গঘের ছবিতে গ্রীষ্মবৈভব

গ্রাফিকস: প্রথম আলো

ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ বিশ্বচিত্রকলার এক অনন্য নাম, যাঁর জীবন ছিল বেদনার, কিন্তু শিল্পচেতনা ছিল আনন্দ, আলো ও গভীর প্রেমে পূর্ণ। তাঁর শিল্পকর্মে যেমন প্রকৃতির প্রতি প্রেম, তেমনই রয়েছে এক নিঃসঙ্গ আত্মার অন্বেষণ। গ্রীষ্ম তাঁর কাছে শুধু একটি ঋতু নয়, বরং ছিল জীবনের রং, আলো, আবেগ এবং একান্ত আপন উপলব্ধির প্রতীক। আজ জগৎপ্রিয় আঁকিয়ে ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের ১৩৫ম মৃত্যুদিন। ১৮৯০ সাল থেকে আজ অবধি একটি দিনও কি গঘ বিহনে আমাদের শিল্পচারিতা চলে? এই শিল্পী তাঁর শিল্পগরিমা দিয়ে আমাদের গর্বিত করে রাখেন। রৌদ্রযাপনে মুঠো মুঠো আলোর কারিগর ভিনসেন্টের গ্রীষ্ম কী রকম প্রসন্ন উচ্ছ্বাসে আমাদের চমকিত করে, সেদিকেই এ রচনা-পাঠের অভিমুখ থাকুক। 

আপনি যখন ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের কথা ভাবেন, তখন আপনি কোন রঙের কথা সবচেয়ে বেশি ভাবেন? সম্ভবত তাঁর হলুদের মহিমান্বিত ব্যবহার। ভ্যান গঘের চিত্রকর্ম গ্রীষ্ম—তার চেতনাজগতে প্রেম, প্রকৃতি ও আত্মার প্রতিফলন ঘটিয়েছে। ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের গ্রীষ্ম এবং গ্রীষ্মপ্রেমী এই শিল্পীর অন্তর্জগৎ ও রঙের কথা—রং বুনতেন ভ্যানগঘ, ঘননীল প্রেক্ষাপটে গ্যাচেটের হলুদ মুখ, হলুদ গমখেতের ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে পাখি। রাতের আকাশে বাঁকা চাঁদ আর তারা শিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের চোখে ধরা পড়েছিল। নীল আর হলুদ রঙের মিশেলে তিনি রংতুলিতে ফুটিয়ে তুলেছেন রাতের রহস্যময় সৌন্দর্য। ১৮৮৯ সালের জুনে ‘আরোগ্য সদনের বেড়া দেওয়া পুবমুখো শস্যখেত স্কেচটির আকুতিভরা হলুদ রঙের মর্মভেদী আঁচড়গুলো লক্ষ করলে বোঝা যায়, আঁকবার মতন জনমনিষ্যি হাতের কাছে না পেয়ে নিজের হৃদয়কেই তিনি ক্ষতবিক্ষত করতে শুরু করে দিয়েছেন।’ (অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, শিল্পের আন্তর্বলয় বিপজ্জনক দুই শিখর, ব্যক্তি ও রচয়িতা, প্রমা)

ক্যাফে অ্যাট দ্য টেরেস, ১৮৮৮
ছবি: সংগৃহীত

প্রবল সূর্যালোকের নিচে বসে এঁকেছিলেন অসংখ্য সূর্যমুখীর ছবি। আলোবিস্তারি হলুদমুখর ছবির কারিগর ভ্যান গঘ। গঘের প্যালেটে বহু অপ্রধান রঙের খারিজি স্বত্ব তুলে দেওয়া হলুদের অনুকূলে। 

ভ্যান গঘের জীবন নিয়ে লেখা বই ‘লাস্ট ফর লাইফ’-এর শেষ অংশে আরভিং স্টোন লিখছেন, ‘অভাবের দারুণ রৌদ্রতাপ যখন শস্যক্ষেত্রের পাশের ক্ষুদ্র কবরখানাটি তপ্ত করে তুলত, তখন ভিনসেন্টের সূর্যমুখী গাছের ছায়ার নিচে থিও আরামে বিশ্রাম করত।’ 

