ক্রমশ: মুনেম ওয়াসিফের লেন্সে গাঁথা পুরান ঢাকা
আলোকচিত্রী মুনেম ওয়াসিফের একক দৃশ্যশিল্প প্রদর্শনী চলছে বেঙ্গল শিল্পালয়ে। ‘পাঠশালা’য় ফটোগ্রাফি শেখানোর পাশাপাশি প্যারিসের এজেন্সি ভ্যু আর মুম্বাইয়ের প্রজেক্ট ৮৮-এর সঙ্গে সম্পৃক্ত ওয়াসিফের প্রদর্শনী হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। ‘ক্রমশ’ শিরোনামের বর্তমান প্রদর্শনীটি শুরু হয়েছে গত ১৮ এপ্রিল, যা শেষ হবে ৩১ মে শনিবার।
‘ক্রমশ’ শব্দটি শুনলে প্রথমে মাথায় আসে একটি বিবর্তনের গল্প। সাধারণত এ ধরনের গল্পগুলো ফুটে ওঠে দিনপঞ্জিকার মতো ধারাবাহিকতায়। কিন্তু আর্টিস্টিক জার্নি সব সময়ের নিয়মের ঘেরটোপে আটকা পড়ে না। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে মুনেম ওয়াসিফের ছবি নির্মাণ যেন একই কাজের ভেতরে ক্রমাগত বিবর্তিত হয়েছে, আবার কখনো বাঁক বদল করেছে। কিন্তু সমাজ বদলের এক নীরব ধারাভাষ্যের ভূমিকায়, এই বিবর্তন কেবল ভবিষ্যতের দিকে না গিয়ে বারবার একই স্থান বা বস্তুর কাছে ফিরেছে, কিন্তু প্রতিবারেই ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে।
প্রদর্শনীর শিল্পকর্মগুলোর স্থানিক পটভূমি পুরান ঢাকা। পুরান ঢাকার প্রতি শিল্পীর এই পক্ষপাতিত্ব গড়ে উঠেছে দীর্ঘদিন ধরে এই এলাকার সঙ্গে সম্পৃক্ততায়, নানান ভঙ্গিতে কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে একে আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে। কেবল ঘোরাফেরা বা কাজ নয়, তিনি অনুপ্রেরণা নিয়েছেন সাহিত্য থেকেও। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ও শহীদুল জহির যেভাবে মানবের নিত্যকার স্বপ্ন, আশা, খামখেয়ালিপনা, ইতিহাস ইত্যাদি প্রকাশের একটি মাধ্যম হিসেবেই কেবল একটি অঞ্চলকে তার আঞ্চলিকতাসহ ব্যবহার করেছিলেন, সেভাবেই পুরান ঢাকার উপাদানগুলোকে ব্যবহার করলেও ওয়াসিফও মূলত একটি বৃহত্তর ক্যানভাসের চিত্রই প্রকাশ করতে চেয়েছেন। তাঁর চিত্রকর্ম নিয়ে প্রকাশিত বই ‘বিলংগিং’ও তিনি উৎসর্গ করেছেন এই দুই সাহিত্যিককে, পুরান ঢাকা নিয়ে তাঁদের গল্প ও স্বপ্নের জন্য। মুনেম ওয়াসিফ এরপর উল্লেখ করেছেন মার্কেজ, বোর্হেসসহ অন্যান্য লাতিন সাহিত্যিকের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ও প্রভাব নিয়ে। এ থেকে ম্যাজিক রিয়েলিজমের প্রতি তাঁর ঝোঁক অনুমান করা যায়। সে জন্যই হয়তো বিশেষ করে কোনো স্থানের আপন নির্যাসকে ফিজিক্যাল এগজিসট্যান্সের বাইরে গিয়ে অনুভূতির আলোকে ধরার চেষ্টা টের পাওয়া গেছে প্রদর্শনীর নানান অনুষঙ্গজুড়ে।
‘ক্রমশ’র যাত্রাপথটি যেমন সরলরৈখিক নয়, প্রকাশের মাধ্যমও তেমনি একমাত্রিক নয়। প্রদর্শনীটি সাজানো হয়েছে আলোকচিত্র, ফিল্ম ও ভাস্কর্যের মিশ্র মাধ্যমে। তিনটি পর্বে—‘অন্তর্গত’, ‘সামান্য’ ও ‘খেয়াল’ নামে। এই তিন ধরনের সমন্বয়ে; অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নানান স্তরের মিথস্ক্রিয়ায় একে অপরের সীমানাকে অতিক্রম করে যায়।
‘স্টেরিও’ শিরোনামের ছবিগুলো মুনেম ওয়াসিফের শিল্পচর্চার ক্রমবিবর্তনের ইঙ্গিত বহন করে। সাদাকালো ও রঙিন—দুই ঘরানার ছবির মধ্য দিয়ে নাগরিক কাঠামোর দুটি দিক ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। আপাতসরল, কিন্তু অন্তর্করণে জটিল নাগরিক জীবনে বিশ্বায়নের অনুপ্রবেশ কীভাবে ছাপ রাখে, তা প্রকাশে রং ও স্পেসকে ব্যবহার করা হয়েছে। সম্পাদনার মুনশিয়ানাও একটি একক অস্তিত্বের ভেতর দিয়েই বহুমাত্রিক জটিলতার প্রকাশকে সহজতর করেছে।
অন্যদিকে ‘খেয়াল’, ফিল্মের মাধ্যমে কল্পনা ও বাস্তবের মেলবন্ধনের প্রয়াস। পুরান ঢাকাকে উপলক্ষ হিসেবে ব্যবহার করে চরিত্রগুলোর পারিপার্শ্বিক ও মনস্তাত্ত্বিক জগৎকে স্পর্শ করাই এর উদ্দেশ্য বলে প্রতীয়মান হয়। দিনের নানান সময়ে পুরান ঢাকার রাস্তাঘাট আর দালানকোঠার দৃশ্য, শাস্ত্রীয় সংগীত, ঘোড়া, কুকুর, মূল চরিত্রগুলোর কিছু স্থির মুহূর্ত ইত্যাদি মিলে দৃশ্যের বাইরে সেই অন্য অনুভবের দিকে যাত্রাই মূর্ত হয়ে উঠেছে। সুবীর চৌধুরী ‘প্র্যাকটিস গ্রান্ট ২০১৫’–র অর্থায়নে নির্মিত ডকুমেন্টারিটি গতানুগতিকতার গণ্ডি ছাড়িয়ে পরাবাস্তব যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করে দর্শকের সঙ্গে।
‘পেপার নেগেটিভ’ শিরোনামের মধ্যে দিয়ে অধুনালুপ্ত বক্স ক্যামেরা ব্যবহার করে শেখ মোহাম্মদ সফদার হোসেনের সঙ্গে পুরান ঢাকাজুড়ে পোর্ট্রেট তোলার অভিজ্ঞতাজাত কিছু শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হয়েছে। অন্যদিকে ওই অঞ্চলের নগরকাঠামো, পরিবর্তনশীল স্থাপত্য, বাজার–সংলগ্ন যাপন ইত্যাদির দ্বিমাত্রিক উপস্থাপনার বাইরে গিয়ে, নানা পরিত্যক্ত ও ভগ্ন উপকরণের ত্রিমাত্রিকতার অভিনব বিন্যাসের প্রয়াস স্থান পেয়েছে ‘সামান্য’ শিরোনামের কাজগুলোয়।
প্রদর্শনীবিষয়ক ‘ক্রমশ’ নামের একটি বই প্রকাশিত হয়েছে নোকতা প্রকাশনী থেকে। সামিয়া খাতুন, রুপালি গুপ্ত ও প্রসাদ শেট্টি এবং তানজিম ওয়াহাবের লেখা আর নাতাশা জিনওয়ালার সঙ্গে মুনেম ওয়াসিফের কথোপকথনের মধ্য দিয়ে ফটোগ্রাফি, স্থাপত্য ও নগরজীবন ঘিরে দক্ষিণ এশীয় শিল্পচর্চার নানান দিক নিয়ে তাঁদের ভাবনা ও বিশ্লেষণ উঠে এসেছে।
ফটোগ্রাফি নিয়ে আগ্রহী, পুরান ঢাকার স্থাপত্য ও নগরজীবনের সমঝদার বা নিদেনপক্ষে ম্যাজিক রিয়েলিজমের ভক্ত–পাঠক—সবার জন্যই নানান মাধ্যমের উপস্থাপনায় বৈচিত্র্যময় কিছু ভাবনার খোরাক জোগাতে পারে প্রদর্শনীটি। হতে পারে মুনেম ওয়াসিফের চিন্তার বৃহত্তর ক্যানভাসের সুলুকসন্ধানের একটি প্রাথমিক সূত্রও।