আমার ইচ্ছে আমি এখানেই থাকি

যা দেখি তার ভেতরেও থাকে না-দেখা অনেক স্তর। সেই স্তরগুলো এক এক করে পার হয়ে চিন্তার সুগভীর জলে পৌঁছে দেওয়াই শিল্পের কাজ। শিল্পী মোর্শেদ জাহাঙ্গীর তাঁর একক প্রদর্শনীতে এ কাজই করেছেন সুনিপুণ হাতে। সম্প্রতি তাঁর ‘আমার ইচ্ছে আমি এখানেই থাকি’ শিরোনামে চতুর্থ একক প্রদর্শনীটি চলছে কলাকেন্দ্রে। গ্যালারিতে ঢুকলেই মনে হবে, এ যেন অচেনা কোনো পুরোনো সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ। মাটি দিয়ে তৈরি বিভিন্ন আকৃতির খণ্ড বা স্তম্ভ দাঁড়িয়ে আছে কালের বিবর্তনের সাক্ষী হয়ে। এই যান্ত্রিক কোলাহলের শহরে হঠাৎ এ যেন সুনসান প্রাচীন নগরী। এ নগরীর প্রতিটি স্তম্ভে শিল্পী তাঁর অস্তিত্ব খুঁজে বেড়িয়েছেন অস্থির সময়ে, মুক্তির আশায়।

১ / ৫
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

দেশ উপনিবেশমুক্ত হলেও আমদের মন ও মগজ বিবিধ শৃঙ্খল আর অদৃশ্যজালে এখনো আবদ্ধ। আমরা যা চাই, তা একান্তই আমাদের চাওয়া নয়, যা চিন্তা করি, সেগুলোও আমাদের নয়। অন্যদের শেখানো বা ধার করা আচরণ, চিন্তা, জীবনপ্রণালি নিয়ে আমরা কেবল একই বৃত্তে ঘুরে বেড়াই। সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি—সবকিছুই আমাদের চিন্তাকে অস্থির করে তুলছে প্রতিনিয়ত। ক্রমাগত চাপে যেন মানুষ ও তাঁর সমাজের অনুভূতির দরজাগুলো সংকীর্ণ হয়ে পড়ছে। আমাদের চিন্তাধারা, আমাদের ছুটে চলা—কোনোটাই এ থেকে মুক্তি পাচ্ছে না। 

২ / ৫
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

অনন্তকাল ধরে অতি তুচ্ছ কণার মতো ভেসে আছি যে মহাশূন্যে, এই অদ্ভুত আপসে জীবন তা থেকে চুষে নেয় আমাদের মস্তিষ্কের সাজানো নিউরন। মানুষ সোনালি মাছের মতো কাচের গোল পাত্রে কেবল ঘুরপাক খায়। এই ঘোর বা বিভ্রান্তি থেকে বেরিয়ে এসে এক সহজ-সরল জীবন চেয়েছেন শিল্পী মোর্শেদ জাহাঙ্গীর। চেয়েছেন স্থিরতা। জীবনানন্দের মতোই শিল্পী তাঁর ক্লান্ত প্রাণ নিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখা পান তাঁর বনলতা সেনের। সাধারণ মানুষের মতো জীবনদৌড়ে প্রথম হতে চান না তিনি। মাটির গন্ধ নিয়ে প্রকৃতির কাছেই বসে থাকতে চান। এই বসে থাকা শারীরিক নয়, এক মনস্তাত্ত্বিক সংযোগ, যেখানে শিল্পী বিচরণ করেন আবেগ নিয়ে।

শিল্পী মোর্শেদ জাহাঙ্গীর তাঁর সময়ের তীরে বসে অনুভূতিগুলোকে আকার দিয়েছেন মাটি দিয়ে। মাটির টুকরাগুলোর একটা নিজস্ব ভাষা আছে এখানে। এই ভাষা ধরে গভীরে তাকালে হয়তো মহাকাল-সমুদ্রের কোনো এক তীরে পৌঁছে যাবেন দর্শক। শিল্পীর মুক্তির সন্ধান দর্শকের নিজস্ব জীবন সন্ধানে একীভূত হয়ে যেতে পারে। 