১৮৮৮ সালে প্যারিস থেকে আলোঝলমলে শহর আর্লসে চলে আসেন ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ। এক বছরের একটু বেশি সময়ের মধ্যে এঁকে ফেলেন তিন শতাধিক ছবি, যার প্রধান রং হলুদ। এমনকি সেই বিখ্যাত ছবি ‘ক্যাফে অ্যাট দ্য টেরেস’, সেই রাতের ছবিতেও সিংহভাগ হলুদ রং। বুঝতে অসুবিধা হয় না, আর্লসের চোখঝলসানো সূর্যালোকের হলুদ আচ্ছন্ন করে রেখেছিল ভিনসেন্টের মন। ভাই থিওকে চিঠিতে লিখেছিলেন সেই কথা, ‘কী সুন্দর এই হলুদ!’ সঙ্গে যোগ করেছিলেন এই আক্ষেপটুকুও, আর্লসের প্রকৃতি-উপচানো এই ‘হলুদ’কে তিনি যথাযথভাবে তাঁর ছবিতে ফুটিয়ে তুলতে পারছেন না। অসহায় লাগছে তাঁর। কিন্তু খটকা লাগে, সত্যিই কি হলুদ রং তাঁকে ভীষণভাবে পেয়ে বসেছিল, যে কারণে মাঠ-ঘাট-ফুল-মানুষ সবেতেই তিনি ওই রঙের প্রয়োগ করতেন? বিশ্বাস করতে মন চায় না। নানা ঘটনায় ছোট থেকেই একাকিত্ব ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। অস্থিরতা ঘিরে থাকত সারাক্ষণ। কিঞ্চিৎ উদ্ভট এই ব্যক্তির সঙ্গে কারোরই সেভাবে সখ্য গড়ে ওঠেনি কখনো। এই চোরা বিষণ্নতাই কি ‘হলুদ’ রং হয়ে বেরিয়ে আসত ক্যানভাসে? (‘স্বর্ণশ্যাম স্তব্ধতা’, পৃথ্বী বসু)

আরলে সূর্যালোকের খোঁজে: গ্রীষ্মের প্রতিশ্রুতি

হারভেস্ট অ্যাট লা ক্র্যা, ১৮৮৮
ছবি: সংগৃহীত

১৮৮৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভ্যান গঘ দক্ষিণ ফ্রান্সের আরল শহরে পৌঁছান, যেখানে তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন রৌদ্রস্নাত ভূমিতে শিল্পচর্চার। গ্রীষ্মের আগমনেই তিনি হয়ে উঠলেন প্রকৃতির প্রেমে মুগ্ধ, যেন এক নবজন্ম লাভ করলেন রং ও আলোয়। ভ্যান গঘ দক্ষিণ ফরাসি দেশকেই তাঁর শিল্পে ভালোবেসে ছিলেন। এ অঞ্চলের উষ্ণস্বভাবী আবহাওয়ায় খুঁজে পেয়েছিলেন তাঁর প্রেরণার প্রদেশ। ‘How lovely yellow is, it stands for the sun.’ (Vincent van Gogh) 

সাধারণত জুন থেকে আগস্ট—এই সময়ে গমের খেতগুলো সবই হলুদ। সব খেত যেন তখন নীল আকাশের নিচে একেকটি হলুদ সাগর। এই আবেগময় ভাষা হলুদ প্রতিফলিত হয় তাঁর বিখ্যাত চিত্রকর্ম ‘হারভেস্ট অ্যাট লা ক্র্যা’–তে (জুন ১৮৮৮, ভ্যান গঘ মিউজিয়াম, আমস্টারডাম), যেখানে গ্রীষ্মকালীন কৃষিকাজ ও রৌদ্রতপ্ত প্রকৃতি একত্র হয়েছে এই উজ্জ্বল রচনায়। সময়টি ভ্যান গঘ নিজেই বলেছিলেন তাঁর ‘উজ্জ্বল হলুদের সময়’। প্রকৃতির প্রতি প্রেম এখানে কেবল রঙে নয়, শ্রমিকের ঘামে, সূর্যের তাপে ও নিসর্গের মধ্যে এক আত্মিক মিলনে রূপ নেয়। 

‘উইটফিল্ডস উইথ সাইপ্রাস’ সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘আমার কাছে সাইপ্রাসের একটি ক্যানভাস আছে, যার কিছু শিষ, কিছু পপি, স্কচ প্লেডের টুকরার মতো নীল আকাশ; পূর্ববর্তীটি একটি ঘন ইম্পাস্টো দিয়ে আঁকা...এবং সূর্যের মধ্যে গমের খেত, যা চরম তাপের প্রতিনিধিত্ব করে, খুব ঘন।’ ভ্যান গগ যিনি এই ভূদৃশ্যকে তাঁর ‘সেরা’ গ্রীষ্মকালীন চিত্রগুলোর মধ্যে একটি বলে মনে করেছিলেন।

