ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের ফলে লুপ্তপ্রায় মসলিনশিল্পের ইতিহাসকে পরম মমতায় সংরক্ষণ করেছেন শিল্পী ইয়াসমিন জাহান নূপুর। ধানমন্ডির বেঙ্গল শিল্পালয়ে আয়োজিত তাঁর ‘আনর্যাভেলিং সাইলেন্স’ শীর্ষক প্রদর্শনীর শিল্পকর্মগুলোতে তিনি তুলে ধরেছেন বাংলার ঐতিহ্যে লালিত জামদানি, শীতলপাটি, দেয়ালপাটির মোটিফ। ফলে প্রতিটি শিল্পকর্মের সঙ্গে দর্শক সহজেই সংযোগ স্থাপন করতে পারেন।
‘কোমল ভাস্কর্য’ এবং বহু সংবেদনশীল স্থাপত্য, ভূদৃশ্য, বিভিন্ন কাজের ইন্সটলেশন, ব্যক্তিগত ইতিহাস—সবকিছুই যেন বস্ত্রের সঙ্গে শিল্পীর গভীর সম্পৃক্ততার প্রতিফলন ঘটায়। বিশেষত সূক্ষ্ম হাতে বোনা বাংলাদেশের মসলিন ও জামদানি।
শিকড়ের কাছে ফেরা মানবমনের স্বাভাবিক প্রবণতা। নকশিকাঁথা, হাতে বোনা পাটি, কুরুশের কাছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস বা মায়ের পরনের তাঁতের শাড়ি—এসব সূচিকর্মকে সময়ের ধারকরূপে প্রকাশ করতে চেয়েছেন নূপুর।
কিছু ছবিতে কাগজে আঁকা রেখা মনে করিয়ে দেয় জামদানির নকশা, পুরোনো দিনের মোজাইক মেঝে, টালির ছাঁচ, নদীর স্রোত। সরু তুলিতে জলরঙের ওয়াশে সূক্ষ্ম রেখা টেনে রংবেরঙের নকশাগুলো আঁকা। প্রদর্শনীটির কিউরেটর তানজিম ওয়াহাব বলেন, ‘বয়ন এক ধীর, সূক্ষ্ম, পরিশ্রমী সাধনা, যা গৃহস্থালি বা নারীর কাজ বলে অবহেলিত। বয়নের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে ঔপনিবেশিক বঞ্চনার ইতিহাস আর ক্ষত। এ প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে বাজার প্রতিযোগিতার মধ্যে হারিয়ে যাওয়া বয়নশিল্প, তাঁতি আর তাঁতিদের গল্পকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।’
সুতা বুনে বুনে ভাস্কর্য তৈরি করা হয়েছে শিল্পী নূপুরের বোরকা সিরিজে। এগুলোকে সফট স্কালপচার বা কোমল ভাস্কর্য রূপে আখ্যায়িত করা হয়। এ প্রসঙ্গে শিল্পী বলেন, ‘আমার চর্চায় বস্তুকে স্বভাবতই রাজনৈতিক ও নারীকেন্দ্রিক দৃষ্টিতে দেখেছি। যুগ যুগ ধরে বস্ত্রকে নারীত্ব, যত্ন-আত্তি, অদৃশ্যতা আর লালিত্যের প্রতিভূ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। চিরায়ত বোরকা শালীনতা ও আড়ালের প্রতীক। কিন্তু আমার কাজে তা হয়ে উঠেছে আখ্যানঘনিষ্ঠ একটি ত্রিমাত্রিক অবয়ব, জরির সুতাখচিত নকশা, যার দুর্বোধ্যতা সংঘাত তৈরি করে এবং বোরকা হয়ে ওঠে প্রতিরোধ ও স্বচ্ছ-অস্বচ্ছতার এক মধ্যস্থিত ক্ষেত্র।’
জরি সুতা দিয়ে সেলাই করা দেয়াল মাদুরগুলো আমাদের নিত্যদিনের গেরস্থ জীবনযাপনের সাক্ষী। প্রদর্শনীতে শিল্পী সেই সব শিল্পকে তাঁর কাজে তুলে এনেছেন, যা আমাদের ব্যবহার্য বস্তু থেকে উদ্ভূত। লোকশিল্পের অনেকগুলো বৈশিষ্ট্যের মধ্যে দুটি হলো, এ শিল্পের ব্যবহারিক উপযোগিতা থাকবে এবং এ শিল্পে দক্ষতা বংশপরাম্পরাবাহিত। শিল্পী পরাম্পরাগত শিল্পকে এ প্রদর্শনীতে সংরক্ষণ করেছেন তাঁর নিজস্ব ভাবনা ও দক্ষতার শৈলী ব্যবহার করে। ১০ অক্টোবর শুরু হওয়া এ প্রদর্শনীর শেষ দিন ২২ নভেম্বর।