দৃশ্যগত শিল্পসত্তা ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা

এআই/প্রথম আলো

আদিম যুগ থেকেই আমরা শিল্পে বাঁচি এবং আমাদের চারপাশে সবদিকেই আমরা শিল্পের উৎস কিংবা শিল্পের প্রয়োগ দেখতে পাই। তবে একবিংশ শতাব্দির এই পর্যায়ে এসে যখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চিন্তা করতে ও চিন্তার প্রয়োগ করতে শুরু করেছে, তখন তা আমাদের ভাবায়—শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে। মানুষের চেতনা বা চিন্তা কৌশল কি তবে এবার প্রয়োজনের অতীত কিংবা অপ্রচলিত হতে চললো? এই প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান করতে হলে আমাদের বর্তমান বাস্তবতাই যথেষ্ট নয়। আমাদেরকে একটু অতীতে ফিরে গিয়ে আবার বর্তমানের দিকে তাকিয়ে দেখতে হবে।

হোমো স্যাপিয়েন্সের উদ্ভব ঘটে আজ থেকে প্রায় বিশ তিরিশ লাখ বছর আগে। এরমধ্যে মস্তিষ্কের নানান পরিবর্তন ও অন্যান্য হোমিনিডের সাথে পার্থক্যগুলো প্রকট হতে থাকে যার ফলাফল আজকের আধুনিক যুগের মানুষ। মানুষের আজকের বিবর্তিত রূপ হচ্ছে ভাষার আবিষ্কার যা আমাদের মস্তিষ্কের বাম অংশটিকে সক্রিয় ও যুক্তি দিয়ে ভাবতে শেখায়। ভাষার পরই যা লক্ষ করা যায় তা হলো শিল্পসত্তা। বলা হয়ে থাকে, আমাদের আবেগ-অনুভূতি বা শিল্পসত্তা নিয়ন্ত্রিত হয় মস্তিষ্কের ডান অংশের কারণে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, শিল্পসত্তার শুরুটা কোথায়? তা বুঝতে আমাদেরকে আপার প্যালিওলিথিক যুগ কিংবা প্রস্তর যুগের শেষভাগের দিকে ফিরে তাকাতে হবে।

সবচেয়ে প্রাচীন শিল্পের চিহ্ন পাওয়া যায় চল্লিশ হাজার বছর আগে যা ছিল হাড়ের তৈরি একটি বাঁশি। তারপর দেখা যায় বিভিন্ন গহনা বা ট্রাম্পেটসহ অন্যান্য কিছু বাদ্যযন্ত্র। কিন্তু প্রশ্ন হলো দৃশ্যগত শিল্পটা কোথায়? একত্রিশ হাজার বছর আগে আমরা দেখতে পাই ফ্রান্সের শ্যাভেট গুহায় মানুষের আঁকা গুহাচিত্র। ল্যাসক্যক্স গুহায় দেখা যায় ছয়শটিরও বেশি গুহাচিত্র যাদের বয়স আঠারো হাজার বছর। কাছাকাছি সময়ে ভাস্কর্য তৈরির নিদর্শন রয়েছে যার মধ্যে পাথরে করা ভিনাসের ভাস্কর্য, বিভিন্ন নারী ও পুরুষের অবয়ব উল্লেখযোগ্য। পরবর্তীকালে প্রাচীন মিশরীয়, গ্রিক ও রোমান শিল্পে প্রতীকবাদ ও বাস্তবতার মিশ্রণের শিল্পকর্ম দেখা যায়। মধ্যযুগে ইউরোপীয় শিল্পধারা অধিকাংশই ধর্মীয় বিষয়বস্তুর ওপর নির্ভরশীল থাকলেও রেনেসাঁ যুগে (১৪শ–১৭শ শতক) একটি দৃশ্যগত শিল্পচর্চায় বিপ্লব ঘটে লিওনার্দো দা ভিঞ্চি এবং মাইকেলেঞ্জেলো-র মতো শিল্পীদের মাধ্যমে যারা বাস্তবতা, মানব দেহবিদ্যা এবং দৃষ্টিকোণের (দূরত্বের অনুভূতি) নিখুঁত ব্যবহারে দৃশ্যগত শিল্পকলা বদলে দেন। পরে বারোক (ড্রামাটিক এবং আবেগপ্রবণ) ও রোকোকো (কল্পনাপ্রবণ এবং বিলাসিতাময়) ধারার উত্থান ঘটান।

১৯শ শতকে ইম্প্রেশনিজম আবির্ভূত হয়, যেখানে শিল্পীরা আলো ও মুহূর্তের অনুভূতিকে ধরার চেষ্টা করেন এবং এক্সপ্রেশনিজম আত্মপ্রকাশ করে, যা অভ্যন্তরীণ আবেগ ও মানসিক অবস্থাকে চিত্রিত করে শিল্পের মাধ্যমে। আধুনিক শিল্পকলা (১৮৭০–১৯৭০) শিল্পের সংজ্ঞা ভেঙে নতুন রূপ দেয় যেখানে কিউবিজম, স্যাররিয়ালিজম ও অ্যাবস্ট্রাক্ট এক্সপ্রেশনিজমের মতো চিত্রকলার ধারা দেখতে পাওয়া যায়। পরে, উত্তরাধুনিক শিল্পকলার (১৯৭০-এর পর) উদ্ভবের পর শিল্পের উচ্চ আদর্শ নিয়ে প্রশ্ন তোলে, ব্যঙ্গ, বহুত্ব ও সংস্কৃতির মিশ্রণকে একীভূত করতে চায়। দৃশ্যগত শিল্পকলার এই ইতিহাস দেখায়, কীভাবে মানুষ বারবার নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও অভিব্যক্তির মাধ্যমে শিল্পের সীমা প্রসারিত করেছে এবং এখনো করে যাচ্ছে। তাহলে এখন ভাবার বিষয় মানুষ কেন শিল্পচর্চা করতে শুরু করল? কেন মানুষ বাকি প্রাণীদের মতো শুধু খাদ্য ও নিরাপত্তার চাহিদা মিটিয়েই খ্যান্ত হলো না?

তাহলে এখন ভাবার বিষয় মানুষ কেন শিল্পচর্চা করতে শুরু করল? কেন মানুষ বাকি প্রাণীদের মতো শুধু খাদ্য ও নিরাপত্তার চাহিদা মিটিয়েই খ্যান্ত হলো না? এই প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান করতে আমাদেরকে ভাবতে হবে মানুষের কগ্নিশন বা চিন্তাপ্রক্রিয়া বা চিন্তা কৌশলের দিক এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কতটা সেই পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছাতে পারবে আজকাল কিংবা সুদূর ভবিষ্যতে।

এই প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান করতে আমাদেরকে ভাবতে হবে মানুষের কগ্নিশন বা চিন্তাপ্রক্রিয়া বা চিন্তা কৌশলের দিক এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কতটা সেই পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছাতে পারবে আজকাল কিংবা সুদূর ভবিষ্যতে। যে ভাষার আবিষ্কার আমাদের মস্তিষ্কের বিবর্তনকে সর্বাধিক এগিয়ে দিয়েছে যা থেকেই উদ্ভব হয়েছে চিন্তাসত্তার। চিন্তাসত্তা বা অনুভূতি প্রকাশের ইচ্ছাই আমাদের মধ্যে গল্প করা বা গল্প বলার প্রয়োজন এবং আগ্রহ তৈরি করে। এর সঙ্গে সামাজিকতার একটি বড় যোগ রয়েছে। মানুষ জন্মগতভাবেই সামাজিক গোষ্ঠী বা দলের মধ্যে থেকে এসেছে এবং বিবর্তনগতভাবে সেই চাহিদা কালেক্টিভ আনকশাসনেস বা যৌথ অবচেতনের মধ্যে বসবাস করে। এর সঙ্গে ভাষার যোগ ও সম্পর্ক স্থাপনের জন্যে ভাষাজ্ঞান আরও অগ্রসর হয় এবং এর সঙ্গে গল্প বলতে চাওয়ার প্রবণতাও। সৃষ্টিশীলতাই মানুষের অত্যন্ত স্বাভাবিক ও চিন্তা কৌশলগত প্রবণতা।

এবারে কথা বলা যাক দৃশ্যগত শিল্পকলা ও চিন্তা কৌশলের যোগসূত্র নিয়ে। রবার্ট সলসো তার বই কগ্নিনেশন অ্যান্ড দ্য ভিজ্যুয়াল আর্ট-এ বলেছেন, মানুষের চিন্তা কৌশল বা কগ্নিশনের সরাসরি প্রকাশ হচ্ছে দৃশ্যগত শিল্প। কারণ মানুষ শিশুকাল থেকে দেখতে শেখে এবং দেখা তার জীবনে ভবিষ্যৎ চিন্তাগত অগ্রগতির ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখে। দেখার মাধ্যমেই মানুষ অনুভব করে, অনুবাদ করে, মনে রাখে, কল্পনা করে এবং অনুভূতির প্রকাশ ঘটায়। মানুষের রং, আকার, আকৃতি, গঠন, গভীরতা এবং গতি অনুভব করার মাধ্যমে এবং গল্প বলতে চাওয়ার আগ্রহ থেকেই তৈরি হয় দৃশ্যগত শিল্পকলা যার সঙ্গে মস্তিষের ভিজ্যুয়াল করটেক্সের যোগ রয়েছে। এছাড়াও মানুষ ভীষণ রকমের স্মৃতিকাতর এবং স্মৃতিপ্রবণ—দৃশ্যগত বস্তু এবং চারপাশের প্রভাবের ব্যাপারে। এছাড়াও মানুষের মস্তিষ্কের স্নায়বীয় যোগাযোগ সাহায্য করে মস্তিষ্কে চিত্র তৈরি করতে এবং তা অন্যদের কাছে প্রকাশের আগ্রহ থেকেই মানুষ আঁকে বা তৈরি করে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কথা বলতে গেলে আমাদেরকে কিছু মেশিন নিয়ে, যা মানুষকে অনুকরণ করে, সেসব মেশিনের দর্শনের দিকে ফিরে তাকাতে হবে। ১৯৪০ ও ১৯৫০-এর দশকে, অ্যালান টিউরিং-এর মতো বিজ্ঞানীরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে একটি বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন যেখানে প্রথমদিককার প্রোগ্রামগুলো কিছু সফলতা দেখালেও, বাস্তব সমস্যার সমাধানে অক্ষমতার জন্য ১৯৭০ এর দশকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার শীতকাল নামে পরিচিত একটি সময় বা পর্যায় আসে। তবে ১৯৮০’র দশকে বিশেষ সিস্টেমের মাধ্যমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নতুনভাবে প্রসার ও জনপ্রিয়তা পায়। পরবর্তী সময়ে ১৯৯০ ও ২০০০ এর দশকে মেশিন লার্নিংয়ের মাধ্যমে ডেটা থেকে শেখার ওপর গুরুত্ব দেওয়ার মধ্য দিয়ে ২০১০ এর পর, ডিপ লার্নিংয়ের বিস্ফোরণ ঘটে, যার ফলে ছবি শনাক্তকরণ, ভাষা প্রক্রিয়াকরণ, এবং স্বয়ংচালিত গাড়ির মতো ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা একদম বিপ্লব সৃষ্টি করে এবং আজকের প্রযুক্তি জগতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হয়ে উঠেছে। কিন্তু এই বিপ্লব কীভাবে হলো বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ঠিক কীভাবে শেখে?

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার শেখে মূলত তথ্য বা ডেটা বিশ্লেষণের মাধ্যমে। সাধারণভাবে, তিনটি পদ্ধতিতে কগ্নিশন ঘটে—সুপারভাইজড লার্নিং, আনসুপারভাইজড লার্নিং এবং রিইনফোর্সমেন্ট লার্নিং। সুপারভাইজড লার্নিংয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে নির্দিষ্ট উদাহরণ ও তাদের সঠিক উত্তর দেখিয়ে শেখানো হয়, যেমন ছবি দেখে বিড়াল ও কুকুর চিনতে শেখা। আনসুপারভাইজড লার্নিংয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিজে নিজেই তথ্যের ভেতরে লুকানো ধরন বা সম্পর্ক খুঁজে বের করে প্যাটার্ন রিকগ্নিশনের মাধ্যমে, যেখানে কোনো সঠিক উত্তর দেওয়া হয় না। রি-ইনফোর্সমেন্ট লার্নিংয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চেষ্টা ও ভুলের মাধ্যমে শেখে, যেখানে ভালো কাজের জন্য পুরস্কার এবং খারাপ কাজের জন্য শাস্তি দেওয়া হয়। এভাবে ধাপে ধাপে অভিজ্ঞতা অর্জনের মাধ্যমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আরও দক্ষ হয়ে ওঠে এবং নতুন পরিস্থিতিতে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে শিখতে পারে। কিন্তু অবশ্যই, মানুষের জটিল অভিজ্ঞতা ও বিবর্তনের পরিস্থিতি ও সম্ভাবনা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নেই।