৩ / ৫
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

প্রদর্শনীটি বেশ ভিন্ন আঙ্গিকে সাজিয়েছেন শিল্পী মোর্শেদ জাহাঙ্গীর। মাটি দিয়ে তৈরি টুকরা স্তম্ভগুলো সাজিয়ে তৈরি করেছেন স্থাপনা। কোনোটি শুয়ে, কোনোটি বসে, হেলে দুলে মাটির খণ্ডগুলো যেন নিজের মতো স্বাধীনভাবে অবস্থিত হয়েছে, কোনো কিছুতেই যেন কিছু আসে-যায় না তাদের। শিল্পী যেন তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত জীবন এখানেই যাপন করছেন তাঁর মতো করে। তাই তো জনসমক্ষে প্রচলিত স্রোতের বিপরীতে ঘোষণা দিলেন—‘আমার ইচ্ছে, আমি এখানেই থাকি’। সবকিছু থেকে প্রভাবমুক্ত হয়ে একটা সরল জীবনের আশায় শিল্পের দ্বারে এসে আশ্রয় নিলেন। এখানেই তাঁর শান্তি। অনুভূতি প্রকাশের তাড়নায় শিল্পীর আক্রান্ত মন যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। 

৪ / ৫
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

মাটি বরাবরই আমাদের প্রাণের কথা বলে। কালের পরিবর্তনে আমাদের হৃদয় শহরের কংক্রিটে পরিণত হলেও স্মৃতির জাদুঘর থেকে এখনো মাটির গন্ধ আসে। তাই তো শিল্পীর তৈরি মাটির স্থাপনাগুলো আমাদের চেতনা জাগ্রত করে। এ যেন পরিবর্তনশীল, নশ্বর জগতের আরেক রূপ। ক্ষয়িষ্ণুতা, ভঙ্গুরতা ও অসম্পূর্ণতার প্রতীক।

স্থাপনাগুলোর মধ্যে কোনো কোনোটিতে শব্দ সংযোজন করে এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছেন শিল্পী। হয়তো শিল্পীর চলমান জীবনকে আরও বেশি অস্থির করে তোলে চারপাশে বাজতে থাকা নানা রকম শব্দ। মেশিন, গাড়ির হর্ন বা বাতাসের শনশন শব্দ ও স্থাপনা সবকিছু মিলে মিশে যেন একে অপরের সঙ্গে কথোপকথনে লিপ্ত। সেই সঙ্গে দর্শকও এখানে এক নিবিড় অভিজ্ঞতা অর্জন করে। এ যেন গভীর দার্শনিক সফর, যেখানে অনুসন্ধান করে পাওয়া যাবে সময়প্রবাহের স্তর ও তার পরিবর্তনের মধ্যেই আমাদের অস্থায়ী অস্তিত্ব। আমরা কেবল সময়ের ক্ষুদ্র অংশ।

৫ / ৫
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিল্পের ভাষা পরিবর্তিত হয় তার নিজস্ব ঢঙে। সেই ভাষা বুঝে স্বতঃস্ফূর্ত সৃষ্টিশীলতা শিল্পীকে আরও বিশেষ জায়গায় নিয়ে যায়। মোর্শেদ জাহাঙ্গীর মূলত গতানুগতিক ধারার বাইরে গিয়ে নিরীক্ষাধর্মী কাজের মধ্যেই নিজেকে প্রকাশ করেন। ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশ, স্থান তাকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করে কাজের উপস্থাপনে। নানা প্রকার উপকরণ নিয়ে তাদের ভাষা বোঝা, তাদের সময়ের চাহিদা অনুযায়ী তৈরি করা মোর্শেদের স্বভাবের অংশ। প্রতিনিয়ত চর্চার মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকার পথ খোঁজেন তিনি। সেই ধারাবাহিকতায়ই তাঁর এবারের প্রদর্শনী। 

প্রদর্শনীটি কলাকেন্দ্রে চলবে ২৬ জুলাই ২০২৫ পর্যন্ত।