দ্য ইয়েলো হাউজ, ১৮৮৮
ছবি: সংগৃহীত

গ্রীষ্মের সূর্যালোকে বহিরঙ্গে হলুদনির্ভর ক্যানভাসজুড়ে তুলি চালনার সময় হয়তো স্বগতোক্তির মতো করে বলছেন, ‘আহ! প্রিয় থিও, যদি তুমি এখানকার সূর্যটা দেখতে...’ এই আলো আত্মা পর্যন্ত পৌঁছে যায় এবং তা শান্ত করে। গ্রীষ্ম বুঝি তাঁর ক্যানভাসে এক অলৌকিক স্পর্শ নিয়ে ফুটে ওঠে, সূর্যমুখী, গমখেত, গমের আঁটি ও কিষান মানুষদের প্রতি শ্রদ্ধা। 

গ্রীষ্মের ঘর ও গগ্যাঁর আগমন ও স্বপ্ন বনাম বাস্তবতা নিয়ে তার সেই হলুদ বাড়ি, যেখানে তিনি শিল্পীদের একটি কমিউন গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। গ্রীষ্মের আনন্দ, একক জীবনকে ঘিরে প্রেম এবং বন্ধুত্বের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পায়। তিনি পল গগ্যাঁকে আমন্ত্রণ জানান এই ‘গ্রীষ্মের আশ্রমে’ বসবাসের জন্য। মৃত্যুর আগে ১৮৯০ সালের শেষ গ্রীষ্ম। জুলাই মাসে আঁকা ‘উইটফিল্ড উইথ ক্রোস’। চিত্রকর্মটিতে দেখা যায় এক অজানা পথে চলে যাওয়া, আকাশে উড়ন্ত কাকের ঝাঁক, আর হলুদ গমখেত। রোদ্দুরের মাঝে গ্রীষ্ম এখানে বিস্ফোরণের মতো, এক রঙিন আর্তনাদ। 

ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের কাছে গ্রীষ্ম ছিল জীবনের প্রতিচ্ছবি—জন্ম ও মৃত্যুর মাঝখানে একঝলক উজ্জ্বলতা। আরলের উষ্ণ দিন, সাঁ-রেমির নীরব উদ্যান এবং ওভের-সুর-ওয়াজের দিগন্তজোড়া গমখেত—সবই প্রকাশ করে তাঁর গ্রীষ্মের প্রেম। তাঁর শিল্পকর্ম ‘হারভেস্ট অ্যাট লা ক্র্যা’, ‘দ্য ইয়েলো হাউজ’, ‘দ্য গার্ডেন অফ দ্য অ্যাসাইলাম’ এবং ‘উইটফিল্ড উইথ ক্রোস’-এর প্রতিটিই একটি গ্রীষ্মকালীন অনুভূতির প্রতিচ্ছবি। তাঁর চিঠিগুলোও একইভাবে আমাদের জানিয়ে দেয়, এই গ্রীষ্ম শুধু প্রকৃতির নয়, আত্মারও গ্রীষ্ম।

উইটফিল্ড উইথ ক্রোস, ১৮৯০
ছবি: সংগৃহীত

ভ্যান গঘের ‘দ্য হার্ভেস্ট’ নিঃসন্দেহে তাঁর ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা দৃশ্যচিত্র। ১৮৮৮ সালের গ্রীষ্ম, ভিনসেন্ট সেই সময়কার প্যানোরামিক দৃশ্যটি ক্যানভাসে ধারণ করেন। আশ্চর্যজনকভাবে ‘দ্য হার্ভেস্ট’-এর বেশির ভাগ অংশই এক দিনে সম্পন্ন হয়েছিল। দুপুরের রোদের নিচে এ ছিল তাঁর অভিপ্রেত এক প্রচেষ্টা। ‘সূর্যমুখী যা ও খুব ভালোবাসত, আর হলুদ ডালিয়া, হলুদ ফুল সর্বত্র। তোমার মনে পড়বে, হলুদই ছিল ওর প্রিয় রং, আলোর প্রতীক, যা সমস্ত মানুষের হৃদয়ে এবং শিল্পকর্মে রয়েছে বলে ও স্বপ্ন দেখতো।’ (২ আগস্ট ১৮৯০, আলব্যের অরিয়ের কে লেখা এমিল বের্নারের লেখা চিঠি) 