এই পর্যায়ে যে প্রশ্নটা করা যেতে পারে তা হচ্ছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দ্বারা কি মানুষের লক্ষাধিক বছরের বিবর্তনে প্রাপ্ত চিন্তা কৌশল বা কগ্নিশনের পর্যায়ে আসা বা তার চেয়ে উপরে চলে যাওয়া সম্ভব? ‘মেশিন কী ভাবতে পারে?’ এই প্রশ্নের উত্তরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জনক অ্যালেন টিউরিং ১৯৫০ সালে একটি প্রস্তাব দেন যা হলো, একজন পরীক্ষক মানুষকে পরীক্ষা করতে দেওয়া হবে না দেখে লিখিত কোনো দুইটি কাজ যার মধ্যে একটি কোনো মেশিনের মাধ্যমে করা এবং অন্যটি মানুষের মাধ্যমে করা। যদি তিনি পার্থক্য করতে পারেন, তবে মেশিনটি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হবে অন্যথায় কৃতকার্য হবে। এই পরীক্ষাটিকে বলা হয় দ্য টিউরিং টেস্ট। টিউরিং টেস্ট কিছু প্রোগ্রামের ক্ষেত্রে আংশিক সফল হলেও সকল প্রসঙ্গ অনুসন্ধান করতে পারে না। আবার একই সাথে শুধুমাত্র কথোপকথনের কৌশলের ওপর নির্ভর করেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলা হয়। এছাড়াও এই পরীক্ষার মাধ্যমে আমরা নিশ্চিত হতে পারি না যে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আদৌ চেতনা, বোধগম্যতা কিংবা মানুষের মতো কগ্নিশন আছে কি নেই। তাছাড়া এখানে আরও নানা ধরনের পক্ষপাত রয়েছে যেটা সংস্কৃতিগত বা পর্যবেক্ষকের বৈশিষ্ট্যগত হতে পারে যা ভুল ফলাফল দিতে পারে।

এক্ষেত্রে টিউরিং টেস্টের হালনাগাদ বা বিবর্তিত কিছু পরীক্ষা আছে যেমন—দ্য টোটাল টিউরিং টেস্ট , দ্য রিভার্স টিউরিং টেস্ট, দ্য লাভলেইস টেস্ট, দ্য উইনোগ্র্যাড স্কিমা টেস্ট, ইন্টিগ্রেটেড কগ্নিটিভ আর্কিটেকচার । উইনোগ্র্যাড স্কিমা চ্যালেঞ্জ ভাষার সাধারণ শব্দ বিশ্লেষণ নয়, বরং বাস্তবজ্ঞান ও কমনসেন্স দিয়ে বাক্য বোঝার ক্ষমতা পরীক্ষা করে। লাভলেস টেস্ট সৃজনশীলতা যাচাই করতে চায়—কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যদি প্রোগ্রামারের নির্দেশনা ছাড়াই নতুন কিছু তৈরি করতে পারে, তবেই সে উত্তীর্ণ হয়। অন্যদিকে, রিভার্স টিউরিং টেস্ট বা CAPTCHA মূলত মানুষের পক্ষেই পরীক্ষা, যেখানে মানুষ ও বটের মধ্যে পার্থক্য করা হয়। আজকের যুগে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পরীক্ষায় মাল্টিমোডাল পদ্ধতিও ব্যবহৃত হচ্ছে যেমন—ভাষা, দৃশ্য এবং শারীরিক তথ্য একত্র করে মেশিনের গভীর বুদ্ধিমত্তা যাচাইয়ের চেষ্টা চলছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে কোন পর্যায়ে এইরকম পরীক্ষা আমাদেরকে সঠিক উত্তর দিতে সক্ষম হবে এবং আদৌ কি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দ্বারা সম্ভব হবে মানুষের কগ্নিশন বা তারও উপরের পর্যায়ে পৌঁছানো?

