
(গত ২২ আগস্ট বেঙ্গল শিল্পালয়ে ‘শতবর্ষে সুলতান’ শীর্ষক নাসির আলী মামুনের আলোকচিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অধিবেশনে মতিউর রহমান এ বক্তৃতাটি করেন।)