কালারস শিল্পীদের শান্তি-অন্বেষা

‘মিলনমেলায় বন্ধুরা’। শিল্পী রেহানা ইয়াসমিনলেখকের সৌজন্যে

শান্তি মানুষের অন্তর্নিহিত আকাঙ্ক্ষা। শিল্পীও এই শান্তির সন্ধানেই সৃজনের পথে হাঁটেন। কিন্তু তাঁর ব্যক্তিগত ভুবনকে অতিক্রম করে শিল্পের ভাষ্য অনিবার্যভাবে ছুঁয়ে যায় সময়ের রাজনৈতিক-সামাজিক পরিপার্শ্ব, দেশ–কাল–পাত্রের ইতিহাস ও সমষ্টিগত প্রত্যাশাকে। কালারস গ্রুপের শান্তির সন্ধানে (ইন কোয়েস্ট অব পিস) শিল্পকর্ম-প্রদর্শনীও সেই সমষ্টিগত সুরে সমৃদ্ধ; যেখানে ফুল, পাখি, দেহাবয়ব এবং আবহমান বাংলার চিরপরিচিত বিষয় শান্তির রূপকে উপস্থাপিত হয়েছে।

বিভিন্ন মাধ্যমে নির্মিত এ কাজগুলোর ভেতর যেন ছোট ছোট পাঠযোগ্য গল্প লুকিয়ে আছে। রঙের উজ্জ্বল বাহার থেকে ধাতব তারে কাগজমণ্ডিত ভাস্কর্যের বিন্যাস—সবকিছুতে একধরনের মৃদু শান্তির স্বরধ্বনি। বিশেষভাবে নজর কাড়ে ফারজানা ইসলাম মিল্কির ভাস্কর্যসমূহ, যেগুলো দৈনন্দিন জীবনের ক্ষুদ্র অথচ নিখাদ শান্তির দৃশ্যগুলোকে ধারণ করেছে। তিনি ধাতবকাঠামোর ওপর সংবাদপত্র মুড়িয়ে গড়ে তুলেছেন মানুষ ও পশুপাখির দেহাবয়ব। সেগুলো কখনো দেয়ালে বসানো নতোন্নত আকৃতি, আবার কখনো গ্যালারির মেঝেতে পূর্ণাঙ্গ ভাস্কর্য হিসেবে দণ্ডায়মান। আয়েশি ভঙ্গিতে সংবাদপত্র পাঠ, কাঁধে সন্তান নিয়ে হাঁটা, বাঁশি হাতে রাখাল কিংবা উচ্ছ্বসিত পাখিদের দৃশ্য—সব মিলিয়ে দৈনন্দিন জীবনের সরল অথচ শান্তিময় মুহূর্তগুলোই মূর্ত হয়ে উঠেছে তাঁর কাজে।

১ / ৪
‘শান্তি’। শিল্পী মনিরা সুলতানা মুক্তালেখকের সৌজন্যে

শিল্পী রেহানা ইয়াসমিন টেরাকোটায় শান্তির রূপক হিসেবে গড়েছেন এক ঝাঁক পায়রার জীবনগাথা। যে পায়রাগুলো কখনো জানালার কার্নিশে আড্ডারত, কখনো বন্ধুদের মিলনমেলায় গল্পে মত্ত, কিংবা সামাজিক সমাবেশে সম্প্রীতির শান্তিতে মশগুল। পক্ষান্তরে শায়লা আক্তার রেখা, টেক্সচার ও রঙের সমন্বয়ে পায়রাকে শান্তির প্রতীক হিসেবে ক্যানভাসে রূপ দিয়েছেন। পায়রার মতোই ফুলও এ প্রদর্শনীতে শান্তির প্রতীকরূপে আবির্ভূত। রিফাত জাহান কান্তার জবা ফুলকে আলংকারিক বিন্যাসে উচ্চকিত করা কিংবা শারমিন সিরাজীর শাপলা ও জলজ ফুল—সবই যেন পারিপার্শ্বিক প্রকৃতির স্নিগ্ধ সৌন্দর্যকে আদরে তুলে ধরে। বিমূর্ত ধারায় ফারহানা আফরোজ বাপ্পীর জলবিন্দুর প্রতীকায়ন রঙের অন্তর্নিহিত প্রাণশক্তিকে নতুন তাৎপর্য দিয়েছে।

মানুষের মুখ, বিশেষত নারীর মুখাবয়বও এ প্রদর্শনীতে এক গুরুত্বপূর্ণ ভিজ্যুয়াল মোটিফ। রেবেকা সুলতানা ফুল-লতাপাতার নকশার মধ্য দিয়ে ভালোবাসার মুখকে কোমলভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। অন্যদিকে মনিরা সুলতানা মুক্তার নারীমুখে রয়েছে রহস্যময়তার সূক্ষ্ম ছায়া, যা দর্শককে আরও গভীরে টেনে নেয়।

১ / ৪
‘হৃদয় পাখি হয়ে যায়’। শিল্পী শায়লা আখতারলেখকের সৌজন্যে

প্রদর্শনীর সমগ্র বিন্যাসে রয়েছে পরিচ্ছন্ন সংগঠনশৈলী। বিশেষত শিল্পীদের বিভিন্ন ‘সিগনিফিক্যান্ট ফর্মের’ ড্রয়িং দিয়ে নির্মিত ঝুলন্ত ইনস্টলেশনটি গ্যালারির এক কোণে দাঁড়িয়ে পুরো প্রদর্শনীর ভিজ্যুয়াল অভিমুখকে আরও এক স্তরে উন্নীত করেছে। রিফাত জাহান কান্তার ক্যানভাসের নিচে জুট কার্পেটের ওপর জবা ফুল স্থাপন প্রদর্শনীর উপস্থাপনাকে দিয়েছে অভিনব মাত্রা।

নারী শিল্পীদের এই সম্মিলিত আয়োজন আমাদের সমাজে নারীদের বন্ধুত্ব, প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে ধৈর্য এবং শিল্পচর্চার প্রতি তাঁদের অঙ্গীকারের এক উজ্জ্বল উদাহরণ। শান্তির বার্তাসমৃদ্ধ ৬ ডিসেম্বর শুরু হওয়া এই প্রদর্শনী ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দ্য ঢাকার লা গ্যালারিতে দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।