দৃশ্যমান জগৎ আমাদের চোখে ধরা দেয় সহজাতভাবেই কিন্তু দৃশ্যের অন্তরালে যে অনুভূতি, যে অদৃশ্য অভিজ্ঞতা লুকিয়ে থাকে, তা কেবল শিল্পের ভাষায়ই প্রকাশ করা সম্ভব। এ জন্য লাগে গভীর ও প্রসারিত দৃষ্টি, যা সাধারণের চোখে ধরা পড়ে না—আর সেই অদৃশ্যকে দৃশ্যমান করে তোলাই শিল্পীর কাজ।
আমরা কী দেখতে চাই আর কী চাই না, তা আমাদের ইচ্ছারই প্রকাশ; তবে জীবনের প্রতিদিনই এমন বহু দৃশ্য ঘটে যায়, যা আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এই দেখা না–দেখার দ্বন্দ্বেই তৈরি হয় এক অদ্ভুত খেলা, যা শিল্পীর চিত্রভাষায় নতুন মাত্রা পায়। এই ভাবনাকেই কেন্দ্র করে তরুণ শিল্পী মোহাম্মদ হাশেম আয়োজন করেছেন তাঁর প্রথম একক প্রদর্শনী ‘দৃশ্য অদৃশ্য’।
বান্দরবানের প্রকৃতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিতে গভীর প্রভাব ফেলেছে। তাই তাঁর ছবিতে যেমন দেখা যায় সবুজে ঘেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য; তেমনি প্রকৃতি, মানুষ ও সময়ের পারস্পরিক টানাপোড়েনে লুকিয়ে থাকা অদৃশ্য দ্বন্দ্বও ধরা পড়ে।
শিল্পীর মতে, সময়, মানুষ ও প্রকৃতি যখন একত্রে মিশে যায়, তখনই জন্ম নেয় এক অনন্ত পরিবর্তন। সেই অদৃশ্য পরিবর্তনের ভেতরই লুকিয়ে থাকে অনুভূতির গভীরতা।
হাশেমের মতে, দৃষ্টি হলো শিল্পীর একমাত্র স্বাধীনতা—তিনি যা দেখবেন বা না দেখবেন, সেটাই তাঁর নিজস্বতা। তাঁর চারকোলে আঁকা কাজগুলো ভাবনার গভীরতায় এক নতুন মাত্রা সৃষ্টি করেছে। জন্ম থেকে মৃত্যু অব্দি অবিরাম ছুটছে মানুষ—এই ঘোর থেকে বেরিয়ে নিজেকে জানতে চাওয়ার আকুলতা বা চেষ্টা আমাদেরকে আলাদা করে তোলে প্রাণিকুল থেকে।
তেমন সন্ধানে শিল্পীর ‘অদৃশ্য অবয়ব’ সিরিজে ফুটে উঠেছে মানুষের ক্লান্ত শরীর, নিঃসঙ্গতা, আত্মপরিচয়ের সন্ধান—যেন এক অন্তর্গত প্রশ্ন, ‘আমি কে?’ বুকের কাছে লাল ত্রিভুজ কখনো আত্মপরিচয়ের প্রতীক, কখনো টিকে থাকার সংগ্রামের চিহ্ন। এই আত্মসন্ধানী যাত্রা তাঁর শিল্পচর্চাকে নিয়ে গেছে আরও উচ্চতর স্তরে।
কখনো অ্যাক্রিলিকে দুর্দান্ত গতিতে ছুটে চলে সাঙ্গু নদের ধারা, এক বিস্ময়জাগানিয়া কুয়াশায় ঢাকা সে নদের সুগভীর জলে দর্শক মোহাচ্ছন্ন হবে প্রকৃতির আদিম মায়ায়। কখনো পাহাড়ি কবিতা কিংবা সূর্যমুখী ফুলের ফিসফিসানি কানে ভেসে আসে ছবির শরীর থেকে।
ফেলে আসা শৈশবের প্রকৃতির কাছে বারবার শিল্পী দ্বারস্থ হয়েছেন। স্মৃতির জাদুঘর থেকে মায়াবী ফসিল জেগে উঠেছে গ্যালারির দেয়ালে।
‘দৃশ্য’ ও ‘অদৃশ্য’র মাঝের এক অদেখা সেতুবন্ধই এই প্রদর্শনীর মূল থিম। প্রায় ২৬টি চিত্রকর্মে সাজানো প্রদর্শনীতে রয়েছে জলরং, অ্যাক্রিলিক ও চারকোলে করা কাজ—যেগুলো শিল্পীর পরিপক্ব হাতের ছোঁয়ায় এক অনন্য সৌন্দর্য পেয়েছে।
বিশেষ করে ‘আত্মচিৎকার’ নামের ছবিটিতে রং ও টেক্সচারের মেলবন্ধনে ধরা দিয়েছে এক বিমূর্ত আত্মানুভূতি। আত্মপরিচয়ের খোঁজে শিল্পীর তুলির টান পৌঁছে গেছে প্রত্যাশিত দ্বারপ্রান্তে। শিল্পীর প্রথম একক প্রদর্শনী চলবে ২২ নভেম্বর আঁলিয়স ফ্রঁসেজ দ্য গ্যালারিতে।