মৃত্যুর দিন পনেরো আগে লেখা এক চিঠিতে ভাই থিওকে গঘ লিখেছিলেন: আমি নিজে আপাতত পাহাড় পর্যন্ত বহুবিস্তৃত বিরাট এক সমভূমি নিয়ে ব্যস্ত। সমুদ্রের মতো সীমাহীন তা, কোমল হলুদ, হালকা সবুজ আর কোমল বেগুনিতে কর্ষিত আর আগাছাভর্তি এক ভূমিখণ্ড (১০-১৪ জুলাই ১৮৯০); সন্ধ্যার অভ্যাস আছে আরেকটা কাজে—হলুদ হয়ে আসা আকাশের গায়ে দুটো নাশপাতি গাছ (২৪-২৫ জুন ১৮৯০); পেছনে নীল আল্পস—একটা পুরোনো সরাইখানা, আলোকিত হলুদ তার জানালা (১৭ জুন ১৮৯০); পটভূমিতে নীল পাহাড়ের গ্রাম, হলুদ সূর্য উঠছে (৩ মে ১৮৯০), শেষ কয়েক দিন দীপ্ত সূর্যের আলোয় হলুদ ড্যান্ডেলিয়নসহ এক বাগানের ছবি আঁকছি (৩০ এপ্রিল ১৮৯০)।

উইটফিল্ডস উইথ সাইপ্রাস, ১৮৮৯
ছবি: সংগৃহীত

বিশাল দিগন্তজোড়া খেতে উজ্জ্বল সূর্যের আলো। উপচানো হলদে আলোয় ভরা মাঠ, রেখাদের আস্ফালন। এ পাকা ফসলের ভরা প্রান্তর। ফসলি হলুদে মন আনন্দ করা পরিবেশ। যাপনে যৎসামান্য খরচ করলেও তুলি-রং-কাগজ-ক্যানভাসে বেপরোয়া, বেহিসাবি খরুচে! গ্রীষ্মের সব হিসাব হলুদে পুরে রাঙিয়ে তোলা অপার দরদে। গঘের গ্রীষ্মভুবনে হলুদ বৈভব। এ তাঁর নিজস্ব হলুদ যাপন। তিনি আলো আঁকতে রোদ ধরেছেন হলুদের কারিশমায়। রোদরঙে তাঁর গ্রীষ্ম ঘরবসতি। আলোর দাপট। হলুদে উষ্ণতার খোঁজ। এ এক হলদে আলোর সাম্রাজ্য! 

গ্রীষ্মের আকাশ প্রকৃতিকে গঘীয় তালাশের রঙে উজ্জ্বল করে এঁকে নিজের জীবনটাকে বাঁচার যোগ্য করে রেখেছিলেন। তাঁর ক্যানভাসে গোধূলি হয় হলুদের আশীর্বাদ ধন্য। বুকের গভীরে প্রণীত হলুদতাড়িত গ্রীষ্মের আলোকরঞ্জন। সব হৃদয়যোগে আঁকা গ্রীষ্মালোকের রংমহাল। 

শেষ গ্রীষ্মে ভ্যান গঘ প্রকৃতির মধ্যে খুঁজে পেতে চেয়েছিলেন প্রশান্তি, প্রেম এবং শেষমেশ হয়তো মুক্তি। তাঁর প্রেম ছিল রঙের প্রতি, আলো ও জীবনের প্রতি, যদিও তা ধীরে ধীরে রাত্রির দিকে গড়িয়েছিল। তবু তাঁর ক্যানভাসে গ্রীষ্ম চিরকাল বেঁচে থাকবে উজ্জ্বল, বেদনাহত ও সুন্দর।

২ আগস্ট ১৮৯০ আলব্যের অরিয়েরকে লেখা এমিল বের্নারের লেখা চিঠিতে মর্ত্যে গঘের শেষ দিনের বর্ণনা: বাইরে সূর্যের প্রখর তাপ। আবের এর বাইরে পাহাড়ে উঠে ওর কথাই বলছিলাম আমরা..।

সমাধিক্ষেত্রে পৌঁছালাম আমরা, ছোট্ট একটা নতুন জায়গা, নতুন সব সমাধিফলক। ছোট্ট একটা পাহাড়ের ওপর, নিচে বিস্তীর্ণ নীল আকাশের কোলে পাকা ফসলের খেত, যা দেখলে হয়তো ও এখনো ভালোবাসত...হয়তো...

তারপর তাঁকে সমাধিস্থলে নামানো হলো...

যে কেউ সে সময়ে কেঁদে উঠতে পারত...দিনটা এতটাই ওর জন্য সেজে উঠেছিল যে ও এখনো বেঁচে আছে, উপভোগ করছে—এ কথা না-ভাবাটাই শক্ত। 

বলাবাহুল্য, এদিনও ছিল এক নিদাঘ গ্রীষ্মদিন!