একটি গবেষণায় দেখা যায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পক্ষে পারিপার্শ্বিক অবস্থা, মূর্তকরণ কৌশল এবং বোধগম্যতা আয়ত্ত করা সম্ভব নয় যে কারণে টিউরিং টেস্টেও পাশ করা সম্ভব নয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের চিন্তাশক্তিকে অনুকরণ করতে অনেকদূর এগিয়েছে, কিন্তু চেতনা, নৈতিকতা ও সাধারণ বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রগুলোতে এখনো অনেক দূরের ব্যাপার এবং এ উন্নয়ন সমাজের ওপর গভীর প্রভাব ফেলবে।

কিন্তু এসবকিছু আমাদের শুধু বর্তমানের কথাটুকু বলছে, ভবিষ্যতে যদি সত্যিই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এই পরীক্ষায় উৎরে যায় সেক্ষেত্রে কী হতে পারে?

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বর্তমানে অবশ্যই এমন শিল্পকর্ম তৈরি করতে পারে যা অত্যন্ত দক্ষ, নতুন এবং মানুষের মধ্যে আবেগের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে সক্ষম। বিভিন্ন শিল্পরীতির অনুকরণ, নতুন শৈলী উদ্ভাবন এবং মানুষের সাথে সহযোগিতায় কাজ করা সম্ভব হচ্ছে। শিল্প তৈরি করতে এবং শিল্প জগৎকে প্রভাবিত করতে পারলেও, এটি মানবশিল্পকে পুরোপুরি প্রতিস্থাপন করতে পারবে কিনা তা নির্ভর করছে শিল্পকে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করা হচ্ছে এবং তা কীভাবে বিবর্তিত হচ্ছে তার ওপর। কিন্তু তবুও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কি একসময় মানুষের দৃশ্যগত শিল্পকলার প্রক্রিয়াকে প্রতিস্থাপন বা অচল করে দেবে?

প্রথম কথা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কখনোই আমাদের জগতের হয়ে সবকিছু অনুভব ও বোঝার সুযোগ পাচ্ছে না আজ পর্যন্ত, যে কারণে একজন মানুষের পারস্পারিক পরিবেশ ও যে মিথষ্ক্রিয়া মানুষের জটিল কগ্নিশনের জন্য দায়ী তা আপাতত কোনো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পক্ষে সম্ভব নয় এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনাও অল্পই।

দ্বিতীয়ত, যদি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সেই পর্যায়ে চলেও যায় মানুষের কগ্নিশন এবং বিবর্তনও তো থেমে থাকবে না। তা আরও জটিলতর হবে যা নিশ্চিতভাবেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দাস না হয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে শুধুমাত্র একটি প্রযুক্তি হিসেবে যাওয়ার চেষ্টাটাই করবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে মানবশিল্পের সম্ভাব্য বিকল্প না ভেবে, বরং তার সম্প্রসারণের যন্ত্র হিসেবেই বিবেচনা ও ব্যবহার করাকেই বাঞ্ছনীয় ভাবা হবে।

স্যাপিয়েন্স শব্দের অর্থ প্রাজ্ঞ। প্রাজ্ঞ হয়ে বিবর্তিত হয়ে মানুষের প্রবণতাই বর্তমানকে উৎরে ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবা। সেই ভবিষ্যতে শিল্পচর্চায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বড়জোর একটি টুল বা যন্ত্র হতে পারে যা কি না মানুষের গল্প বলা এবং কল্পনা প্রকাশ করার পুরনো ইচ্ছাটাই পূরণ করবে। যেহেতু আজ অব্দি কোনো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা টিউরিং টেস্ট পাশ করতে পারেনি, মানুষের দৃশ্যগত শিল্পকলার ক্ষেত্রেও তা মানুষের সমতুল্য বা প্রতিস্থাপন যোগ্য নয়। ভবিষ্যের কথা কেউ নিশ্চিতভাবে বলতে পারে না কিন্তু সৃষ্টি ও দর্শন যদি নিজের চিন্তা কৌশলকে হালনাগাদ না করে—বলতে পারা যায় না হয়তো আপনি আর শিল্পী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ থাকবেন না!