মা যখন এক সন্তানকে কোলে, আরেক সন্তানকে হাতে ধরে ভাঙাচোরা সাঁকো পার হন, তখন তাঁর মনের যে আকুতি, তা উপলব্ধি করতে হলে গ্যালারি ঘুরে দেখার বিকল্প নেই। ‘শিল্পাঙ্গন’ আয়োজিত লালমাটিয়ায় ভূমি গ্যালারির স্পেসে সমর মজুমদারের ষষ্ঠ একক চিত্রকলা প্রদর্শনীর প্রতিটি ছবিতেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনুভূতির আড়ালে চিরন্তন আবেগ স্পষ্ট হয়ে মরমে দোলা দেয়। হারিকেনের আলোয় পড়তে বসা সন্তানের পাশে মায়ের নির্ঘুম প্রহরা, খাওয়ার পর সন্তানকে আচমন করিয়ে দেওয়ার মমত্ব, মা–বোনদের খোশগল্প, মাছ বিক্রেতার অপেক্ষারত ভঙ্গি কিংবা খেতের আলে কৃষকের নাশতা খাওয়ার সময় কিষানির হাতপাখার বাতাস—এমন অসংখ্য দৃশ্যে খুলে যায় অনুভবের দরজা, যেখানে মানুষকে দেখা যায় নির্মল আনন্দে ও মানবিকতার আলোয়। এসব দৃশ্য কেবল নস্টালজিক স্মৃতিচারণা নয়; বরং খয়ে পড়া সমাজব্যবস্থায় মানবিক সভ্যতার এক প্রত্যাশিত আদর্শ, যা তাঁর চিত্রে বহুমাত্রিক প্রতীকে রূপ পায়।
সমর মজুমদারের চিত্রে মানুষের অন্তর্গত অনুভূতির যে রূপায়ণ, তা দৃশ্যমানের সীমা অতিক্রম করে অনুভবের গভীরে প্রবেশ করে। তিনি সরল গড়নের অবয়ব ও মুখভঙ্গি দিয়ে বাংলার গ্রামীণ সমাজজীবনের দীর্ঘ ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত অনুবাদ রচনা করেন—যেখানে পরাণকথার মতো বিন্যস্ত আছে আমাদের নিকট অতীত, পূর্বপুরুষের নির্মল স্নেহ–প্রেম–ভালোবাসা জড়িত জীবনগাথা, পারিবারিক সম্পর্ক, সামাজিক মূল্যবোধ, মানবিক দৃষ্টিকোণ, প্রকৃতি ও মানুষের পারস্পরিক সংযোগ এবং ক্ষয়ের নীরব ইঙ্গিত।
সঞ্চিত স্মৃতি ও ধ্যানতন্ময়তায় পাশ্চাত্যের একাডেমিক বাস্তবধারায় চিত্রজমিনে তিনি রূপের যে গড়ন তৈরি করেন, তা বাহুল্যবর্জিত, যেখানে আধ্যাত্মিকতায় যুক্ত হয় প্রাচ্যধারার সংহতি। তাঁর আলো–ছায়ার অনিয়মিত ব্যবহার সৃষ্টি করে এক স্বপ্নময় দ্বিধা—দর্শককে প্রশ্নে ফেলে দেয়, এ দৃশ্য কি বাইরের, না ভেতরের? তাঁর প্রতিটি চিত্রমানসে সমাজবাস্তবতার ছাপ স্থায়ী দাগের মতো উপস্থিত। প্রান্তিক জীবনের ক্লান্তি, নগরের অস্থিরতা, অর্থনৈতিক ক্ষয়, মানুষের সম্পর্কের নৈকট্য ও দূরত্ব—সবই তাঁর চিত্রভাষায় দৃঢ় সুরে ধ্বনিত হয়। সন্ন্যাসীর মতো নির্মোহ ও সংযত ব্যক্তিত্ব তাঁর শিল্পচরিত্রেও প্রতিফলিত।
সমর মজুমদারের চিত্রে মায়া, স্নেহ, ভালোবাসা, স্মৃতি ও অনুরাগের মতো অদৃশ্য অনুভূতিগুলো রেখা, রং ও গঠনে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। তিনি রূপ দেন সেসব অনুভূতিকে, যা চোখে ধরা পড়ে না—কেবল হৃদয়ে স্পর্শ করে। তাই তাঁর চিত্র কেবল দৃশ্য নয়; অধরা আবেগকে দৃশ্যায়নের এক সংবেদনশীল শিল্পপ্রক্রিয়া।
কালি ও তুলির রেখায় গড়ে ওঠা তাঁর ড্রয়িংগুলো গ্রামবাংলার নিসর্গ, মানুষ ও লোকজ সংস্কৃতির স্নিগ্ধ সংকেত বহন করে। এগুলো সরাসরি গল্প বলে না; বরং ইঙ্গিতের ভেতর দিয়ে স্মৃতির পথ খুলে দেয়। প্রযুক্তির কারণে গ্রাম থেকে হারাতে বসা প্রকৃতি, লোকজ সংস্কৃতি ও দৈনন্দিনতার ক্ষয়চিহ্ন তাঁর কাজে চিহ্নিত হয় এক নীরব শিল্প-দলিল হিসেবে। ‘আত্মার গান’ সিরিজে পটচিত্র, আলপনা ও লোকজ মোটিফের ছায়া আবেগের মাত্রাকে আরও প্রাসঙ্গিক, গভীর ও অনন্য করে তোলে। রেখার পরিমিতি, দেহকাঠামোর ধ্যানমগ্ন সরলতা ও মুখাবয়বের ইঙ্গিতধর্মী নির্মাণ মিলিয়ে তাঁর কাজ তৈরি করে এক অন্তর্দৃষ্টিময় অনুভব। রঙের লেপন, আকারের বিন্যাস ও পারিপার্শ্বিক আবহে এই অধরা অনুভূতিগুলোর রূপায়ণ তাঁর ধ্যানতন্ময়তারই ফসল।
১৯ ডিসেম্বর শুরু হওয়া প্রদর্শনীটি চলবে ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫ পর্যন্ত।